যাবতীয় অর্থ-যশ-খ্যাতির সঙ্গে আরও একটা বিষয় যেন অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে অলিম্পিকের। বিতর্ক। এমনিতে বিশ্বের কোনও ক্রীড়া প্রতিযোগিতাই বিতর্কমুক্ত নয়। ক্রিকেট বিশ্বকাপে পিচ বদল থেকে ফুটবল বিশ্বকাপে পেনাল্টি দেওয়া– প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি এমন কিছুই আর হয়তো নেই। কিন্তু অলিম্পিক যেহেতু ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’, তাই বিতর্কটা যেন একটু বেশিই। আর এবারের প্যারিস অলিম্পিক যেন সেই বিতর্কের খনি।
অলিম্পিক। গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ। চার বছর অন্তর হওয়া ক্রীড়া মহাযজ্ঞ। যে আসরে নামার জন্য প্রাণপাত করেন ক্রীড়াবিদরা। কয়েকটা সেকেন্ড পারফর্ম করার লক্ষ্যে নিজেকে প্রস্তুত করেন কয়েক দশক ধরে। যে আসরে পাওয়া সম্মানের সামনে তুচ্ছ হয়ে যায় বিশ্বজয়ী হওয়ার যশও। না হলে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি টেনিস মেজরের মালিক অলিম্পিক সোনা গলায় নিয়ে বলতে পারেন, ‘এটাই আমার জীবনের সেরা প্রাপ্তি। আমার কেরিয়ার আজ পূর্ণ হল!’
তবে যাবতীয় অর্থ-যশ-খ্যাতির সঙ্গে আরও একটা বিষয় যেন অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। বিতর্ক। এমনিতে বিশ্বের কোনও ক্রীড়া প্রতিযোগিতাই বিতর্কমুক্ত নয়। ক্রিকেট বিশ্বকাপে পিচ বদল থেকে ফুটবল বিশ্বকাপে পেনাল্টি দেওয়া– প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি এমন কিছুই আর হয়তো নেই। কিন্তু অলিম্পিক যেহেতু ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’, তাই বিতর্কটা যেন একটু বেশিই। আর এবারের প্যারিস অলিম্পিক যেন সেই বিতর্কের ‘আইখান’! (রাশিয়ার সাখায় অবস্থিত আইখান বিশ্বের বৃহত্তম হিরের খনি।)
কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলব! শুরুর কথাই ধরুন। খ্রিস্ট-সন্তানদের মধ্যে ‘ট্র্যাজেডি’ হিসেবে পরিচিত ‘দ্য লাস্ট সাপার’ যে অমন রম্যরচনার বিষয়বস্তু হতে পারে, তা কেই বা ভাবতে পেরেছিল? তাও আবার ফ্রান্সের মতো দেশে, যেখানে খ্রিস্টানরাই সংখ্যাগুরু। এই ঘটনার সঙ্গে আবার অনেকেই অলিম্পিকের ঠিক আগে ফরাসি মনসদে বামপন্থার প্রভাব বৃদ্ধির যোগসূত্র টেনেছেন। তাঁদের জ্ঞাতার্থে একটা কথাই বলব, অলিম্পিকের মাপের কোনও অনুষ্ঠানের সূচি রাতারাতি তৈরি হয় না। অন্তত ছ’মাস আগেই রূপরেখা চূড়ান্ত হয়ে যায়। এবং তা চূড়ান্ত হওয়ার পথে অন্তত চার-পাঁচটি স্তরের অনুমোদন প্রয়োজন হয়।
শুধু সূচনা নয়, তার পরও উদ্যোক্তাদের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে পড়েছে বারবার। গেমস ভিলেজের যে অংশে ভারতীয় ক্রীড়াবিদরা ছিলেন, সেখানে পর্যাপ্ত বাতানুকূল যন্ত্রের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হয়েছে ভারতকেই। সঙ্গে সঠিক পরিমাণে এবং সঠিক সময়ে খাবার না পাওয়ার অভিযোগও উঠে এসেছে ভারতীয় ক্রীড়াবিদদের মধ্য থেকে। অবশ্য গ্রেট ব্রিটেনের মতো প্রতিবেশীরাও ফরাসি আতিথেয়তা নিয়ে বিশেষ সন্তুষ্ট নন। লন্ডন থেকে শেফ উড়িয়ে আনার মতো ঘটনাও ঘটেছে এবারের অলিম্পিকে। তবে নিশ্চিতভাবেই সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে ট্রায়াথলনের ইভেন্ট দেরিতে শুরু হওয়া। যে দেরির পিছনে কারণ হিসাবে উঠে এসেছে শ্যেন নদীর জলে লাগামছাড়া দূষণ। প্রতিযোগীদের আশ্বাস দিকে স্বয়ং প্যারিসের মেয়র সাঁতার কেটেছেন শ্যেনের বুকে। তারপরই রিপোর্ট এসেছে দূষণের মাত্রা বেশি হওয়ায়। তখন সেই মেয়রের মানসিক (এবং শারীরিক) অবস্থা ঠিক কী হয়েছিল, তা অবশ্য এখনও অজানা।
অবশ্য ডাচ ভলিবল দলের সদস্য হিসাবে ভ্যান ডে ভেনের গেমস ভিলেজে আসাটাই বা কি কম বিতর্কের, কম কলঙ্কের? ১২ বছরের কিশোরীকে ধর্ষণে দোষী ভেনকে কোন যুক্তিতে বিশ্বক্রীড়ার শ্রেষ্ঠতম আসরে প্রবেশাধিকার দেওয়া হল, তা কেবল আয়োজকরাই বলতে পারবেন। যেমন শুধু নেদারল্যান্ডসই বলতে পারবে কেন এখনও ভেন জাতীয় দলের সদস্য? দু’পক্ষই ভুলস্বীকার করে শুকনো ক্ষমাপ্রার্থনা করেই ক্ষান্ত হয়েছে।
……………………………………………………………..
গেমস ভিলেজের যে অংশে ভারতীয় ক্রীড়াবিদরা ছিলেন, সেখানে পর্যাপ্ত বাতানুকূল যন্ত্রের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হয়েছে ভারতকেই। সঙ্গে সঠিক পরিমাণে এবং সঠিক সময়ে খাবার না পাওয়ার অভিযোগও উঠে এসেছে ভারতীয় ক্রীড়াবিদদের মধ্য থেকে। অবশ্য গ্রেট ব্রিটেনের মতো প্রতিবেশীরাও ফরাসি আতিথেয়তা নিয়ে বিশেষ সন্তুষ্ট নন। লন্ডন থেকে শেফ উড়িয়ে আনার মতো ঘটনাও ঘটেছে এবারের অলিম্পিকে।
……………………………………………………………..
এ তো গেল ক্রীড়া-বহির্ভূত বিভিন্ন বিতর্ক। খেলা নিয়ে বিতর্কও কী কম হয়েছে প্যারিসে? জাঁকজমকে টোকিও অলিম্পিককে প্যারিস কতটা টেক্কা দিতে পেরেছে, (মাথায় রাখতে হবে, তিন বছর আগে কোভিডকে সঙ্গী করে গেমস আয়োজন করেছিলেন জাপানিরা) তা স্পষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিচারে যে ফ্রান্সের রাজধানীই সাম্প্রতিক সময়ে আয়োজক শহরদের মধ্যে এক নম্বরে, তা নিয়ে কোনও তর্কের অবকাশই নেই। বিনেশ ফোগতের কথাই ধরুন! ফাইনালে উঠেও লড়াই করতে পারলেন না এই ভারতীয় কুস্তিগির। ১০০ গ্রাম বাড়তি ওজনের জন্য শুধু পদক-দৌড় থেকে ছিটকে যাওয়াই নয়, অলিম্পিক থেকে বাতিল হয়ে গেলেন তিনি। যে নিয়মের দোহাই দিয়ে এই সিদ্ধান্ত, তা স্পষ্ট নয় বিশ্ব কুস্তি সংস্থার কাছে। তাই একদিকে বিনেশের কাছে সেমিফাইনালে হারা গুজমানকে ফাইনালে নামার অনুমতি দেওয়া হল। আবার ব্রোঞ্জ ম্যাচে নামার সুযোগ পেলেন তার আগের দুই রাউন্ডে বিনেশের কাছে হেরে যাওয়া লিভাচ এবং সুজাকি। অথচ ফাইনালিস্ট হিসাবে গুজমানের কাছে হারা দুই প্রতিযোগীর এই সুবিধা পাওয়ার কথা। কেন লিভাচ-সুজাকিদের বেছে নেওয়া হল, ঈশ্বরই জানেন।
কুস্তির মতো আরও এক কমব্যাট স্পোর্ট বক্সিংয়েও বিতর্ক কি কম? লস অ্যাঞ্জেলস গেমসে খেলাটাই থাকবে না। কবে ফের অলিম্পিকের আসরে বক্সিং রিং তৈরি হবে, তা স্পষ্ট নয়। এই অবস্থায় প্যারিসে বক্সিং নিয়ে বিতর্কই যেন সবচেয়ে বেশি হল। এই যেমন কেউই জানেন না, কীভাবে কোয়ার্টার ফাইনালে আলভারেজকে একতরফা ‘পেটানো’র পরও হেরে গেলেন নিশান্ত দেব। আবার বিশ্ব ব্যাডমিন্টন সংস্থার খাতায় পুরুষ হলেও আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি কোন বিচারে খেলিফেকে নারী হওয়ার শংসাপত্র দিল? একটা দেশের পাসপোর্ট অফিস কাকে কোন লিঙ্গের বলে চিহ্নিত করছে, সেটা তো আইওসি-র বিচার্য হতে পারে না। বরং তাদের নিজস্ব মাপকাঠিতে সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই কাম্য। দেশে ফেরার পর খেলিফে জাতীয় নায়কের মর্যাদা পাচ্ছেন, প্রত্যাশিতভাবেই। তাঁর বিরুদ্ধে সরব হওয়া ক্রীড়াবিদরাও একে একে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন বটে। তবে তাতেও বিতর্কটা শেষ হচ্ছে না। অবশ্য একা খেলিফে নয়, আরেক সোনাজয়ী বক্সার লিনের লিঙ্গ-পরিচয় নিয়ে অস্বচ্ছ্বতার অভিযোগও তো আর নতুন নয়। দু’জনকেই তো বিশ্ব বক্সিং সংস্থা গত বছর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের আসরে যোগ দেওয়ার অনুমতি দেয়নি। একই খেলার দুই আসরে দুই নীতি, কতটা গ্রহণযোগ্য তা না হয় পাঠকরাই বিচার করুন। আবার আইওসি যদি সঠিক হয়, তবে গত বছর খেলিফে-লিনের সঙ্গে হওয়া বৈষম্যের বিচার কে করবে?
…………………………………………………..
আরও পড়ুন অরিঞ্জয় বোস-এর লেখা: নিয়তির ওজন ১০০ গ্রাম, পদকহীন বিনেশ তবু জিতলেন অসংখ্য হৃদয়
…………………………………………………..
…………………………………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………………………………………..
সে যাই হোক। যাবতীয় বিতর্ক মাথায় নিয়ে এবারের মতো অলিম্পিক সমাপ্ত হয়েছে। এবার চার বছরের অপেক্ষা, অপেক্ষা লস অ্যাঞ্জেলসে অলিম্পিক বোধনের। সেখানে হয়তো আরও বেশি বিতর্ক হবে, সামনে আসবে নতুন নতুন অস্বচ্ছতার ছবি। কিংবা নিষ্কলঙ্ক একটা অলিম্পিকের হয়তো সাক্ষী থাকবে ভবিষ্যতের ক্রীড়াবিশ্ব। সবটাই হয়তো…