শাশ্বতীর সঙ্গে আলাপ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে, তখন শাশ্বতীদি বলতাম। কাজের জায়গায় এসে ‘দি’টা কখন যেন বাদ চলে গেল। শাশ্বতীর কাছে গল্প শুনেছি যে, ও এসেছিল ওর বন্ধু ইন্দ্রজিৎ লাহিড়ীর সঙ্গে দেখা করতে। ইন্দ্রজিৎ প্রযোজক, ডাক নাম ‘ফানি’, সেই নামেই বেশি পরিচিত। ইন্দ্রজিৎই জোর করে ওকে অ্যানাউন্সারের পদে অডিশন দেওয়ার জন্য রাজি করায়। যেদিন অডিশন দিতে এসেছে সেদিন হঠাৎ পঙ্কজদার ঘরে ডাক পড়ে এবং উনি বলেন, শাঁওলী মিত্রের ইন্টারভিউ নিতে যেতে হবে।
৩.
১৯৭৫-এর ১৫ অগাস্ট। পশ্চিমবাংলার মানুষ প্রথম আমাকে দেখলেন। শর্মিষ্ঠাদির প্রযোজনায় একটি নাচের অনুষ্ঠান সংযোজনা করতে হল। মনে রাখতে হবে, এটা কোনও রেকর্ডিং নয় লাইভ টেলিকাস্ট, অর্থাৎ সরাসরি সম্প্রচার। এবারেও বিষয়টি আমার অজানা নয়, যাকে বলে সিলেবাসের মধ্যে। মণিপুরী নৃত্যের অনুষ্ঠান। প্রথমে পুংচলোম নাচবেন জিতেন্দ্র সিং আর লাইহারোবা নাচবেন পূর্ণিমা ঘোষ। প্রথমজন আমার অনেক দিনের চেনা, অনেক নৃত্যানুষ্ঠান করেছি একসঙ্গে, ‘শাপমোচন’-এ আমি মধুশ্রী, উনি সৌরসেন। অন্যজন আমার নৃত্যগুরু, যখন আমি হাঁটতে শিখেছি প্রায় তখন থেকেই তিনি আমায় নাচের বোলে পা ফেলতে শিখিয়েছেন। ফলে, শিল্পীরা আমার কাছের। সুরঙ্গমায় আমাদের থিওরি শিখতে হত তাই পুংচলোম ও লাইহারোবা নিয়ে লিখতে এবং আত্মস্থ করতে বেশি সময় লাগল না। এবার অবশ্য একটু বেশি সতর্ক থাকতে হয়েছে কারণ লাইভ টেলিকাস্টে যেতে হবে। রাধা স্টুডিওর ফ্লোর তেমন বড় নয়, তারই একদিকে নাচের সেট ও লাইটিং, অন্যদিকে সংবাদ পাঠকের ডেস্ক, তার পাশে একটা ব্লকের ওপর কাঠের স্ট্যান্ড, তার সামনে একটা ছোট ব্লকের ওপর বসে আছেন ঘোষিকা, ধপধপে গায়ের রং, সুন্দরী। তিনটে বড় ক্যামেরা আর ক্যাপশন স্ট্যান্ড তো আছেই।
কোনার দিকে ছোট্ট এক পরিসরে আমার দাঁড়ানোর ব্যবস্থা।
প্রায় ২০-২৫ মিনিটের লাইভ অনুষ্ঠান সেরে যখন বেরচ্ছি, তখন আলাপ হল ওই ঘোষিকার সঙ্গে, সেদিনের অ্যানাউন্সার অন ডিউটি অদিতি রায়। কী সুন্দর করে বলল, ‘এত সাবলীলভাবে ক্যামেরার সামনে কথা বল, এখানে জয়েন করো অ্যানাউন্সার হিসেবে।’ আমি জানাই যে, আমার এখনও পড়াশোনা করা বাকি আছে। ও বোঝায়, এই কাজের সঙ্গে সঙ্গে সেটা অনায়াসে করা যাবে। কথা বলতে বলতে আমরা বাইরের কাচের দরজা পর্যন্ত আসি। সেখানে ছিলেন মিস্টার গার্গ, দুই সহ-অধিকর্তার একজন। আমাকে দেখেই বললেন, ‘নো ওয়ে, তোমাকে আর বেরতে দেওয়া যাচ্ছে না, ইউ মাস্ট জয়েন’, অদিতি ওঁর কথায় জোর পায়, আবারও আমায় বোঝায় । ‘লেটস সি’ গোছের হাসি হেসে চলে আসি। ভাগ্য যে সেদিন নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল, কে জানত !
৯ অগাস্ট কেবলমাত্র কলকাতায় টেলিভিশন এল তা নয়, সমগ্র পূর্ব ভারতেও প্রথম টেলিভিশন এল, তাই পূর্ব ভারতের কথাও অনুষ্ঠানের মধ্যে প্রতিফলিত হত। এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার, ৯ অগাস্ট উদ্বোধনের দিন, যেদিনের কথা আগের পর্বে বলেছিলাম সেটা কিন্তু সম্প্রচার করা হয়েছিল O B Van (Outdoor Broadcasting Van) থেকে। সেদিনের অফিসার ইনচার্জ ছিলেন যে প্রডিউসার, তিনি বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তী। আর নিউজ প্রডিউসার ছিলেন অভিজিৎ দাশগুপ্ত।
এসব তথ্য আমি ওখানে যেতে যেতে সকলের সঙ্গে আলাপ হতে হতে জানতে পারি। নয়তো প্রথম দিন আমি ছিলাম কেবলই দর্শক।
সবচেয়ে ভালো লাগত সকলের সঙ্গে সকলের সখ্য, এঁদের বন্ধুত্ব শুরু হয়েছিল পুনা ফিল্ম ইনস্টিটিউটে একসঙ্গে ট্রেনিংয়ে গিয়েছিলেন যখন, ফিরে এসে এই তরুণ তুর্কির দল পূর্ণ উদ্যমে হাতে-হাত মিলিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। সবাই যে বয়সে নবীন ছিলেন, তা নয় কিন্তু মানসিকতায় চিন্তাভাবনায় নতুন যৌবনের দূত। সে ভাবনার প্রকাশ সে সময়কার বহু অনুষ্ঠানে।
তখনকার ঘোষিকাদের মধ্যে অদিতি ছাড়াও ছিল মিমি, ভালো নাম সুজাতা, দীর্ঘাঙ্গী, সুন্দরী, ওকে আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি, ইংরেজি বিভাগের, আমার চেয়ে সিনিয়র। আর ছিল জয়া বোস, সে-ও সুন্দরী, আমি যখন এই পদে যোগ দিলাম তখন ওর সঙ্গে খুবই বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। মনে আছে, ছিয়াত্তরের অলিম্পিকের সময় আমরা সারারাত একসঙ্গে ডিউটি করেছি। আমার বাড়ি যেহেতু খুব কাছে তাই বাড়ি এসে খাবার অনুমতি মিলত, জয়াও আমার সঙ্গে আসত, অফিসের গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকত, আমরা চট করে খেয়ে নিয়ে আবার চলে যেতাম টিভি সেন্টারে। একটা মজার ব্যাপার মনে আছে, যে, জয়া বাংলা লিখত ইংরেজি হরফে, যেভাবে আমরা এখন মোবাইলে মেসেজ লিখে থাকি সাধারণত।
গ্র্যাজুয়েশনের রেজাল্ট বেরল, এম.এ-র ক্লাস শুরু হল। একই সময়ে অ্যানাউন্সার পদের জন্য অডিশনে বসলাম। কন্ট্র্যাক্ট সার্ভিস। স্থায়ী পদে যোগ দেওয়ার জন্য আরও দু’বার অডিশন হয়েছিল। বাইরের বিচারক (External Judge) হিসেবে একবার ছিলেন বিকাশ রায় ও মঞ্জু দে, অন্যবার বসন্ত চৌধুরী। এঁরা আমাকে পছন্দ করেছিলেন এবং যথেষ্ট সদয় ছিলেন।
শাশ্বতীর সঙ্গে আলাপ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে, তখন শাশ্বতীদি বলতাম। কাজের জায়গায় এসে ‘দি’টা কখন যেন বাদ চলে গেল। শাশ্বতীর কাছে গল্প শুনেছি যে, ও এসেছিল ওর বন্ধু ইন্দ্রজিৎ লাহিড়ীর সঙ্গে দেখা করতে। ইন্দ্রজিৎ প্রযোজক, ডাক নাম ‘ফানি’, সেই নামেই বেশি পরিচিত। ইন্দ্রজিৎই জোর করে ওকে অ্যানাউন্সারের পদে অডিশন দেওয়ার জন্য রাজি করায়। যেদিন অডিশন দিতে এসেছে সেদিন হঠাৎ পঙ্কজদার ঘরে ডাক পড়ে এবং উনি বলেন, শাঁওলী মিত্রের ইন্টারভিউ নিতে যেতে হবে। ও তো আকাশ থেকে পড়ে ! সে যাই হোক, অডিশন দেওয়া এবং ইন্টারভিউ নেওয়া সবই শেষ পর্যন্ত হয়েছিল। এখানে একটি তথ্য দিয়ে রাখি, যাঁরা এখান থেকে নির্বাচিত হয়ে পুনা ফিল্ম ইনস্টিটিউটে ট্রেনিং নিতে গিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে শাঁওলী মিত্রও ছিলেন কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার জন্য ওঁকে মাঝপথে ছেড়ে চলে আসতে হয়।
…………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন
……………………………………………..
সংবাদ পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে সবচেয়ে আগে আলাপ ও বন্ধুত্ব হয় ছন্দা সেনের সঙ্গে। ওর খবর পড়া ও ব্যক্তিত্বে আমি মুগ্ধ ছিলাম। সামনাসামনি পরিচয় হতে সেটা যখন বললাম তখন হেসে বলল, ‘কিন্তু সামনে দেখে হতাশ হলে তো?’ আমার মুখের রেখায় হয়তো কিছু আভাস ছিল, তাড়াতাড়ি বলে উঠি, ‘এমা তা কেন হবে, তবে ছবিতে তোমাকে আরও বেশি সুন্দর লাগে।‘ ওর শ্যামলা রং ক্যামেরার জন্য যাকে বলে, একেবারে পারফেক্ট! দিনের পর দিন ওকে দেখেছি কিছুই সাজত না কেবল পাউডার পাফ করে চলে যেত, আর আমার সোনার বরণ (তখন ছিল) মুখশ্রীকে মেকআপ আর্টিস্টরা টোন ডাউন করে দিত ক্যামেরার সামনে বসার আগে, ফলে সাজতে সময় লাগত।
…………………………………….. পড়ুন কেয়ার অফ দূরদর্শন-এর অন্যান্য পর্ব ………………………………..
পর্ব ২: স্টুডিওর প্রবল আলোয় বর্ষার গান গেয়ে অন্ধকার নামিয়ে ছিলেন নীলিমা সেন
পর্ব ১: খবর পেলাম, কলকাতায় টেলিভিশন আসছে রাধা ফিল্ম স্টুডিওতে
যে উন্মত্ত জনতার ঢেউ রবীন্দ্রনাথকে প্রয়াণের পর ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, সেই ঢেউ হয়ে ওঠা জনতার অন্তর্গত মানুষগুলি কি জানতেন, তাঁদের এই মানুষটির প্রতি বিশ্বের মানুষের গভীর শ্রদ্ধার কথা! কয়েক মাস পড়ে, এই সংখ্যাটি কি হাতে নিয়ে দেখেছিলেন ভিড়ের মানুষেরা?