আমার এক অগ্রজ, তরঙ্গ মুখোপাধ্যায় এ-প্রসঙ্গে যেমন বলল, নিউ মার্কেটের বেসমেন্টে ছিল শান খানের হেয়ারকাটিং সেলুন। তার বিজ্ঞাপন আসত টেলিভিশনের স্থানীয় কেবল চ্যানেলে, সেখানে খানিক এমনটাই দাবি করা হত, ওই সেলুন চুল কেটে বেরলে, মাথার পিছনে জ্যোতির মতো এই গান বেজে উঠবে। হেজিমনির বাইরেও, দূরদর্শনের প্রান্তিক চ্যানেলে জনসংস্কৃতির ছাপ রয়ে গিয়েছিল এভাবেই।
আশিতে এসেছিল ‘শান’। অমিতাভ বচ্চন, পরভিন বাবি, শশী কাপুর, রাখি গুলজার, শত্রুঘ্ন সিনহা– সব মিলিয়ে সে হইহই রইরই কাণ্ড! সেই সিনেমার অভিঘাতে, অমিতাভ-ভক্ত এক বাগবাজারি দু’পাত্তর পেটে পড়লেই বলত, ‘পরভিন ভাবি বলবি। বচ্চন দাদা হলে উনি বউদি।’ বহু পরে অনুরাগ কাশ্যপ-বিক্রমাদিত্য মোতওয়ানে-র অভূতপূর্ব ওয়েব সিরিজ ‘স্যাক্রেড গেমস’-এর মাফিয়া গণেশ গাইতোন্ডে তার প্রেমী কুক্কু-র সঙ্গে রসায়নটাকে বচ্চন-পরভিন বাবির সঙ্গে তুলনা করবে, এবং প্রতীত হবে সেই দৃশ্য থেকে, পরভিন বাবি বিনা অমিতাভ ফক্কা; কেবল বাগবাজারের মাতাল সেকথা জানতে পারবে না। তার বহু আগেই তার ইন্তেকাল হয়ে গেছে।
‘শান’-এ আবার ফিরে এল সেই ‘দিওয়ার’-খ্যাত শশী-বচ্চন জুটি। এখানেও তাঁরা দুই ভাই, পার্থক্য এটুকুই, এই দু’জনেই এখানে সমাজবিরোধী, ‘আউট-ল’, এবং দু’জনেই চায় তাদের দাদা, শিব কুমারের হত্যার প্রতিশোধ। অমিতাভ বচ্চনের চরিত্রনাম, এই ছবিতেও, বিজয়, এবং শশী কাপুরের, রবি। চিত্রনাট্যকার সেই হিট সেলিম-জাভেদ জুটি, পরিচালক রমেশ সিপ্পি। মজার ব্যাপার, এই ছবির প্রধান নায়িকা, পরভিন বাবিও (সুনীতা) আদতে চোর। আর-এক নায়িকা রেণুও (বিন্দিয়া গোস্বামী) ধারকর্জে জেরবার। দুষ্কৃতী ও দুর্ভাগ্যহত নায়ক-নায়িকাদের নিয়ে এই ছবি ‘শোলে’ বা ‘দিওয়ার’-এর জনপ্রিয়তার চূড়ার ধারেকাছেও ছিল না, কিন্তু ডিসেম্বরের কলকাতায় এই ছবি নিয়ে একেবারে শীতলতাও ছিল না। আর. ডি. বর্মনের সুর আর আনন্দ বকশির লিরিকে, ‘ইয়াম্মা ইয়াম্মা’ বা ‘পেয়ার করনেওয়ালে পেয়ার করতে হ্যায়’ জাতীয় গান স্থানীয় লক্কা পায়রাদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছে তখন। একটি সংবেদনশীল গার্লস স্কুলে অবিশ্যি, সসংকোচে আলতো বেঞ্চ বাজিয়ে ‘দোস্তো সে পেয়ার কিয়া’ গাইতে গিয়ে তখন দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়া একদল মেয়ে পাকড়াও হয় দিদিমণির হাতে, এবং কোনও মতে রাস্টিকেট থেকে রক্ষা পায়। আমার এক অগ্রজ, তরঙ্গ মুখোপাধ্যায় এ-প্রসঙ্গে যেমন বলল, নিউ মার্কেটের বেসমেন্টে ছিল শান খানের হেয়ারকাটিং সেলুন। তার বিজ্ঞাপন আসত টেলিভিশনের স্থানীয় কেবল চ্যানেলে, সেখানে খানিক এমনটাই দাবি করা হত, ওই সেলুন চুল কেটে বেরলে, মাথার পিছনে জ্যোতির মতো এই গান বেজে উঠবে। হেজিমনির বাইরেও, দূরদর্শনের প্রান্তিক চ্যানেলে জনসংস্কৃতির ছাপ রয়ে গিয়েছিল এভাবেই।
আবার, বলিউড সম্পর্কে রীতিমতো অশ্রদ্ধাশীল এক হলিউডের একান্ত ভক্ত দর্শক, বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে, অত্যন্ত অভক্তি ভরে ‘এলিট’ সিনেমায় এই ছবি দেখতে যায় এবং বন্ধুদের সদর্পে জানায়, ‘কুলভূষণ খারবান্দার এই শাকাল ক্যারেক্টারটা জেমস বন্ড থেকে ঝাঁপা!’ বন্ধুরা তামাশা করে উড়িয়ে দেয় বটে কথাটা, কিন্তু খুব ভুল সেদিন বলেনি সেই হলিউডের পোকা যুবকটি। কারণ, শাকালের আলাদা দ্বীপ, সেখানে খ্যাপা কুকুর, নরখাদক কুমির ইত্যাদির রেফারেন্স এই ছবির বছর তেরো আগে মুক্তি পাওয়া ‘ইউ অনলি লিভ টোয়াইস’-এ ডোনাল্ড প্লেসেন্স অভিনীত ব্লোফেল্ড চরিত্রটির মধ্যে ছিল। যদিও ‘ব্লোফেল্ড’-এর প্রথম আবির্ভাব কিঞ্চিৎ রহস্যময়, ‘ইউ অনলি লিভ টোয়াইস’-এরও বছর চারেক আগে, ঠান্ডা যুদ্ধের তীব্র উত্তাপে মুক্তি পাওয়া ‘ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ’-এ, সেখানে অ্যান্টনি ডসন (টাইটেল কার্ডে যাঁর নামের বদলে ছিল একটি প্রশ্নচিহ্ন) ছিলেন এই চরিত্রে। এই দুই ছবিতেই জেমস বন্ড শঁ কনারি। পরবর্তীতে, ড্যানিয়েল ক্রেগ অভিনীত ‘স্পেকটর’-এ আবার ক্রিস্টফ ওয়াল্টজ আসবেন এই চরিত্রে এবং ইয়ান ফ্লেমিং রচিত এই ভূমিকায় ওটিই সর্বকালের সেরা চরিত্রায়ণ বলে অনেকে মনে করবেন। কিন্তু সেসময় বহু বামমনস্কও যেহেতু মার্কিন প্রোপাগান্ডায় ভরা, তথাকথিত প্রতিক্রিয়াশীল জেমস বন্ড সিরিজে রীতিমতো বুঁদ হয়েছিলেন, শঁ কনারি ও তারপর ক্যারিশমায় কিছুটা পিছিয়ে থাকা রজার মুরে মোহিত-ও হয়েছিলেন, তাই শাকালকে দেখে ব্লোফেল্ড-এর কথা অনেকেরই মনে পড়েছিল।
কিন্তু শাকাল এই বঙ্গজীবনেও প্রায় লব্জ হয়ে উঠল, বিরলকেশ বা বিনাকেশ পুরুষদের জন্য। একবার এমনই এক ইন্দ্রলুপ্তসম্পন্ন স্কুলমাস্টারকে কিছু ছাত্র রাস্তায় ‘শাকাল’ বলে টিটকিরি কেটে লুকিয়ে পড়েছিল। বলিউডের থেকে দূরত্ব রাখা সেই ধুতিপাঞ্জাবি পরিহিত মাস্টারমশাই অবশ্য দূর থেকে শব্দটা সঠিক বুঝতে না পেরে, ‘তোদের চোদ্দগুষ্টি মাকাল’ বলে উল্টে আওয়াজ দিয়েছিলেন। আরেক পাড়ার রোয়াকবাজরা নিয়মিত এক ভদ্রলোককে ‘শাকালকাকু’ বলে ডাকত, সেই ভদ্রলোকও কুলভূষণ অভিনীত ভিলেন সম্পর্কে অবহিত না থেকে স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘পাড়ার হারামজাদা ছেলেগুলো রোজ আমায় শাঁকালু বলে, একদিন দেখে নেব,’ দুলে দুলে পড়া মুখস্থ করা তাঁর ছেলে ভুল শুধরে দিয়ে বলেছিল, ‘বাবা ওটা শাকাল, শান বইয়ে আছে।’ বাবা ততোধিক বিস্মিত হয়ে জানতে চান, ‘আমায় ও নামে ডাকে কেন?’, ছেলের সরল উত্তর ছিল, ‘তোমার মাথায় টাক তো, তাই।’ ছেলেটি এরপর উত্তমমধ্যম প্রহৃত হয়, ‘স্কুল পালিয়ে হিন্দি বায়োস্কোপ দেখা হচ্ছে’, বা ‘পড়তে বসে অন্যদিকে মন কেন, বড়দের মধ্যে কথা বলতে কে বলেছে’ ইত্যাদি অভিযোগে। কিন্তু শাকাল রহস্য তাঁর কাছে কতটা উন্মোচিত হয়েছিল, ভগাই জানে।
‘কালিয়া’ আসে ১৯৮১ সালে। বিপুল হিট এই ছবিতে আবারও অমিতাভ বচ্চন-পরভিন বাবি জুটি। ‘শোলে’ ছবিতে একচেটিয়া প্রশ্ন উঠেছিল, ‘তেরা কেয়া হোগা কালিয়া’, উত্তর দিলেন অমিতাভ বচ্চন, তাঁর কাল্লু চরিত্রের মধ্য দিয়ে। ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’ তখনও শাসন করছে বলিউড, তা নিয়ে আর সংশয় রইল না এই ছবির পর। আশিস নন্দী নিশ্চিত করেছিলেন, ভারতীয় জনপ্রিয় সিনেমায় যেখানে যেখানে রাজনীতির লেশমাত্র নেই, তাও আদতে আদ্যন্ত রাজনৈতিক। অ্যাংরি ইয়ং ম্যান আখ্যানের নেপথ্যে উঁকি মারা, ভারতীয় অবচেতনের পৌরাণিক নায়ক সন্ধানের সন্দর্ভও ‘কালিয়া’-র মতো ছবি থেকে প্রতিভাত হতে থাকে। কাল্লুরা অন্ত্যজ চেতনায় নায়ক হয়ে উঠতে থাকে। এ ছবির গল্প পরে স্মাগলিং ইত্যাদির চক্করে পড়লেও, প্রাথমিকভাবে শয়তান মিলমালিক বনাম শ্রমিক লড়াই-ই ছিল আখ্যানের ভিত। ইন্দিরা পতনের পরেও সমাজবাদী চেতনার যে ‘রেসিডুয়াল’, তা ‘কালিয়া’-র মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেল।
যদিও এর ঠিক পরের বছর রমেশ সিপ্পি ফের বিজয় নামে অমিতাভকে ফিরিয়ে আনতে চাইলেন কিছুটা দিওয়ার অবতারে, ‘শক্তি’-তে। এই ছবি ‘মাদার ইন্ডিয়া’-র প্রতিআখ্যান হয়ে উঠতে চেয়েছিল। বিজয় এখানে বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধস্পৃহ নায়কের বদলে হয়ে উঠল, আদর্শবাদী বাবার বিরুদ্ধে খানিকটা ইডিপাল সংকটে আক্রান্ত পুত্র, নিরুপা রায়ের পরে বলিউডি মাদার ফিগার রাখি গুলজারের সঙ্গে বচ্চনের রসায়ন হয়ে উঠল ছবির ভরকেন্দ্র। নায়িকা, স্মিতা পাতিল। আবারও সেই সেলিম-জাভেদ জুটি সেখানে হাজির। কিন্তু এই ছবি ওই ‘দিওয়ার’ অধ্যায়ের সমাপ্তি পর্বই সূচিত করছিল। ধারা বদলাচ্ছিল বলিউডের সত্তরের বয়ান।
…পড়ুন জনতা সিনেমাহল-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২৪। মরণোত্তর উত্তমকুমার হয়ে উঠলেন সিরিয়াল কিলার
পর্ব ২৩। স্কুল পালানো ছেলেটা শহিদ হলে টিকিট কাউন্টার, ব্ল্যাকাররা তা টের পেত
পর্ব ২২। ক্যাবলা অমল পালেকরের চোস্ত প্রেমিক হয়ে ওঠাও দর্শকেরই জয়
পর্ব ২১। বন্দুকধারী জিনাতকে ছাপিয়ে প্রতিরোধের মুখ হয়ে উঠলেন স্মিতা পাতিল
পর্ব ২০। হকার, হোটেল, হল! যে কলকাতার মন ছিল অনেকটা বড়
পর্ব ১৯। দেওয়ালে সাঁটা পোস্টারে আঁকা মধুবালাকে দেখে মুগ্ধ হত স্কুলপড়ুয়া মেয়েরাও
পর্ব ১৮। পানশালায় তখন ‘কহি দূর যব’ বেজে উঠলে কান্নায় ভেঙে পড়ত পেঁচো মাতাল
পর্ব ১৭। গানই ভেঙেছিল দেশজোড়া সিনেমাহলের সীমান্ত
পর্ব ১৬। পুলিশের কাছেও ‘আইকনিক’ ছিল গব্বরের ডায়লগ
পর্ব ১৫। ‘শোলে’-র চোরডাকাতরা এল কোথা থেকে?
পর্ব ১৪। ‘শোলে’-তে কি ভারত আরও আদিম হয়ে উঠল না?
পর্ব ১৩। ‘জঞ্জির’ দেখে ছেলেটা ঠিক করেছিল, প্রতিশোধ নেবে
পর্ব ১২। ‘মেরে পাস মা হ্যায়?’-এর রহস্যটা কী?
পর্ব ১১। ইন্দ্রজাল কমিকস-এর গ্রামীণ নায়ক বাহাদুর পাল্পে এসে রংচঙে হল
পর্ব ১০। দু’টাকা পঁচিশের টিকিটে জমে হিরোইনের অজানা ফ্যানের স্মৃতি
পর্ব ৯। খান্না সিনেমায় নাকি পৌরাণিক সিনেমা চলছে
পর্ব ৮। পাড়াতুতো ট্র্যাজেডিতে মিলে গেলেন উত্তমকুমার আর রাজেশ খান্না
পর্ব ৭। পাড়ার রবিদা কেঁদেছিল ‘কাটি পতঙ্গ’ আর ‘দিওয়ার’ দেখে, সাক্ষী ছিল পাড়ার মেয়েরা
পর্ব ৬। যে কলকাতায় পুলিশ-পকেটমার মিলেমিশে গেছে, সেখানে দেব আনন্দ আর নতুন করে কী শিরশিরানি দেবেন?
পর্ব ৫। হিন্দি ছবির পাপ ও একটি অ্যাডাল্ট বাড়ির গল্প
পর্ব ৪। দেব আনন্দ, একটি বোমা ও অন্ধকারে হাত ধরতে চাওয়ারা
পর্ব ৩। অন্ধকারে ঢাকা পড়ল কান্না থেকে নিষিদ্ধ স্বপ্ন!
পর্ব ২। ‘জিনা ইঁয়াহা মরনা ইঁয়াহা’ উত্তর কলকাতার কবিতা হল না কেন?
পর্ব ১। সিনেমা হলে সন্ত্রাস ও জনগণমন-র দলিল