পুজোর দ্বিতীয় গল্প অম্লানকুসুম চক্রবর্তীর। প্রচ্ছদ শিল্পী: দীপঙ্কর ভৌমিক।
দেবাদৃতা বলেছিল, ‘যদি নাম বদলে নেওয়ার কোনও উপায় থাকত আমার, তাহলে আমি নেটাদৃতা হতাম। নামের মধ্যে একটা নেট-নেট ফ্লেভার থাকলে কী যে ভালো লাগে! মনে হয়, আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে।’ ও বলত, ‘তুমি বরং আমায় ডাকনামেই ডেকো। পিংকু। এই নামের মধ্যে রয়েছে পিং ধ্বনি। আই লাভ পিংস্।’ আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘গোলাপি তোমার প্রিয় রং বুঝি?’ ও বলেছিল, ‘ধুস! প্রিয় রং হতে যাবে কোন আনন্দে? এই পিং হল হোয়াটসঅ্যাপের পিং। যেটা তুমি আমায় করছ। আমি যেটা করি তোমায়। বুঝলে এবার? হাঁদারাম কোথাকার!’
এই যে বারবার ‘দেবাদৃতা বলেছিল’, ‘আমি বলেছিলাম’ বলে এতগুলো কথা বললাম, এগুলো আসলে ‘বলেছিলাম’-এর বদলে ‘লিখেছিলাম’ হবে। আরেকটা কথা আপনাদের জানাতে বড় ইচ্ছে হচ্ছে। আমি দেবাদৃতাকে বিয়ে করেছি মাস দেড়েক হল। আমাদের আশীর্বাদ করবেন।
দেবাদৃতার সঙ্গে আমার আলাপ অনলাইনে। বয়স ত্রিশ ছাড়িয়ে গেল যেদিন, সেদিন মিউচুয়াল ফান্ডের একটা এসআইপি খুলেছিলাম। শেয়ার বাজারের এক বিশেষজ্ঞ খবরের কাগজে লিখেছিলেন, ‘এক্ষুনি শুরু করুন। শুরু করে ভুলে যান তিরিশ বছরের জন্য। তিন দশক পরে মেগা রিটার্ন পাবেন।’ বয়স ত্রিশ ছাড়িয়ে গেল যেদিন, সেদিন পাত্রপাত্রী খোঁজার অ্যাপে একটা অ্যাকাউন্টও খুলেছিলাম। পিতামাতা সমস্বরে বলেছিলেন, ‘বিয়ে করে ফেলতে হবে এক্ষুনি। ঠিক সময়ে ঠিক কাজটা করে ফেলতে পারলে কয়েক দশক পরে জীবনও এক মেগা রিটার্ন দেবে।’ অনলাইনের ওই পাত্রপাত্রী ভাণ্ডার তিন মাসের সাবস্ক্রিপশনের জন্য ৩,৭০০ টাকা নিয়েছিল। বাবা আমার নামে ওই অঙ্কের চেক কেটে আমার পকেটে জোর করে গুঁজে দিয়ে মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে বলেছিল, ‘সুখী হও।’ পাশের ঘর থেকে মায়ের শাঁখ বাজানোর শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।
উঠোনে টাঙানো কাপড় শুকনোর দড়িতে দুম করে গোটা তিনেক কাক বসলে দড়িটা যেমন দোল খায়, ঠিক তেমনভাবে দোল খেল আমার মোবাইলের নোটিফিকেশন। পর্দার মাথা থেকে ঝটিতি নেমে এল, ‘হাই। আমি দেবাদৃতা। তুমি কেমন আছ?’ সাবস্ক্রাইব করার পরে তখনও ৭২ ঘণ্টা পেরোয়নি। কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে ওইটুকু সময় অবজারভেশনে রাখা হয়। পাত্রপাত্রী ভাণ্ডারে অ্যাকাউন্ট খোলার সময় আমার সেরকমই একটা অ্যারেস্ট হয়েছিল বলা চলে। তবে ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই ফল মিলেছিল। হয়তো আউট অফ ডেঞ্জার ঘোষিত হয়ে গিয়েছিলাম। হয়তো আপনারা সবাই মিলে আশীর্বাদ করেছিলেন আমাকে। আপনাদের প্রণাম।
জীবনে কখনও প্রেম-ট্রেম করার সৌভাগ্য হয়নি। নোটিফিকেশনটা দেখে ফোনের পিঠে লাগানো সেন্সরে আঙুল রেখে ফোন আনলক করার সময় কিছু দুষ্টু-চিন্তা মাথায় এল। সেটাও পিঠে আঙুল রেখে আনলক করার মতো। আর বিশদে যাচ্ছি না। মাত্র দু’-তিন লাইন আগে আপনাদের সকলকে প্রণাম জানিয়েছি! অ্যাপটা খুলে আমি চটজলদি দেবাদৃতাকে লিখলাম, ‘হাই। থ্যাংক ইউ ফর এক্সপ্রেসিং ইওর ইন্টারেস্ট।’ গোটাচারেক ফোটো আছে দেখলাম। হাতের মুদ্রায় ভি-চিহ্ন করা দেবাদৃতার নেপথ্যে পাহাড়, সমুদ্র, ডিস্কোথেক আর দক্ষিণেশ্বরের মন্দির। ফোটোগুলোর ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে কেমন যেন খটকা লাগল। জুম করে দেখি, সমুদ্রের উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে দক্ষিণেশ্বরের মন্দির। দেখলাম, পাহাড়চূড়ায় ডিস্কোথেক। বরফ পড়ছে চারদিক থেকে। ডিস্কোথেকের পাশে আবার কাশফুলের বন। দেবাদৃতা অবশ্য প্রতিটাতেই ঝলমল করছিল। ছবিগুলো যখন আরও জুম করে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছি, তখনই এল পরের মেসেজ। দেবাদৃতা লিখল, ‘বেশি জুম-জুম কোরো না, ব্রেনে ঝিলমিল লেগে যাবে। এগুলো সব এআই। ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স?’ আমি বলেছিলাম, ‘হ্যাঁ, জানি তো। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আর তুমি? তোমার ছবিগুলো?’ দেবাদৃতা বলেছিল, ‘যার সঙ্গে কাটাব বাকি জীবন, তার থেকে লুকব কী বা আর! আমার ছবিগুলো একশো শতাংশ অরিজিনাল। তোমার ছবিগুলোও দেখলাম। ইউ আর মাই হিরো।’
মনের মধ্যে ঝঙ্কার বেজে উঠেছিল। পিনাকেতে লেগেছিল টঙ্কার। দেবাদৃতার চারটে ছবিই সেভ করে রেখেছিলাম। একটাকে করে দিয়েছিলাম মোবাইলের ওয়ালপেপার। ঝটিতি। ল্যাপটপেরও। ঠাকুরঘর থেকে আবার শাঁখের আওয়াজ শুনেছিলাম সেদিন।
আমি দেবাদৃতাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তোমার হবি কী?’
ও বলেছিল, ‘আলাদা করে তো কিছু বলতে পারব না। যাহা কিছু অনলাইন তাহাই আমার প্রিয়।’
ওর হোয়্যাটসঅ্যাপ স্টেটাসে লেখা দেখেছিলাম, ‘মন… ওহে মন আমার, অফ থেকে অন হয়ে ওঠো।’ আমি দেবাদৃতার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘মন খারাপ?’ ও খিলখিল করে হেসে উঠেছিল। বলেছিল, ‘যত দুঃখ অফলাইনে। অনলাইনেই সুখ।’ একটু থেমে বলেছিল, ‘রিডিং বিটুইন দ্য লাইনস্ করাটা একেবারে আসে না তোমার।’
আমি বলেছিলাম, মানে লিখেছিলাম, ‘চলো দেবাদৃতা। দেখা করি একদিন।’
দেবাদৃতা বলেছিল, ‘অনলাইনেই সুখ। কী হবে দেখা করে?’
আমি বলেছিলাম, ‘মানে?’
দেবাদৃতা বলেছিল, ‘না তুমি জানো, না হামি জানে!’ ও খিলখিল করে হেসে উঠেছিল আবার। দু’ডজন স্মাইলি আমার মোবাইলের উপরে বৃষ্টিফোঁটার মতো ঝরে পড়েছিল। বুঝেছিলাম, খুব হাসছে ও।
প্রথম হাই-এর উত্তর দেওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই দেবাদৃতা আমায় পিং করে বলেছিল, ‘বিয়ে করবে আমায়? আমি তোমাকে প্রপোজ করলাম।’
আমি বলেছিলাম, ‘এত বড় সিদ্ধান্ত এত তাড়াতাড়ি?’
দেবাদৃতা বলেছিল, ‘লাভ লেটার আগে পৌঁছতে লাগতো এক মাস। এখন ডাউনলোড করা যায় মাইক্রো সেকেন্ডে। আগেকার দিনে যা আলোকবর্ষ, আজকের পৃথিবীতে তা এক সেকেন্ড।’
আমি ফের মিনমিন করে বলেছিলাম, ‘এখনও তো কেউ কাউকে দেখিইনি আমরা।’
দেবাদৃতা বলেছিল, ‘চশমা কেনার সময় ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ অফার করে অনলাইনে। আমি আমার তেমন ভিউ পাঠিয়ে দিই তোমায়? শান্তি? তোমারটাও তুমি পাঠাও।’
আমি বলেছিলাম, ‘সামনাসামনি দেখা না করে এত বড় ডিসিশন?’
দেবাদৃতা লিখেছিল, ‘এ হল তোমার সাসপিশন। বাই। ব্লকিং ইউ।’
মনে হয়েছিল, রামধনু রঙের একটা প্রজাপতি আমায় ভেংচি কেটে উড়ে গেল যেন। হাতজোড় করে বলেছিলাম, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। ডান।’ এক ডজন হাতজড়ো করা ইমোজি চকিতে পৌঁছেছিল দেবাদৃতার মোবাইলে।
দেবাদৃতা হেসেছিল ফের। মনে আছে। লিখেছিল, ‘তথাস্তু।’
আমি বললাম, ‘দুই বাড়ি কি একবার কথাও বলবে না নিজেদের মধ্যে?’
দেবাদৃতা বলেছিল, ‘যব মিঞাঁ বিবি রাজি তো কেয়া করেগা কাজি। নট রিকোয়ার্ড। চলো বিয়ের ডেটটা ফাইনাল করে ফেলি। আজকে তো ১১ ডিসেম্বর। ১৪ ফেব্রুয়ারি চলবে? দ্যাট ইজ দ্য ভ্যালেন্টাইন্স ডে, হানি। লক করছি দেন।’
আমি বললাম, ‘সেটা তো তোমার বাড়ি। আর আমাদের বাড়ির অনুষ্ঠান?’
দেবাদৃতা বলেছিল, ‘এখানে আবার আমার তোমার কি? বিয়ে, রিসেপশন আর সমস্ত ফর্মালিটি হবে একই দিনে।’
আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম বেশ। জামার হাতা দিয়ে কপালের ঘাম মুছেছিলাম। লিখেছিলাম, ‘ভেন্যু? কোন বাড়িতে হবে এত বড় অনুষ্ঠান?’
দেবাদৃতা গোটা পঞ্চাশ আশ্চর্যবোধক চিহ্ন ছুড়ে দিয়ে লিখেছিল, ‘আমার হবু হাজব্যান্ডটা বড্ড বোকা। কিচ্ছু বোঝে না।’
মা-বাবাকে আমার সিদ্ধান্তের কথা জানালাম। সেদিন শাঁখের আওয়াজ পাইনি।
হাতে আর মাত্র এক মাস তিন দিন সময় ছিল। দেবাদৃতাকে বললাম, ‘‘চলো। দু’জনে মিলে বাজার করি জব্বর।’’
দেবাদৃতা বলেছিল, ‘কল মি পিংকু, হানি। বাজার আবার অফলাইনে করে কে? সবই তো অনলাইনে।’
আমি বলেছিলাম, ‘তোমায় একটা এনগেজমেন্ট রিং দেবো।’
দেবাদৃতা বলেছিল, ‘ওয়াও। আমি একজাক্ট ডায়মেনশনটা পাঠিয়ে দিচ্ছি। প্লেস ইট অনলাইন।’ তারপরে বলল, ‘আমিও তোমায় একটা জুয়েলারি বসানো ঘড়ি দেব। দশটা লিংক পাঠাচ্ছি। ইউ চুজ ওয়ান।’
আমি বললাম, ‘তোমায় কয়েকটা শাড়ি কিনে দেবো। চলো একদিন বাজারে যাই।’
দেবাদৃতা বলেছিল, ‘মন, ওহে মন। অফ থেকে অন হয়ে ওঠো। অনলাইনে অর্ডার করে দাও। সিম্পল।’
আমি বললাম, ‘চলো না একদিন কোনও রেস্তোরাঁয়। একসঙ্গে ডিনার করি। স্ট্র দিয়ে খাই মকটেল।’
দেবাদৃতা বলেছিল, “এখনই বন্ধ করো তোমার এই অফলাইনের ককটেল। আমি তোমার পছন্দের ডিশ অর্ডার করে দিচ্ছি। তুমি আমার ফেভারিট খাবারটাও প্লেস করে দাও ফুড ডেলিভারি অ্যাপে। একসঙ্গে খাব। দু’জনেই দু’জনকে খাওয়ার ছবি শেয়ার করব।’ একটু থেমে বলেছিল, ‘একটু ইরোটিক হয়ে গেল শেষ সেনটেন্সটা। বাট, বেশ করেছি।’
হট গার্লিক পিজার উপরে চিলি ফ্লেকসের মতো আমার মোবাইলের স্ক্রিন জুড়ে খেলা করছিল রাশি রাশি লাল ঠোঁটের ইমোজি। দেবাদৃতা পাঠিয়েছিল।
আমি বললাম, ‘লোকজনদের নিমন্ত্রণপত্র পাঠাতে হবে তো। চলো যাই কলেজ স্ট্রিট।’
দেবাদৃতা বলেছিল, ‘প্লেস ইট অনলাইন। কয়েক হাজার অপশন। দেখে শুনে বেছে নিলেই হল।’
আমি বললাম, ‘তত্ত্বের জোগাড়যন্ত্র করার জন্যেও একদিন দেখা করাটা জরুরি।’
দেবাদৃতা এবারে বিরক্ত হল খুব। মোবাইলে ভেসে উঠল রাগী মুখোশ। আমি বললাম, ‘সরি। আর হবে না।’ ও পাঠাল থাম্বস আপ।
……………………………………………………………
উঠোনে টাঙানো কাপড় শুকনোর দড়িতে দুম করে গোটা তিনেক কাক বসলে দড়িটা যেমন দোল খায়, ঠিক তেমনভাবে দোল খেল আমার মোবাইলের নোটিফিকেশন। পর্দার মাথা থেকে ঝটিতি নেমে এল, ‘হাই। আমি দেবাদৃতা। তুমি কেমন আছো?’ সাবস্ক্রাইব করার পরে তখনও ৭২ ঘণ্টা পেরোয়নি। কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে ওইটুকু সময় অবজারভেশনে রাখা হয়। পাত্রপাত্রী ভাণ্ডারে অ্যাকাউন্ট খোলার সময় আমার সেরকমই একটা অ্যারেস্ট হয়েছিল বলা চলে। তবে ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই ফল মিলেছিল।
……………………………………………………………
প্রণামীর জন্য যে জামাকাপড়গুলো লাগে আমরা অনলাইনেই অর্ডার করলাম। যে দিন, যে সময়ে ডেলিভারি হওয়ার কথা ছিল, তা অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়ে পৌঁছে গেল দুই বাড়ির দোড়গোড়ায়। আমার মা-বাবা বাসে করে, ট্রেনে করে, মেট্রো করে, লঞ্চে গঙ্গা পেরিয়ে তা পৌঁছে দিয়ে এল আত্মীয়স্বজনের বাড়ি। আত্মীয়রা জিজ্ঞেস করতো, ‘বউমা কেমন?’ বাবা গম্ভীর হয়ে, গলাটা খাদে নামিয়ে বলতো, ‘তারে আমি চোখে দেখিনি, তার অনেক গল্প শুনেছি।’ সবাই আশীর্বাদ করতো আমাদের আগামী দিনগুলোর জন্য, যেমন করছেন আপনারাও।
এই প্রণামী পৌঁছে দেওয়ার কথা বলতাম যখন, দেবাদৃতা বলত, ‘রাবিশ। আজকের দিনে কেউ আর এত কষ্ট করে? হাউ নিষ্ঠুর ইউ আর। বয়স্ক লোকেদের কথাগুলো একবারও তুমি ভাবলে না?’ জানতে পেরেছিলাম, প্রণামী পৌঁছে দেওয়ার জন্য ওদের বাড়ি থেকে কাউকে এক পা-ও বেরতে হয়নি। দেবাদৃতা বলেছিল, ‘চাইলে একটা কাঁচালঙ্কাও দমদমের এক বাড়ি থেকে গড়িয়ার অন্য বাড়িতে পৌঁছে দিতে পারে ডেলিভারি অ্যাপের অ্যাসোসিয়েটরা। তাই করা হয়েছে। মেসেজে অ্যাড করে দিয়েছি, অ্যাড টেন রসগোল্লাজ জাস্ট বিফোর প্রেসিং দেয়ার কলিং বেলস্। মিষ্টিমুখও হয়েছে। মন, ওহে মন, তুমি অফ থেকে অন হয়ে ওঠো।’
আমি লিখলাম, ‘বাড়ি গেলে তো একবার আত্মীয়দের মুখও দেখা হয়।’
দেবাদৃতা যে ইমোজিটা পাঠিয়েছিল, তার বাংলা মানে করলে দাঁড়ায়, মাথায় চক্কর কাটছে। কপালের চারদিকে শনির উপগ্রহের বলয়।
বিয়ের সাত দিন আগে আমি দেবাদৃতাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘একবার অন্তত দেখা করি এবারে। আর তো মোটে কটা দিন।’
দেবাদৃতা বলল, “একজ্যাক্টলি। আর তো মোটে ক’টা দিন। ক্যান্ট ওয়েট ফর দ্যাট ডে এনি মোর, হানি।’
বিয়ের ছ’দিন আগে দেবাদৃতাকে বললাম, ‘ভেন্যুটা এখনও ঠিক হল না। কার্ড পাঠানো হল না এখনও কাউকে। ভেন্যুর সঙ্গে মেনুও ঠিক হল না। কিছু ঠিক হল না। কিচ্ছু না।’ আমি গলা চড়িয়েছিলাম। বোল্ড ফন্টে লিখেছিলাম।
দেবাদৃতা গলা চড়িয়ে দিল আরও। ফন্টগুলো আরও বড় হল। আমার হালকা লাল ছিল। ওর ফন্টগুলো রক্ত লাল হল। ও বলল, ‘আই রিপিট। ওহে মন, তুমি অফ থেকে অন হয়ে ওঠো। সব কিছু ঠিক আছে। অল সেট। কার্ড রেডি। শুধু মিটিং লিংকটার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছি।’
আমার মাথা ঝিমঝিম করছিল। আমি চুপ করেছিলাম। আমার কি-বোর্ডের ওপরে ভর করেছিল স্তব্ধতা।
দেবাদৃতা লিখল, ‘ভেন্যু কথাটা যদি মুখ দিয়ে আরেকদিন শুনেছি তাহলে বাউন্সার পাঠাব অনলাইনে। বাড়ি গিয়ে কেলিয়ে আসবে। তারপরে আমিই আবার অনলাইনে ডাক্তার পাঠাব, বুঝেছো? আই কেয়ার ফর ইউ হানি। মন দিয়ে ভালো করে শোনো। আমরা বিয়েটা করব অনলাইনে। কালকেই তোমায় মিটিং লিংক পাঠিয়ে দেব। ১৪ ফেব্রুয়ারি জয়েন করে যাবো ঠিক সন্ধে সাতটায়। সুপারহিট পুরোহিটস্ ডট কম থেকে পুরোহিতও বুক করে রাখা আছে। উনিও জয়েন করে যাবেন অন টাইম। ইনভিটেশন কার্ড, মানে তোমার ভাষায় নিমন্ত্রণপত্রও কালকে সবাইকে পাঠিয়ে দিতে পারব, মিটিং লিংকটা ওখানে চিপকে দিয়ে। বন্ধু-বান্ধব-আত্মীয়রাও উইল জয়েন। কোনও ভেন্যু-টেন্যু নেই। সবাই নিজের বাড়িতে থাকবে। পুরোহিতও নিজের বাড়িতেও যজ্ঞ করবে, কিংবা যজ্ঞটা আউটসোর্স করবে। মেনু ইজ অলমোস্ট ফাইনাল। অনুষ্ঠানটা শেষ হয়ে যাবে সোয়া নটায়। ঠিক নটা কুড়িতে লোকের বাড়িতে কলিং বেল বেজে উঠবে, উইথ হট অ্যান্ড ডিলিশাস খাবার।’
আমি অভাগার মতো বলে উঠলাম, ‘একটা বিয়ে করব। লোক আসবে না? কাউকে দেখব না? গিফ্ট পাব না কিছু?’
দেবাদৃতা বলল, ‘প্রথম দুটো পয়েন্টের তো উত্তর দিয়েছি আগেই। কামিং টু দ্য থার্ড পয়েন্ট। যতক্ষণ মিটিং লিংকটা অ্যাকটিভ থাকবে, মানে যতক্ষণ লোকেরা দেখবে আমাদের, কিংবা আমরা দেখব লোকেদের, স্ক্রিনের কোণ দিয়ে ভেসে থাকবে কিউআর কোড। নিচে মেসেজ স্ক্রল করবে, প্লিজ ব্লেস আস। খুশি? দেখবে কেমন আমদানি হয়।’
আমি বললাম, ‘সব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে পিংকু। খুব অসহায় লাগছে। এমন বিয়ে আবার হয় না কি? কোভিডকালেও তো কিছু লোক আসত সামাজিক অনুষ্ঠানে।’
দেবাদৃতা বলল, ‘ফের বলছি, ওহে মন, তুমি অফ থেকে অন হয়ে ওঠো। একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। ম্যারেজ রেজিস্ট্রারও জয়েন করবে অনলাইনে। আমরা ফর্মে ডিজিটাল সিগনেচার করে দেব। অল ডান।’
আমি বললাম, ‘খেতে বসে কেউ যদি বলে আরও একটু ভাত দাও, কী করব? লোকের পেট ভরল কি না কী করে জানব?’
দেবাদৃতা বলল, ‘অনুষ্ঠানের পরের দিনই একটা ফিডব্যাক ফর্ম যাবে তো সবার কাছে। সব সেট করা আছে। অল ডান।’
আমি লিখলাম, ‘ঝামেলার কোনও চান্স নেই তো পিংকু? আমার কেমন যেন ভয় করছে।’
দেবাদৃতা লিখল, ‘ল ফর ইউ ডট কম থেকে একজন উকিলও থাকছে আমাদের ওই ইভেন্টে। বুক করা আছে অনলাইনে। হি উইল জয়েন। রিলেশনশিপ স্পেশালিস্ট। কম্বো অফারে নিয়ে নিয়েছি। এক বছরে চারটে সার্ভিসিং ফ্রি। প্রতি কোয়ার্টারের শেষ দিনে।’
আমি বললাম, ‘সার্ভিসিং? এটা কি জলের ফিল্টার?’
দেবাদৃতা খিলখিলিয়ে হাসল। ফোন ঢেকে গেল ইমোজিতে।
আপনাদের আশীর্বাদে বিয়েটা হয়ে গেল। অনেকে বলল, আমরা নাকি ট্রেন্ডসেটার। বিয়ের আগে একটা জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট খুলে নেওয়া হয়েছিল অনলাইনে। তার কিউআরকোডে টাকা উপচে পড়ছিল। মাসি-পিসি-কাকু-কাকিমারা উলু দিল। ব্লু টুথ স্পিকারে তা গমগম করে বাজছিল। আমার মা বাবা মুখ হাঁড়ি করে বসেছিল। ওদের মন অফ থেকে অন হতে পারেনি।
মিটিং লিংকের ম্যাসেঞ্জারে মেজপিসি রেইজ হ্যান্ড করল। লিখল, ‘সাতপাকে ঘোরা হোক।’
দেবাদৃতা বলল, ‘সার্টেনলি।’ স্ক্রিনে দেখলাম, দেবাদৃতা-সহ চারদিক ঘুরছে। কি করে করেছিল জানি না। হয়তো এআই। আমি অত বুঝি না।
ছোটমাসি বলল, ‘ফুলশয্যা?’
দেবাদৃতা বলল, ‘কথা কিছু কিছু বুঝে নিতে হয়, মুখে বলা যায় না। অল সেট। ডান।’
সোয়া নটায় ইভেন্ট শেষ হয়ে গেল। মানে, আমাদের বিয়ে। আমি দেবাদৃতাকে বললাম, ‘এবার তো এসো।’
দেবাদৃতা আমায় মোবাইলে অ্যানিমেশন পাঠাল। ক্লিক করার পরে দেখি ফুলের বৃষ্টি হচ্ছে পুরো পর্দা জুড়ে। লিখল, ‘শুয়ে পড়ো। তুমিও আমায় কিছু একটা পাঠাও। প্লিজ হানি, পাঠাও। আই ক্যান্ট ওয়েট এনি মোর।’
দেবাদৃতা আর এল না। ফেসবুকে ওর ‘অ্যাবাউট মি’ পাল্টে গিয়েছিল সে রাতেই। ম্যারেড উইথ বলে আমার নাম। কিন্তু ও আর এলো না। আমি রোজ জিজ্ঞেস করি, ‘কবে আসবে? কবে? কবে? কবে?’
দেবাদৃতা বলে, ‘ওহে মন, তুমি অফ থেকে অন হয়ে ওঠো। এই তো আছি, দিব্যি আছি।’
ও আমাকে সপ্তাহে অন্তত চারবার ফুলের তোড়া পাঠায় অনলাইনে। এক এক দিন এক এক রকমের ফুল। অফিসের ক্যাফেটেরিয়ার সামনে এসে ডেলিভারি বয় ফোন করে বলে, ‘একটা পার্সেল আছে স্যার। হট ফুড প্যাকড ফর ইউ, ফ্রম দেবাদৃতা ম্যাডাম।’ আমি প্রথম দিকে পাগলের মতো দৌড়তাম। ভাবতাম, ওই খাবারে মিশে থাকবে দেবাদৃতার গন্ধ। ফুলঘ্রাণ। পার্সেলের গায়ে কলকাতার নামী রেস্তোরাঁর স্টিকার লাগানো থাকে। আমি গিলি।
আমিও ওর দেখাদেখি ফুল আর খাবার পাঠাতে শুরু করলাম।
দেবাদৃতা লিখত, ‘কপাল করে এমন কেয়ারিং হাজব্যান্ড পেয়েছি। লাভ ইউ। জয়, অনলাইনের জয়।’
দু’মাস পরেও যখন দেবাদৃতা এল না, আমি ওই রিলেশনশিপ ম্যানেজারকে ফোন করলাম। উনি ফোন কেটে দিয়ে বললেন, ‘প্লিজ পিং মি। হোয়্যাটসঅ্যাপ করুন।’ আমি লিখলাম, ‘দেখা করতে চাই আপনার সঙ্গে।’ এক্ষুনি। উনি বললেন, ‘পিং মি। মেসেজ করুন।’
আমি বললাম, ‘দেবাদৃতা, মানে আমার বউ তো আর আমার কাছে এল না।’
বললাম মানে লিখলাম আর কী। উনি তো ফোন কেটে দিয়েছিলেন।
উনি বললেন, ‘ঠিক এক মাস পরে প্রথম সার্ভিসিংটা ডিউ আছে। এক মাস নয়। ২৯ দিন। ডোন্ট ওরি। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
আমি লিখলাম, ‘অফিসের ঠিকানাটা একটু দিয়ে রাখবেন? লিখে নিই।’
উনি লিখলেন, ‘নট রিকোয়ার্ড। পুরোটাই অনলাইনে হবে। দু’ ঘণ্টা আগে মিটিং লিংক পাঠিয়ে দেব।’