উত্তর বনাম দক্ষিণ। কলকাতার এই বহু পুরনো লড়াই বারবার জেগে ওঠে দুগ্গাপুজো এলেই। কার থিম ভালো, আর কার প্রতিমা, কার মণ্ডপে শিল্প কত, আর কার ঐতিহ্যের পাল্লা ভারী– এই নিয়ে কখনও ভাব, কখনও আড়ি। কে জেতে এই শারদবেলায়? সকলেই জানে, তবু, আরেকবার– ওপেন সিক্রেট বলে কথা!
৮.
যেতে পারি কিন্তু কেন যাব?
একথা শুধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের? বিসর্জনের গাড়ি যখন চলে যাচ্ছে প্রতিমারা, তখন কেউ কোথাও থেকে কি বলে ওঠেনি একথা? কে বলল? বিসর্জনের মায়াকাজল মাখা চোখ ? মন যদিও জানে, সে দিকশূন্যপুরের যাত্রী। যেন ঠিকানা খোঁজে মাঝগঙ্গার গভীরে। সাঁতরে তুলে আনতে চায়, কৈলাস থেকে মা-কে ফিরিয়ে আনার মহামন্ত্র। কে জানে, রূপসাগরে দক্ষ ডুবুরির মতো সেই অরূপরতন মিলবে কি না। তবু সব ছাপিয়ে হৃদয়-মন্দিরে ধ্রুবপদের মতো বাজতে থাকে একটাই সুর– কথায় কথা জুড়ে, গঙ্গাপাড়ের দমকা হাওয়া ফিসফিসিয়ে বলে– ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন। কী মুশকিল বলুন, ঠাকুর কি বিসর্জন যায়, যায় তো প্রতিমা। তবুও এই চঞ্চল বলার চল।
বিন্দুতে নাকি সিন্ধু দর্শন হয়? মহামায়ার আগমনী সুরে কি আভাস থাকে না দশমীর বিষাদসিন্ধুর? সেসব ভুলেই পুজোর চারটে দিন কলকাতা কল্লোলিনী সাজে। শহর তখন মায়াপুরী। বিসর্জনের শেষপ্রহরে সেই ফিরে দেখা নেহাতই কল্পনাবিলাস, মন তোমার এই ভ্রম গেল না! তবু তুমি সাজো, সাজাও এমন করে, দেখলে মনে হয় শাশ্বত এই বিসর্জনের বুঝি বা প্রাণ আছে, একাদশী ভোরে ওই নিঃসঙ্গ মণ্ডপকে আগলে রাখা নির্লিপ্ত প্রদীপের মতো।
সেই প্রাণকে আগলে আগলে রাখে এই শহরের ইতিকথা। যেমন ঐতিহ্যকে আগলে রাখে এ শহরের উত্তর। দক্ষিণের আতিশয্যের ঢক্কানিনাদ থাকতে পারে, উত্তরে আছে প্রাণের আরাম। সেই মিঠে বাতাসে মন ভেজে বিজয়া-কালে। বিসর্জনের ভারী দীর্ঘশ্বাস নরম হয়ে যায়। প্রাণের স্ফুরণ জাগে, আবার এসো মা– জয়ধ্বনিতে। কথায় কথায় পায়ের ভিড় জমে যায়। গন্তব্য সবারই এক। মনের ডাকও। এ শহরের বুকে পুজো নামলেই দুটো নদী স্রোতস্বিনী হয়। একটা উত্তর, অরেকটা দক্ষিণ। হৃদয়ের অলিন্দ-নিলয়ের মতো তাতে জনস্রোত খেলে। কতই না তার বৈচিত্র, ততটাই বিপরীত্য। বিসর্জনের আবহে, ঐতিহ্যের সংরক্ষণেও যেন দুই চিত্র।
উত্তর কলকাতা সেই দিকশূন্যপুরের ঠিকানা জানে। জানে, ডাকের সাজের সাবেকিয়ানা। জানে কৌমবোধের গভীরতা। নোনাধরা চিকন গলিতে আলো-ছায়া মিতালি পাতায়। আশ্বিনের ছেড়া-মেঘের মতো ভেসে যায় মুঠো মুঠো হাসি। নিঃস্তব্ধতার সীমানা ভাঙে যূথবদ্ধের কলতান। দূর থেকে ভেসে আসে মণ্ডপের শঙ্খধ্বনি, প্রার্থনায় হৃদয়ের একূল-ওকূল ভাসে, মৃন্ময়ী প্রতিমায় তখন চিন্ময়ী আভা জাগে। বিসর্জনের যাত্রাপথ সেসব ছিন্নপত্র জুড়ে একটা শেষের কবিতা লেখে। যারা জীবনে কখনও সেই শাখা পথে যায়নি, সে-জায়গার নাম শোনেনি, তারা বুঝতে পারবে না নিজেদের তারা কী থেকে বঞ্চিত করছে। যেমন বঞ্চিত করেছে শহরের আরেক প্রবাহ– দক্ষিণ কলকাতা।
থিমের সাম্রাজ্যে সেখানে বিগ্রহ আছে, প্রাণ কম। কম বলেই বিসর্জনে শ্মশানের স্তব্ধতা ভিড় করে। অথচ ফেলে আসা যামিনীযাপনে সেখানে কতই না আলোর রোশনাই। কতই না মুখর মুখ। ম্যাডক্সের গল্পগুলো মনের বদ্ধ জানলায় ধাক্কা দেয়, অথচ বিজয়ার রাতে খুঁজতে গিয়ে দেখি তারা নিরুদ্দেশের যাত্রী। ঠিকানা লেখা চিঠি না দিয়েই পলাতক। নিভৃত প্রাণের দেবতাকে সেখানে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বিসর্জনের রাতে আরও বিশেষ করে। তাই তো রাজপথ ধরে ম্যাডক্সের ঠাকুর যায়, অথচ তাকে ঘিরে জন-অরণ্য উপচে পড়ে না। পড়ে থাকে উড়োখইয়ের মতো জনাকয়েক মুখ– অন্তর্জলী যাত্রার মতো বিষাদ-মাখা।
উত্তরের কলকাতা সেই ওপেন সিক্রেট জানে। উত্তরের অহংকার– বাগবাজার জানে আরও বেশি করে। ইতিহাসের অনুরণন তার শিরায় শিরায়। পুজোতেও। নবমী নিশি পার করেও সেখানে প্রাণের ছন্দে যতি পড়ে না। দশমীর সন্ধ্যাতারার নিচে ভিড় ফিকে হয়ে আসে না। পরম মমতায় ঘরের মেয়ের বিদায়গাথা লেখে অচেনা মুখ। ভরা আলোয় মিষ্টি মুখে তাদের পরমাত্মীয় বলে মনে হয়। পাড়াই তখন ঘর হয়ে ওঠে। মনে হয় এই তো আমার একান্ত আপন। সেই ভিড়ে চেনা মুখ খুঁজি। খুঁজে পাই। দেখি সে একা নয়, ভাঙা পথের রাঙা ধুলো মেখে সেই আনন্দগানে শামিল তার পরিবারও। বিজয়ার হাসি বরণ করে নেয় বিষাদের বিসর্জনকে। ব্যান্ড পার্টি, ঢাকির বোলে শিউলির সুবাস ভাসে। আলোর গাড়ির ফাঁক গলে হরির লুটের বাতাসাকে মনে হয় পুষ্পবৃষ্টি।
…………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………….
প্রসেশন এগিয়ে চলে। নাচের ছন্দে পা ভারী হয়ে এলে শুনতে পাই ‘জয় মোহনবাগান’ জয়ধ্বনি। গায়ে কাঁটা দেয়। মোহনায় পৌঁছে গেছি। যেখানে উত্তরপ্রজন্মের হাত ধরে দাঁড়িয়ে তার অগ্রজ। আচমকা মনে পড়ে যায়, দক্ষিণকে– ম্যাডক্সকে। ম্যাডক্সের দুর্গা নীরবে, নিভৃতে গঙ্গা স্পর্শ করে। উত্তর সেখানে সমারোহে। আসলে দক্ষিণ বিসর্জন জানে, উত্তর জানে বিসর্জন শেষের আগমনীকে।
……………………… পড়ুন ওপেন সিক্রেট-এর অন্যান্য পর্ব …………………….
পর্ব ৭: পুজো এলেই ‘সর্বজনীন’ নতুবা নিঃসঙ্গ?
পর্ব ৬: এক্সক্লুসিভের খোয়াব, এক্সক্লুসিভের রোয়াব
পর্ব ৫: শাসন-সোহাগের দ্বন্দ্বসমাস
পর্ব ৪: পাঁকাল সাধনায় নাকাল
পর্ব ৩: দেখা ও না-দেখার সিদ্ধান্ত
পর্ব ২: মহাবিশ্বে যে টোকে না, সে বোধহয় টেকেও না
পর্ব ১: অফিসে দৈবের বশে প্রেমতারা যদি খসে