হ্যাঁ, এইটুকুই ছিল ‘কয়ামত সে কয়ামত তক’-এর প্রোমোশনাল কপি। যদিও প্রথম অভিনীত ছবি আদিত্য ভট্টাচার্যর ‘প্যারানইয়া’। বান্দ্রার এক থিয়েটারে যে ছবির স্ক্রিনিংয়ে এসে শাবানা আজমি পরিচালককে বলেছিলেন, ‘অনেস্টলি বলছি, মুভিটার মাথামুণ্ডু আমি বুঝতে পারিনি… বাট হু ইজ দ্যাট নিউ বয়?’
পরিচালক বাসু ভট্টাচার্যের ছেলে, মানে দিকপাল বিমল রায়ের নাতি, আদিত্য ভট্টাচার্য। বাঙালি ঘরানা মেনে, ঘনিষ্ঠ-বৃত্তে তিনি ‘বাবলা’ ডাকনামেই পরিচিত। স্কুল-জীবন থেকেই আদিত্য ভাবতেন, বাবা-দাদুর মতো ফিল্মমেকার হবেন। কিন্তু, গতে বাঁধা ফরমুলা তাঁকে টানে না। মাথায় এক্কাদোক্কা করে হিজিবিজবিজ ভাবনা। ক্লাসের ফাঁকফোকরে এক সহপাঠীর সঙ্গে শলা করতে বসেন, কীভাবে কী করা যায়!
আটের দশক সবে শুরু। ক্লাস টেনের ফাইনাল দিয়ে, পাওয়া গেল এক লম্বা ছুটি। আদিত্য ভেবে ফেললেন, এই সুযোগটাকে কাজে লাগাতে হবে; সিনেমাটা এখনই বানিয়ে ফেলতে হবে। সহপাঠীকেই প্রস্তাব দিলেন ছবির নায়ক হওয়ার। সহপাঠী রাজি হলেন, তবে একটা শর্তে: তাঁর পরিবারের কেউ যেন না জানে!
বাসুদা’র ছেলে ‘এক্সপেরিমেন্টাল’ ফিল্ম বানাবে শুনে, কাজ করতে রাজি হয়ে গেলেন ইন্ডাস্ট্রির তাবড় লোকজন। নায়কের বাবার চরিত্র করলেন ভিক্টর ব্যানার্জি। প্রেমিকার চরিত্র করলেন নীনা গুপ্তা। বাবার কাছ থেকে আদিত্য একটা ক্যামেরা নিলেন। মনমোহন শেট্টি ফ্রিতে দিলেন ফিল্মের স্টক। ক্যামেরার পিছনে রইলেন বিখ্যাত সিনেমাটোগ্রাফার অশোক মেহেতা। শুটিং শুরু হয়ে, মাঝপথে টাকা ফুরিয়ে গেল। আদিত্যর পড়শি ছিলেন অভিনেতা শ্রীরাম লাগু। সহপাঠীকে সঙ্গে নিয়ে, একদিন সটান তাঁর কাছে গিয়ে, হাত পাতলেন আদিত্য। দুই কিশোরের জোশ দেখে, স্নেহপরায়ণ মারাঠি ভদ্রলোক দিয়ে দিলেন হাজার দশেক টাকা।
তৈরি হল ‘প্যারানইয়া’। এক কিশোর– যে আর শিশু নেই, অথচ পুরুষ হিসেবেও পাত্তা পায় না ঠিক– তার চোখে, তার অভিজ্ঞতায় যৌনতা, হিংস্রতা, পরিবার, সমাজ, জীবনের টুকরোটাকরা… তথাকথিত কোনও প্লট বা স্টোরিলাইন নেই; শুধু পরপর কয়েকটা দৃশ্য জুড়ে দেওয়া। একটাও সংলাপ নেই। ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর, সাউন্ড– কিচ্ছু নেই। মানে, সম্পূর্ণ পিন-ড্রপ সাইলেন্ট ফিল্ম।
বান্দ্রার ডিম্পল থিয়েটারে ছোটখাটো স্ক্রিনিং রাখা হল। দেখতে এলেন শাবানা আজমি। চল্লিশ মিনিটের নিঃশব্দ ছবিমালা শেষ করে, আদিত্যকে বললেন, ‘অনেস্টলি বলছি, মুভিটার মাথামুণ্ডু আমি বুঝতে পারিনি… বাট হু ইজ দ্যাট নিউ বয়?’
পাশে বসেছিলেন আদিত্যর মা, রিঙ্কি রায় ভট্টাচার্য; সোৎসাহে বলে উঠলেন, ‘আরে, ও তো বাবলার বন্ধু, আমির… তাহিরসাবের ছেলে…’
এতক্ষণ চেয়ারের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন আমির খান, খোঁজাখুঁজিতে বেরিয়ে এলেন। শাবানা বললেন, ‘তুমি খুব ভাল অ্যাক্টর, অ্যাক্টিং-এ সিরিয়াসলি মন দাও… আমি তাহিরসাবকে বলব তোমার ট্যালেন্টের কথা…”
আমির ঘাবড়ে গেলেন, ‘প্লিজ, ম্যাম, বাড়িতে জানাবেন না… বাবা আমাকে মেরে ফেলবে…’
শাবানা কথা রেখেছিলেন, কিছুই জানাননি কাউকে। কয়েক বছর পর জবরদস্ত সিনেমায় জেঠু নাসির হুসেনকে অ্যাসিস্ট করছিলেন আমির। সেটে এসেছিলেন জাভেদ আখতার। সদ্য-তরুণকে প্রোডাকশনের কাজ করতে দেখে, জাভেদসাব প্রযোজক-পরিচালককে বললেন, ‘ইয়ে লড়কা ইধার অ্যাসিস্ট্যান্ট কিঁউ হ্যায়? এর তো ফিল্মস্টার হওয়া উচিত!’
এর ঠিক তিন বছর পর একদিন, খবরের কাগজের ভেতরের পাতায় এক কোণে, চিলতে বিজ্ঞাপন বেরল: ‘আমির খান কে? প্রশ্নটা করুন আপনার পাশের বাড়ির কিশোরীকে।’ হ্যাঁ, ওইটুকুই ছিল ‘কয়ামত সে কয়ামত তক’-এর প্রোমোশনাল কপি।
দুঁদে ফিল্মি পরিবারের সন্তান হলেও, আমিরকে সিনেমা-জগতে আসতে দিতে চাননি তাঁর বাবা। বদরাগী বাবাকে বেজায় ভয় পেতেন আমির। আসলে, প্রযোজনার ব্যবসায়, ধারদেনায় দুমড়ে গেছিলেন তাহির হুসেন। চেয়েছিলেন, ছেলে বেছে নিক কোনও স্থিতিশীল পেশা। বাবার যাতনাময় দুর্দিনের কথা মনে পড়লে, এখন চোখ ভিজে যায় আমিরের।
‘প্যারানইয়া’-র শুটিং-এ আমির বেরোতেন বাড়িতে বাহানা দিয়ে। বলতেন, এক বন্ধুর সঙ্গে দরকার আছে; ভোরবেলায় বেরোতে হলে বলতেন, হকি ম্যাচ আছে। এই সিনেমাতে তিনি, অভিনয় ছাড়াও, হাতে-কলমে অনেক কাজ করেছেন। অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর, প্রোডাকশন পার্সন, স্পট বয়– সবই ছিলেন আমির। ওইসব দৌড়-ঝাঁপ করতে করতে কৈশোরেই টের পেয়েছিলেন, ফিল্মই তাঁর পৃথিবী; বাকি জীবনটা তিনি ফিল্মমেকিং প্রসেসের মধ্যেই কাটাবেন।
প্যারানইয়া-র কাজ চলাকালীন, আদিত্য ছকে নিয়েছিলেন আমিরকে নিয়ে তাঁর পরবর্তী ছবি– রাখ। সেখানে আমির ছিলেন এক দ্বিধাগ্রস্ত খুনির চরিত্রে, স্বনামে। রিলিজ হয়েছিল ‘কয়ামত সে কয়ামত তক’-এর পর; আমির খানের স্পেশাল মেনশন মিলিয়ে ‘রাখ’ পেয়েছিল তিনখানা জাতীয় পুরস্কার।
‘ইয়াদোঁ কি বারাত’ আর ‘মদহোশ’-এ ছিল আমিরের শৈশব। ‘কয়ামত সে কয়ামত তক’-এর আগে কাজ করেছিলেন ‘সুবাহ সুবাহ’ আর ‘হোলি’-তে। ‘সুবাহ সুবাহ’-র ছোট্ট একটা ক্লিপ খুব বাজে রেজোলিউশনে ইন্টারনেটে পাওয়া যায়।
এইসবের মাঝে, জীবন এগোতে এগোতে, ব্যস্ততা বাড়তে বাড়তে, মুছে গিয়েছে দুই কিশোরের প্রথম উড়ান। ‘প্যারানইয়া’-র কোনও প্রিন্ট, কোনও কপি এখন কোথাও, এমনকী, পরিচালকের কাছেও, আর নেই। থাকলে, হয়তো, আমরা অভিনেতা আমিরের আরেকটা অবতার দেখতে পেতাম।
অডিটোরিয়াম থেকে ব্যাক স্টেজে আসার যে দরজা সেটা দিয়ে উঠে আসছিল খুব রোগা মতো একটি ছেলে, গায়ের রংটা শ্যামলা, তাকে দেখে বলি, ‘একটু দেখবেন ভাই, অডিটোরিয়াম এ সামনের রো-তে রশিদ খান বলে কেউ আছেন কিনা’, সে শুধু বলল, ‘জি’, আবারও বলি, ‘প্লিজ একটু দেখবেন’, আমি তখনও তাঁকে ভাবছি ‘usher’ জাতীয় কেউ। এবার সে একটু ইতস্তত করে নম্রভঙ্গীতে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলে, ‘জি, ম্যায় হুঁ’।