বীণাদির সঙ্গে সম্পর্ক এমনটাই হল যে, ১৯৮৪-তে যখন আমি দ্বিতীয়বার সন্তান সম্ভবা হই, সে সময় বীণাদি আমার জন্য নিজের হাতে খাবার বানিয়ে আনতেন টালিগঞ্জের দিকে কোনও কাজে এলেই। অনেক কাল পরে, তখন কিছুদিন আমি ‘আজকের রান্না’ অনুষ্ঠান সংযোজনা করি (বলে রাখা ভালো, যাঁকে বা যাঁদের নিয়ে অনুষ্ঠান করা হত অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের সঙ্গে আমি নিজেই যোগাযোগ করতাম), একদিন বীণাদিকে ফোন করলাম, ওঁর বাড়িতে গিয়ে শুট্ করব বলে, ওঁর রান্নার স্বাদ তখনও ভুলিনি।
৮.
শর্মাজির আমলে আমি প্রথম প্রোডাকশন করার সুযোগ পেলাম। উনি নিজের ঘরে ফাইল পত্র সই করা, মিটিং করা– এইসব নানা ধরনের যা কাজ থাকত সেরে নিয়ে বাকি সময় পুরো চত্বর ঘুরে খেয়াল রাখতেন কে কতটা কী কাজ করছে। একদিন আসছিলেন এডিটিং রুমের দিক থেকে, আমি ডিউটি রুমের থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিলাম, ওঁকে দেখে দাঁড়ালাম সৌজন্য বিনিময়ের কারণে, উনিও থামলেন। উনি নড করলেন তারপর আমাকে আচমকাই জিজ্ঞেস করলেন, আমি ছোট ছোট মিনিংফুল ফিলার প্রোগ্রাম তৈরি করতে আগ্রহী কি না। আমাদের ‘একটু ভেবে দেখুন’ বলে একটা ছোট অনুষ্ঠান ছিল, যার মধ্যে দিয়ে শিক্ষা দেওয়া হতো সিভিক সেন্স, মোরাল ভ্যালুজ– এসবের, সমাজ জীবনের জন্য যা জরুরি। বুঝলাম ওই অনুষ্ঠানের কথাই উনি বলছেন। আমি সাগ্রহে রাজি। পরদিনই অফিস অর্ডার বেরিয়ে গেল, যেমন কথা তেমনি কাজ সঙ্গে সঙ্গে। আমার প্রথম কাজ, ‘অন্ধ জনে দেহ আলো’– অন্ধত্ব ও চোখ দান এই বিষয়ে অনুষ্ঠান। শুটিং করেছিলাম, বেহালা ব্লাইন্ড স্কুল, রাসবিহারি অ্যাভিনিউয়ের ‘লাইট হাউস ফর দ্য ব্লাইন্ড’-এ, প্রখ্যাত চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আই.এস. রায়ের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। ক্যামেরা করেছিল পান্না, শাক্যসিংহ ধর। এডিটিং করেছিল ইন্দর পাল কাপুর।
এডিটরদের মধ্যে কাপুর ছাড়াও ছিল মৃন্ময় চক্রবর্তী, বলবিন্দর সিং, সত্যেন্দ্র মোহান্তি। সাউন্ড রেকর্ডিস্টদের মধ্যে ছিল অনুপ মুখোপাধ্যায়, শান্তনু মজুমদার, প্রবীর মিত্র, সঞ্জয় মুখার্জি। ‘অন্ধজনে দেহ আলো’র সাউন্ড কে করেছিল মনে করতে পারছি না।
এ সময় প্রোডাকশন অ্যাসিসটেন্ট স্থায়ী পদের জন্য পরীক্ষা হয়। সুচন্দ্রা চৌধুরী, সজয় দাশগুপ্ত আগে থেকেই ক্যাজুয়াল কন্ট্রাক্টে ছিল এবার এই পরীক্ষা দিল। ঘোষণা থেকে প্রোডাকশনে আসবে বলে দেবাশিস রায়চৌধুরীও দিল। আর নতুন যারা এল তাদের মধ্যে বিভাস পাল, চম্পা চ্যাটার্জি, তপতী বিশ্বাসরা ছিল। এদের প্রত্যেকের সঙ্গে আমার যথেষ্ট ভাব হয়ে গেল।
ঘোষণা ছাড়াও মাঝে মাঝে অনুষ্ঠান সংযোজনার কাজ করতাম। একটা অনুষ্ঠানের কথা বলি, রবীন্দ্র সংগীতের ‘অন্তাক্ষরি’, যে খেলা অনেক সময় বাড়িতেও খেলা হয়, সেটাই স্টুডিওতে বসে! পরিচালনা করতে বেশ মজা লাগত। বিচারক ছিলেন সুচিত্রা মিত্র। প্রযোজনায় ছিল প্রদ্যোত। একবার এমনই এক গানের অনুষ্ঠানে এল মিষ্টি দেখতে এক মেয়ে– দেবশ্রী ধর, শুনলাম সুরঙ্গমায় গান শেখে, আমার নাচের স্কুল সুরঙ্গমা, তাই আলাপ করে আরও ভালো লাগল। এই মেয়ে পরে প্রদ্যোতের ঘরণী হয়, আরও অনেক পরে আমাদের সহকর্মী।
এই ধরনের আরেকটি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন যাত্রা জগতের নটীরা। তখনকার যাত্রাসম্রাজ্ঞী বীণা দাশগুপ্তা-র সঙ্গে সেই আমার আলাপ। আমি আগেও একবার দেখেছি নট্ট কোম্পানির কোনও যাত্রাপালা রেকর্ডিং করতে এসেছিলেন উনি ও অরুণ দাশগুপ্ত এবং তাঁদের দল। কিন্তু তখন আলাপ হয়নি, এবার হল। সম্পর্ক এমনটাই হল যে, ১৯৮৪-তে যখন আমি দ্বিতীয়বার সন্তান সম্ভবা হই, সে সময় বীণাদি আমার জন্য নিজের হাতে খাবার বানিয়ে আনতেন টালিগঞ্জের দিকে কোনও কাজে এলেই। অনেক কাল পরে, তখন কিছুদিন আমি ‘আজকের রান্না’ অনুষ্ঠান সংযোজনা করি (বলে রাখা ভালো, যাঁকে বা যাঁদের নিয়ে অনুষ্ঠান করা হত অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের সঙ্গে আমি নিজেই যোগাযোগ করতাম), একদিন বীণাদিকে ফোন করলাম, ওঁর বাড়িতে গিয়ে শুট্ করব বলে, ওঁর রান্নার স্বাদ তখনও ভুলিনি। রাজি হলেন, দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গেল। বললেন, যাত্রা করে ভোরবেলা ফিরবেন তাই সেকেন্ড হাফে আসতে, সেইমতো ব্যবস্থা হল। যেদিন ওঁর বাড়িতে যাওয়ার কথা সেই দিন সকালবেলা সংবাদপত্রে দেখলাম যাত্রা করে ফেরার পথে গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন বীণা দাশগুপ্তা।
১৯৮৪-র ওই সময় প্রায় নিয়মিত আমার জন্য খাবার বানিয়ে আনতেন আরেকজন, তিনি আরেক অভিনেত্রী, তপতীদি, তপতী ব্যানার্জী। তখন তিনি ড্রামা সেকশনে আসতেন একটি ধারাবাহিকে অভিনয়ের সূত্রে। তপতীদি বহু সিনেমায় অভিনয় করেছেন পার্শ্বচরিত্রে, মনে রাখার মতো অভিনয়, কাজ করেছেন উত্তমকুমারের সঙ্গেও। তাঁর স্বামী বিখ্যাত ফুটবলার সমর ব্যানার্জি, যিনি ‘বদ্রু ব্যানার্জি’ নামে বেশি পরিচিত। বদ্রুদার সঙ্গেও আলাপ ছিল, তিনি আসতেন আমাদের ‘খেলা আর খেলা’ অনুষ্ঠানে। শুনেছিলাম, তিনি ৫৬ সালে মেলবোর্ন অলিম্পিকসে জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়কত্ব করেছিলেন, সেইবার ফুটবলে ভারত অলিম্পিকসে চতুর্থ স্থান অধিকার করে।
আরেক অভিনেতার কথা মনে পড়ে, তিনি গায়ক অভিনেতা সবিতাব্রত দত্ত। আমার যখন বছর ১৩ বয়স তখন এক রবিবারের সকালবেলা ‘বসুশ্রী’ সিনেমা হলে ‘ব্যাপিকা বিদায়’ নাটকে সবিতাব্রত দত্তকে দেখেছিলাম এবং মুগ্ধ হয়েছিলাম। ওই নাটকে ওঁর স্ত্রী গীতা দত্তও অভিনয় করতেন। তাছাড়া সিনেমাতে দেখেছি, মুকুন্দ দাসের ভূমিকায়, ‘ছেড়ে দাও রেশমি চুড়ি বঙ্গনারী কভু হাতে আর পোরো না…’ সেই সবিতাব্রত দত্তর সঙ্গে দেখা হলো মেকআপ রুমে। ঢুকতেই জলদগম্ভীর কণ্ঠে ডাকলেন, ‘এসো এসো ছোটখুকি’, ডাকটা শুনে আমি অবাক হয়ে তাকাই। বললেন, ওঁদের বাড়িতে নাকি ওঁরা শাশ্বতীকে বড় খুকি আর আমাকে ছোট খুকি বলে ডাকেন। অত বড় চেহারা, অমন কণ্ঠস্বর, অথচ কথা বলার ভঙ্গীটি কি নম্র, তাতে আন্তরিকতার ছোঁয়া।
জন্মদিনের দিন, অর্থাৎ ৯ অগাস্ট উপলক্ষে আমাদের যেসব অনুষ্ঠান হত তার মধ্যে একটা মজার অনুষ্ঠান হল একবার, পঙ্কজদা তার নাম দিলেন, ‘টিভি-ভিটি’। ট্রান্সমিশন চলাকালীন অনেক সময় যেসব ভুল ভ্রান্তি হয়ে যায় যেমন, ঘোষক বা ঘোষিকার সামনে রাখা স্ট্যান্ড থেকে কাগজটা পড়ে গেল অথবা সে হয়তো ভুলে গিয়ে জিভ কাটল– এইসব অভিনয় আমাকে দিয়ে করানো হল। সংবাদ পাঠক বা পাঠিকা হয়তো সংবাদ শুরু হবার আগে চুলটা ঠিক করে নিচ্ছেন, সেই সময় ‘wrong shot punch’ হল, আরও কত রকমের উল্টোপাল্টা কাণ্ড ঘটত। এরকম আরও নানা ধরনের অঘটন নিয়ে সজয় একটা অনুষ্ঠান করেছিল নতুন বাড়িতে মানে দূরদর্শন ভবনে আসার পর, তার নাম দিয়েছিল ‘টেলি-ভীষণ’!
……………………………. পড়ুন কেয়ার অফ দূরদর্শন-এর অন্যান্য পর্ব …………………………….
পর্ব ৭: ফতুয়া ছেড়ে জামা পরতে হয়েছিল বলে খানিক বিরক্ত হয়েছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস
পর্ব ৬: ভারিক্কিভাব আনার জন্য অনন্ত দাস গোঁফ এঁকেছিলেন অল্পবয়সি দেবাশিস রায়চৌধুরীর মুখে
পর্ব ৫: দূরদর্শনে মান্য চলিত ভাষার প্রবর্তক আমরাই
পর্ব ৪: রবিশঙ্করের করা দূরদর্শনের সেই সিগনেচার টিউন আজও স্বপ্নের মধ্যে ভেসে আসে
পর্ব ৩: অডিশনের দিনই শাঁওলী মিত্রের সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছিল শাশ্বতীকে!
পর্ব ২: স্টুডিওর প্রবল আলোয় বর্ষার গান গেয়ে অন্ধকার নামিয়ে ছিলেন নীলিমা সেন
পর্ব ১: খবর পেলাম, কলকাতায় টেলিভিশন আসছে রাধা ফিল্ম স্টুডিওতে
দিদিমাকে পাওয়া যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত নাতনি আলা খুঁজে পাচ্ছে দিদিমাকে সমুদ্রের তীরে, সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। চুপ করে বসে আছে। বাচ্চা মেয়ে। সে বুঝতে পারে দিদিমা ওই ভাবে বসে বসে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে মরে গেছে!