একটু বেশি রাতে ওই ভদ্রলোকের ফোন পেলাম। উনি বললেন ‘উইংকল টুইংকল’ নাটক দেখে তাঁর অভূতপূর্ব ভালো লাগার কথা। শেষে বললেন, একশোতম শো-টিও তিনি দেখতে আসবেন। একশোতম শো-এ সেই ভদ্রলোক এসেছিলেন। আবারও বাড়ি ফিরে বেশি রাতে ওঁর ফোন পেলাম। তবে এবার ওঁর গলায় অন্য স্বর। নাটকটি তাঁর ভালো লেগেছে। কিন্তু আমার অভিনয় ভালো লাগেনি। বললেন, আমি নাকি আমার অনেক সংলাপ বদলে দিয়েছি, পুরোটা বলিনি। কিন্তু আমার সে-কথা মনে হচ্ছে না।
১০.
রামপ্রসাদ সম্পর্কে শুনেছিলাম, তিনি নাকি বেড়া বেঁধেছিলেন তাঁর আরাধ্যকে আটকে রাখবেন বলে। আমার এক দার্শনিক বন্ধু এই গল্পের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন এই বলে যে, সে বেড়া বাঁধছিল না খুলছিল– তা কী করে বুঝলাম আমরা?
আমার বারেবারেই মনে হয়েছে, যখনই বেড়া ভাঙব বা বেড়া গড়ব ঠিক করেছি, তখনই দেখেছি আটকে গিয়েছি। গড়ায় বা ভাঙায়। একজন অভিনেতা একটি সংলাপের মাধ্যমে তার নিজস্ব একটি সত্য প্রমাণ করতে চাইবে, পাশের অভিনেতার কাছে তা চরম মিথ্যে বলে প্রতিভাত হতে পারে, তবুও সে করবে। সঙ্গে থাকবে অভিনেতা মানুষটির একটি সত্য। অর্থাৎ, একটি সত্য তার জীবনের নিজস্ব, যাকে সে বহন করছে, আরেক সত্যকে সে তৈরি করছে।
আমি, দেবশঙ্কর হালদার, আমার নিজস্ব একটি সত্য রয়েছে। আমি যে চরিত্রে অভিনয় করছি, সে আবার আরেকরকম সত্যতে বিশ্বাসী। তাকে যখন মান্যতা দিচ্ছি আমি, তখন যেন মনে হয় এটাই আমার সত্য। দর্শক কিন্তু জানেন আমি অভিনেতা, তবুও প্রেক্ষাগৃহে দর্শক বিস্মৃত হন। এই দুটো মানুষ পরস্পরবিরোধী হতেও পারে আবার না-ও হতে পারে। এই সময় অভিনেতা কী করে? ওই যে দূরে বসে থাকা দর্শক, জ্যান্ত মানুষ, যে সংযোগপ্রত্যাশী, তার সঙ্গে জুড়ে বসে। রক্ত-মাংসের মানুষের সঙ্গে দেয়া-নেয়া আর একটি সত্য তৈরি করে। অভিনেতা, অভিনীত চরিত্র ও দর্শক– এই তিনটি স্তরে তখন খেলা শুরু হয়। মানে যে দর্শক একটি ধারণা নিয়ে, যাপন নিয়ে, পরিচয় নিয়ে এবং মূল্যবোধ নিয়ে থিয়েটারের কাছে এসে পৌঁছেছেন, তিনি এই সত্যের দ্বারা প্রভাবিত হন, উত্তেজিত হন, আহত হন, উদাসীন হন, বিরক্ত হন, নির্লিপ্ত হন। আমি দেবশঙ্কর হালদার, আমার অভিনীত চরিত্রটির হাত ধরলাম, অভিনীত চরিত্রটি দর্শকের হাত ধারল। এই তিনজন মিলে থিয়েটার তৈরি হল।
এই কথা যে সব অভিনেতাকে মনে রাখতেই হবে, এমনটা নয়। কিন্তু যদি মনে রাখে, তাহলে অভিনয়ে সত্যের ধারকে তীক্ষ্ণ করা যেতে পারে।
আমার জীবনের একটা গল্প বলতে ইচ্ছে করল।
‘উইংকল-টুইংকল’ প্রথম করেছিলাম ২০০২ সালে। তারপর এক যুগ ধরে এর মঞ্চায়ন চলে। প্রত্যেকটি শো-ই হাউসফুল ছিল। এই নাটকটি যখন গড়ে তুলছি আমরা, তখন কিন্তু জানতাম না যে, এই নাটকটি দর্শক কীভাবে গ্রহণ করবে। শুধু জানতাম, কেউ বিরোধিতা করবে, কেউ সমর্থন করবে, আর কেউ কেউ ‘এরকমটা তো হয়েই থাকে’ বলবে। কিন্তু কোন তীব্রতায় দর্শকের কাছে ধরা দেবে কোনও নাটক, সেটা প্রথম শো-এর আগে বোঝা যায় না। একজন তদগত দর্শক, আমার পরিচিত, এক কলেজের অধ্যাপক, তিনি জানিয়েছিলেন প্রথম দিন শো দেখতে আসবেন। তো, শোয়ের পর আমরা বুঝতে পারলাম নাটকটি তীব্রভাবে দর্শকের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করতে পারছে। একটু একটু করে দর্শকরা আমার হাত ধরছে। ওরাও টান মারছে, আমিও টান মারছি। টের পাচ্ছি যে, দর্শকের সঙ্গে আত্মিক টান শুরু হয়ে গিয়েছে। আর এই টানটা বুঝতে পারলে অভিনেতার অভিনয় করতে সুবিধা হয়। আমার ছেড়ে রাখা হাত, যে অন্য হাতের প্রত্যাশী, তার জন্যই তো এত আয়োজন। সেই ছোঁয়া যখন পাওয়া যায়, তখন অভিনেতা বুঝতে পারে। পরস্পরকে এভাবে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারলে অনেক সমস্যাসংকুল নদী, সমুদ্র পার হওয়া যায়। যাই হোক, শো শেষ হওয়ার পর নাটকটির উচ্ছ্বাস আনন্দ পেরিয়ে বাড়ি ফিরে গেলাম। সদরে-অন্দরে তৃপ্তি অনুভব করছিলাম। তখনও কিন্তু দর্শকের হাতটা আমি ছাড়িনি।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল সৈয়দ মুজতবা সিরাজের ‘মায়ামৃদঙ্গ’-র কথা। একজন প্রতিষ্ঠিত আলকাপ শিল্পী ঝাকসু ওস্তাদকে নিয়ে গল্পটা শুরু হয়। হাজার হাজার মানুষের সামনে তাঁরা গান করেন, নাচেন। সেই দলের সঙ্গে জুটে যান এক মাস্টারমশাই, যিনি গাইতে পারেন। তিনি ঝাকসু ওস্তাদকে জিজ্ঞেস করেন আমি এই গানগুলো সব পারি, আমার খুব ইচ্ছে করে আপনাদের সঙ্গে আসরে আসরে গিয়ে এই গানগুলো গেয়ে বেড়াই। আমাকে নিন না, আমি যাই আপনাদের সঙ্গে। ঝাকসু তাঁর ইচ্ছেপূরণ করেন। তাঁকে নিয়ে যান। ঝাকসু ওস্তাদ সাজঘরে বসে থাকেন, মঞ্চের ওপর মাস্টারমশাই গান করেন। দর্শকের তা ভালো লাগে, হইহই করে, অভাবনীয় প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। সাজঘরে মাস্টারমশাই ফিরে আসলে ঝাকসু ওস্তাদ জিজ্ঞেস করেন, এই যে আসরে এত লোকের সামনে গান গেয়ে কেমন লাগল? তখন মুগ্ধতা নিয়ে তিনি উত্তর দিলেন– আগেও কত গান গেয়েছি, কিন্তু আজ এত লোকের সামনে যখন গান গাইলাম, লোকে ওরকম করে আদর দিল, মনে হচ্ছিল যেন নেশা লেগেছে আমার। এই শুনে ঝাকসু ওস্তাদ আপত্তি তুলে বলেন, কী বলছেন, নেশা বলছেন কেনে। বলেন মায়া। এরপর তিনি ব্যাখ্যা করছেন মায়াকে। বলছেন রেলগাড়িতে তো চেপেছেন মাস্টার, রেল থেকে নেমে গেলেও দেখবেন একটা দুলুনি থেকে যায়, ওইটে হচ্ছে মায়া।
তা যাই হোক, একটু বেশি রাতে ওই ভদ্রলোকের ফোন পেলাম। আমি স্বাভাবিকভাবেই ভাবলাম নাটকটা নিয়েই কথা বলবেন। এ কথাও ভাবলাম যে খারাপও বলতে পারেন। তবুও আমি ভীত নই, শঙ্কিত নই, এতই মায়ায় ভাসছি তখন। উনি বললেন। বললেন ওঁর অভূতপূর্ব ভালো লাগার কথা। ভালো লাগার অংশটুকু অভিনয় করেও দেখাচ্ছিলেন খানিক খানিক। আমি শুনলাম, ভালো লাগল। মনে হল টানটা আবারও টের পাচ্ছি। শেষে বললেন, একশোতম শো-টিও তিনি দেখতে আসবেন।
ইতিমধ্যে অন্য অনেক অনেক নাটকে আমি অভিনয় করছি, তারই মাঝে চলে এল এই নাটকের একশোতম শো। সেই ভদ্রলোক দেখতে এসেছিলেন সেই নাটক। আবারও বাড়ি ফিরে বেশি রাতে ওঁর ফোন পেলাম। তবে এবার গলায় অন্য স্বর। নাটকটি তাঁর ভালো লেগেছে। কিন্তু আমার অভিনয় তাঁর ভালো লাগেনি। বললেন, আমি নাকি আমার অনেক সংলাপ বদলে দিয়েছি, পুরোটা বলিনি। কিন্তু আমার সে-কথা মনে হচ্ছে না। আমি বারবার জানাচ্ছি যে কোনও সংলাপই বাদ দিইনি। এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। কিন্তু আমার কথা শুনলেন না। আমি একটু বিরক্ত হয়েই ফোনটি রেখে দিলাম।
এরপর অনেকদিন পর ‘রুদ্ধসংগীত’ নাটকেও এমনই একটি ঘটনা ঘটে। প্রথম নাটকটি দেখার অনেকদিন পর আবার নাটকটি দেখতে এসে এক ভদ্রলোক জানালেন আমি নাকি সংলাপ ভুল করছি। মূলত সংলাপের কথাই বলছেন। কিন্তু এবারও আমি নিশ্চিত যে আমি কিছু বাদ দিইনি।
কিন্তু একাধিকবার এই ঘটনা ঘটার পর আমি উত্তর খুঁজতে শুরু করলাম। পেয়েও গেলাম। আমরা হাঁটি যখন, সবাই একসঙ্গে হাঁটি। কোনও সংলাপ আমার একার নয়। আমি যে ট্রেনে উঠেছি, দর্শকও তো সেই ট্রেনেই উঠেছেন। আমি যে দুলুনি নিয়ে বাড়ি ফিরছি, দর্শকও তো সেই দুলুনি নিয়েই বাড়ি ফিরছেন। এক থেকে একশোতম শো-এর মাঝের সময়টাতেও অন্যের সঙ্গে, বা একলা নিজের সঙ্গে এই নাটকটি নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। তিনি নিজেও হয়তো সংলাপগুলো আওড়েছেন। আর তখনই একটা ঘটনা ঘটে। সেই মানুষটি তাঁর মেধা, মনন দিয়ে ওই সংলাপে নিজেরও কিছু ভাবনা সংযোজন করেন, আপন খেয়ালে, অজান্তে। তাঁর নিজস্ব সংলাপ পরবর্তীকালে নাটকের মূল সংলাপের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু আমি তো নাটকটির মহড়া দিয়েছি এতদিন, আমি তো অজান্তে এ কাজ করিনি। আমি তো জানি আমার প্রতিটি সংলাপের দাড়ি, কমা। তাই দর্শক যখন বহুদিন পর আবার নাটক দেখতে আসেন, তখন তিনি আমার মুখ থেকে আর তাঁর চেনা সংলাপগুলো পান না। তখন আহত হন, ব্যথিত হন।
পরবর্তীকালে দর্শকাসনে বসে আমি নিজেও এই একই ঘটনা ঘটাচ্ছি। অজান্তে। আমি বুঝতে পারি, কখনও কখনও এমন মায়া তৈরি হয়, যে মায়া নিজেই সংলাপ লিখিয়ে নেয়। যে সংলাপ আমার নয়। তাই অভিনেতার সত্য, অভিনীত চরিত্রের সত্য, দর্শকের সত্য মিলেমিশে এক অপার্থিব সত্য তৈরি করে। যা সম্মিলিত একটি প্রয়াস। যাকে কোনও চেনা চেহারায় ধরা যাবে না।
…পড়ুন নাটুয়া-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৯। একটি মৃতদেহকে আশ্রয় করে ভেসে যাওয়ার নামই অভিনয়
পর্ব ৮। নাটক কি মিথ্যের প্রতিশব্দ, সমার্থক?
পর্ব ৭। আমার পুরনো মুখটা আমাকে দেখিয়ে তবেই সাজঘর আমাকে ছাড়বে
পর্ব ৬। মঞ্চে আলো এসে পড়লে সব আয়োজন ভেস্তে যায় আমার
পর্ব ৫। আমার ব্যক্তিগত রং আমাকে সাহস জোগায় নতুন রঙের চরিত্রে অভিনয় করতে
পর্ব ৪। একটা ফাঁকা জায়গা ও বদলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা
পর্ব ৩। আমার অভিনয়ের গাড়িতে আমি অন্য সওয়ারি চড়িয়ে নিয়েছি আমার জন্যই
পর্ব ২। অন্যের চোখে দেখে নিজেকে রাঙিয়ে তোলা– এটাই তো পটুয়ার কাজ, তাকে নাটুয়াও বলা যেতে পারে
পর্ব ১। বাবা কি নিজের মুখের ওপর আঁকছেন, না কি সামনে ধরা আয়নাটায় ছবি আঁকছেন?
আজ যখন আমরা মার্কস ও এঙ্গেলসের বন্ধুত্বকে নতুন চোখে দেখে কমিউনিস্ট ইতিহাস রচনার কথা ভাবি, তখন একই সঙ্গে কমিউনিস্ট আন্দোলনের নারীবাদী ইতিহাস খুঁজতে গেলে আমাদের মেয়েদের এই বিপ্লবী কমরেডশিপের সম্ভাবনার, নারীবাদী বন্ধুত্বের রাজনীতির দিকেও নজর দিতে হবে।