ফুটবল থামেনি, ফুটবল দোমড়ায়নি, ফুটবল মচকায়নি। ইউক্রেন বা সিরিয়ার গল্প, কিরিল, ইলিয়া বা রিয়েঙ্কোদের গল্প, ফুটবল শব্দের সঙ্গে একই গ্রাফের সমান্তরালে উঠেছে, নেমেছে– থামেনি কখনও। ঠিক যেমন প্রাক্তন ইউক্রেনীয় ম্যানেজার ভাদিম লাজোরেকো বলছিলেন– ‘Football is the symbol of the fact that Ukrain is not broken …’
লেখক-অধ্যাপক হলোকস্ট-সারভাইভার প্রাইমো লেভির বই ‘দ্য ড্রোন্ড অ্যান্ড দ্য সেভড’-এ নাৎসি ক্রিমেটোরিয়ামের ভেতর আশ্চর্য কিছু ফুটবল ম্যাচের কথা আছে। ‘নাৎসি এসএস’ বনাম ‘এসকে’ (ক্রিমেটোরিয়াম দেখাশোনা করা জিউইশ ‘সুন্ডারকম্যান্ডো’)। জার্মানির ইউরো ২০২৪-এ ইংল্যান্ড শিবিরের বেস ক্যাম্প থেকে ৩০ মিনিট ড্রাইভে পৌঁছনো যায় এটেসবার্গ পাহাড়ে। পৌঁছনো যায় বৃহত্তম নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বুশেনওয়াল্ডে। লোহার গেট, এখনও টাটকা সেই লেখা– ‘Jedem Das Seine’ বা ‘to each his own.’
এই বুশেনওয়াল্ডেই এসএস বনাম ইনমেটদের একাধিক ম্যাচ হত সপ্তাহে দু’দিন করে। ৮০ বছর পর স্মারক প্রদর্শনী ‘ফুটবল অ্যান্ড রিমেমব্র্যান্স’ বলছে – ‘For the SS, the games served to maintain the appearance of normality and conceal the criminal nature of the camp.’ কিন্তু ক্যাম্প-বন্দিদের কাছে?– ‘For the (players) and spectators, the sport offered the opportunity to escape the daily camp routine and its dangers– if only briefly’. ‘ইফ অনলি ব্রিফলি’।
স্মৃতি টাটকা হয়ে জন্মান্তরে বিশ্বাস করে। হিস্ট্রি রিপিটস ইটসেলফ। ফুটবল বাঁচার মন্ত্র হয়ে যায়। ক্রীড়া বাঁচার মন্ত্র হয়ে যায়। অসউইৎজ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের ফ্লোরবোর্ড থেকে ৮০ বছর পর পাওয়া যায় হাতে আঁকা চেসবোর্ড– আশ্চর্যভাবে সংরক্ষিত। অথবা রাশিয়া-ইউক্রেন। ২০২৩-এ পৌঁছেও হিংস্রতা এবং আশ্চর্য যুদ্ধ-আয়োজনের নির্লজ্জতা কমে না স্বঘোষিত শ্রেষ্ঠ জীবের। ইউরো-২০২৪-এ ইউক্রেন গ্রুপ লিগে চার পয়েন্ট পেয়েও নক আউটে উঠতে পারেনি। কষ্ট গ্যালারিতে। অবশ্য তার চেয়েও কষ্ট সাম্প্রতিক ইতিহাসে।
বেলজিয়াম ম্যাচে গ্যালারিতে বিশাল টিফো– ১৮২ জন নিহত সেনার ছোট ছোট পিক্সেল ছবি দিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বানানো অবিকল আরেক নিহত সেনা নাজারি রিন্টসেভিচ বা কোডনেমে ‘রিয়েঙ্কা’-র মুখ, সেই রিয়েঙ্কা যে ফুটবল ছাড়া আর কিছু চিনত না। ইউক্রেনের স্থানীয় ফুটবল দল নাইভা-র হয়ে গলা ফাটাত মাঠে গিয়ে। যুদ্ধের সময় ১৯তম জন্মদিন কাটাল মারিয়াপোল শহর বাঁচাতে। তারপর চার মাস রুশ সেনার অধীনে বন্দিত্ব এবং ছাড়া পেয়ে ফ্রন্টলাইনে রাইফেল নিয়ে থাকা। গত ২১ মে মাত্র ২১ ছোঁয়া রিয়েঙ্কা চলে যায় গানশটে! গ্যালারিতে সেই মুখ, টিফো– লেখা– ‘পিস হ্যাজ আ প্রাইস’।
হ্যাঁ, ‘পিস হ্যাজ আ প্রাইস’। মূল্য চোকাতে অনেকটা দেরি হয়ে যায় সভ্যতার। স্পেস, টাইম পাল্টে গিয়ে অনেক অনুষঙ্গ চলে আসে, নাড়িয়ে দেয় ব্যক্তিগত জীবন। কিরিল ভিদকোভস্কি-র কথা বলছি। কিরিল মেসিকে ভালোবাসে। ও ব্যাকে খেলে, তবুও, বলছে, নকল করতে গেলে মেসিকেই করব। ২০২২-এর ফেব্রুয়ারিতে রুশ আক্রমণের সময় ৩৬৬ জনের সঙ্গে ইয়াহিদনে-র একটি স্কুলের বেসমেন্টের ঘরে কাটায় ২৭টা দিন। বিদ্যুৎবিহীন, জলের সংযোগবিহীন, নামমাত্র খাবারে ৩৬৬ জন। বছর এগারোর কিরিলের সেসব লাগেনি। ও একটা কাঠকয়লার টুকরো পেয়েছিল। তা দিয়েই বেসমেন্টের দেওয়ালে ফুটবল ম্যাচের ছবি– মাঠে ফুটবলাররা, খেলছে, দাঁড়িয়ে আছে, গোল দিচ্ছে, গোল বাঁচাচ্ছে– কিরিল বলছে, ‘কী করব আর, কোনওভাবে তো মনটাকে সরাতে হবে সবকিছু থেকে…’। দুটো বছর পেরিয়ে এখন ১৩-এ পড়া কিরিল, ওর মা শেনিয়া, বাবা কোস্টিয়া জার্মানির ডর্টমুন্ডের কাছে পলিটিকাল অ্যাসাইলাম নিয়েছে। যুদ্ধের আগে সপ্তায় সাতদিন খেলতে যেত, এখন অচেনা দেশে কোনওভাবে একটা স্থানীয় ক্লাব পেয়ে দু’দিন করে যায়, ফুটবল খেলে। তবে সবচেয়ে বড় পুরস্কার ইউরো ২০২৪-এ। ইউক্রেনের সর্বোচ্চ ফুটবল সংস্থার অর্থে ৩০০ জন ইউক্রেনীয়র অন্যতম হিসেবে কিরিল খেলা দেখেছে নিজের দেশের ম্যাচ, গ্যালারিতে বসে। দেখা করেছেন কোচ, টিম সদস্যদের সঙ্গে। কিরিল ভিদকোভস্কি কিছুটা হলেও স্বপ্ন ছুঁয়েছেন।
আশ্চর্যভাবে ২০১৬-র সিরিয়ার আলেপ্পোর এক ১২ বছরের কিশোরীর কথা মনে পড়ছে। ওর নাম – সাজা। যুদ্ধ ওর বাবা মা, বন্ধু, এমনকী নিজের দুটো পা-কেও শেষ করেছে। ও একটা ক্রাচে করে ছেলেদের সঙ্গে ম্যাচ খেলে। অবিশ্বাস্য দক্ষতায় ক্রাচকে মাটিতে গেঁথে ‘অকেজো’ সেই পায়ে সাজার বাইসাইকেল ভলি– সিরিয়ার ভাঙা দেওয়ালে লেগে গোল। ইউনিসেফের এক মিনিট বাহান্ন সেকেন্ডের সেই অবিশ্বাস্য ভিডিওয় সাজা বলছে– ‘আমাকে কেউ পড়া বোঝানোর নেই, বন্ধুরা বোঝায় না, বোঝালেও বুঝতে পারি না। কেউ যদি থাকত’। সে বলছে– ‘আমি ফুটবল খেলতে ভালোবাসি। ফুটবল খেললে মনে থাকে না আমি জীবনে এত কিছু হারিয়েছি …’
ইউক্রেনের কথা হচ্ছিল। দেশের ৮০ শতাংশ ফুটবল ফ্যান সেনাবাহিনীতে আছে। কারপাটি লিভিভ ফুটবল ক্লাবের ফ্যান, ক্যান্টোনা পাবের মালিক বলছিলেন, যুদ্ধ শুরু হওয়ার দিন, পাবে বসে রিমোটে টিভিতে ফুটবল ম্যাচ থেকে যুদ্ধের খবরে সার্ফিং করতে করতে বিয়ারের বোতল শেষ না করেই ফ্রন্টলাইনের দিকে ছুটেছিলেন অনেকে। চোখ লাল। ডায়নামো কিয়েভের ফ্যান দিমিত্রো পায়সাতস্কা ২০২২-এর আগস্টে নিহত হন ফ্রন্টলাইনে, সন্তান-সহ অন্ধকার দেখা দিমিত্রোর স্ত্রী ওলহা-র পাশে দাঁড়ায় নিহত সেনা-ফুটবলফ্যানেদের সংস্থা ‘স্ট্যান্ডস অফ হিরোজ’। পাশে আসেন আন্দ্রেই শেভচেঙ্কো-র মতো লেজেন্ড। দেশের ওবেলন কিয়েভ ক্লাবের গোলরক্ষক নাজারলি ফেদেরোভস্কি খেলার ফাঁকে ফুটবল ট্রেনারদের সরঞ্জাম বিক্রি করার একটা দোকান চালান। বিক্রির একটা বড়সড় অংশ দেশের সেনাবাহিনীকে পাঠান। নাজারলি বলছেন, ‘আমি শান্তির জন্য প্রতীক্ষা করতে রাজি আছি’।
……………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন সোমক রায়চৌধুরীর লেখা: জায়ান্ট-কিলার থেকে জায়ান্ট হওয়ার দিকে ছুটছে আফগান ক্রিকেট
……………………………………………………………………………………………
ইনহুলেটস পেট্রোভ ক্লাবের মিডফিল্ডার অ্যালেকজান্ডার কুচুরেঙ্কে ফন্টলাইনের স্লাভিন্সক শহরের বাসিন্দাদের জন্য হিউম্যানিটারিয়ান এইড প্রোগ্রামে প্রাণপণে থেকেছেন, চাঁদা তুলে সেনাদের থার্মাল ইমেজার কিনে দিয়েছেন, বাখমুট অঞ্চলে একটি ইভাকুয়েশনের সময় দু’-দু’বার ফেটাল গানশট থেকে বেঁচেছেন। এলএনজেড চারকাসি ক্লাবের স্ট্রাইকার ইলিয়া কাভালেঙ্কোর চোখেমুখে রুশ অকুপায়েড খারসভের বেসমেন্টে নিজের মায়ের দিনের পর দিন কোনওক্রমে টিকে থাকা, আট ঘণ্টা বৃষ্টিতে ভিজে রাশিয়া-লাটভিয়া সীমান্তের ট্রেন চড়ার স্মৃতি। সেই ক্লাবের ফুটবল দলের চিকিৎসক এখনও ফ্রন্টলাইনে। বর্তমান ফুটবল দলের একাধিক সদস্য, তাঁদের পরিবার রাস্তায়, আন্ডারগ্রাউন্ড রেল স্টেশনে, গাড়ির ভেতর কাটিয়েছেন অবিশ্বাস্য প্রায়-মারণ মুহূর্ত– শুনেছেন ঘনঘন এয়ার রেইড।
তবু ফুটবল থামেনি, ফুটবল দোমড়ায়নি, ফুটবল মচকায়নি। ইউক্রেন বা সিরিয়ার গল্প, কিরিল, ইলিয়া বা রিয়েঙ্কোদের গল্প, ফুটবল শব্দের সঙ্গে একই গ্রাফের সমান্তরালে উঠেছে, নেমেছে– থামেনি কখনও। ঠিক যেমন প্রাক্তন ইউক্রেনীয় ম্যানেজার ভাদিম লাজোরেকো বলছিলেন– ‘Football is the symbol of the fact that Ukrain is not broken …’
……………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………………..