ধেড়ে বয়সে পইতে হওয়ায় খচখচানি জন্মেছিল, কারণ জাতপাত ইত্যাদি না মানার মানসিকতার ভিত কম বয়সে তৈরি হয়ে যাওয়া। নগদ হাতে পেয়ে সে রাত্তিরে অন্তত তা উধাও! আবার ফিরে এল গণ্ডি কেটে বেরনোর দিন, প্রবলভাবে, গঙ্গাস্নান করে ফেরার পথে। সূর্য ওঠার একটু পরেই। হাতে টানা রিকশায় বিডন স্ট্রিট উজিয়ে ফিরছি, অন্তত চার থেকে পাঁচবার রিকশা থামিয়ে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা মাথায় হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন।
মার কোলে বসার বয়স পেরিয়েছে অনেক দিন, তবু বসে আছি কারণ পুরোহিত মশাইয়ের বিধান। হোম হবে, অন্যান্য উপাচার– দ্বিজ। লটারি জাতীয় প্রক্রিয়ায় একটি অক্ষর বাছা হবে। সেই অক্ষর দিয়ে শুরু হবে আমার নতুন নাম, যা মা-বাবা-আমি আর পুরোহিত মশাই ছাড়া আর কেউ জানবেন না। এরপর আসল মজা, অর্থাৎ গায়ে হলুদ, মস্তক মুণ্ডন, পবিত্র সুতো পরানো ইত্যাদি। পুজো শুরু হয়েছে, হঠাৎ কী একটা অংবংচং হিসেব কষে গলা খাঁকারি দিয়ে পুরোহিতমশাই বললেন, ‘ইয়ে মানে, বয়স একটু বেশি দেখাচ্ছে, প্রায়শ্চিত্ত করে নিলে ভাল হয়’। কর প্রায়শ্চিত্ত! এই ধরনের চাপের সময় বাঙালি জেগে ওঠে। কেউ একজন দৌড়ে গিয়ে বড় রাস্তার উল্টোদিকে অবস্থিত খাটাল থেকে একেবারে ফার্ম ফ্রেশ গোময় ও গোমূত্র নিয়ে এল। সূর্য ওঠার আগে দধিকর্মা জাতীয় কী একটা খেয়েছি, তারপরে এই টাকনা। প্রতিবাদের ভাষা তখনও জন্মায়নি, তার ওপর একটা লোভও জন্মেছে মনে। খাওয়াদাওয়া হবে, অনেক আত্মীয়, পাড়া-প্রতিবেশী আমন্ত্রিত। কিছু আমদানি হবে, ক্যাশ এবং ঘড়ি, বই ইত্যাদি। সেই আশায় যা বলা হচ্ছে, করে যাচ্ছি। মাথা ন্যাড়া করে গেরুয়া পরিয়ে হাতে লাঠি ধরিয়ে দিল, আর গলা থেকে কোমর অবধি একগাছা সুতো। ফটাফট ছবি উঠল। ওদিকে পুরোহিতের সঙ্গে জোরদার নেগোশিয়েশন চলছে মা-বাবার। তিন রাত্রি বন্ধ ঘরে থাকতে পারবে না, এক রাতে সেরে ফেলুন, মার হাতে রাঁধা মাছ-মাংস খাওয়ার অনুমতি দিন সাত দিন পর থেকে, ইত্যাদি।
যা ধারণ করি তাই তো ধর্ম। অসাধারণ কিছু করতে গেলে মূল্য ধরে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। আমিও খুশ, পুরুতও। তবে সন্ধের জপ-তপে ছাড় পাওয়া গেল না, মিনিমাম এক বছর। আমার তাতে আপত্তি নেই, ওইরকম সময়কে এখন বলে ‘মি টাইম’। আর মেডিটেশন যদি একটু টেনে দেওয়া যায় তাহলে সন্ধের পড়াশোনারও কোনও প্রয়োজন নেই। যাই হোক, পাবলিক গান্ডেপিন্ডে খেয়ে গ্যালো। নগদ ১৭০০ টাকা পেয়েছিলাম। তখনকার দিনে অনেক বটে! কারণ পাঁঠার কিলো পঁচিশ-তিরিশের বেশি হবে না। অদ্ভুত ব্যাপার এই যে কালের নিয়মে যা স্বতঃসিদ্ধ, সেই রিস্ট ওয়াচ পাইনি। সময়ের দাম হিসেব করতে না পারার অক্ষমতাকে তাই পইতের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া যায় অনায়াসে।
ধেড়ে বয়সে পইতে হওয়ায় খচখচানি জন্মেছিল, কারণ জাতপাত ইত্যাদি না মানার মানসিকতার ভিত কম বয়সে তৈরি হয়ে যাওয়া। নগদ হাতে পেয়ে সে রাত্তিরে অন্তত তা উধাও! আবার ফিরে এল গণ্ডি কেটে বেরনোর দিন, প্রবলভাবে, গঙ্গাস্নান করে ফেরার পথে। সূর্য ওঠার একটু পরেই। হাতে টানা রিকশায় বিডন স্ট্রিট উজিয়ে ফিরছি, অন্তত চার থেকে পাঁচবার রিকশা থামিয়ে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা মাথায় হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন। একজন, মনে হয় সত্তরোর্ধ্ব ঠাকুমাসম, সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে সামনে এসে বললেন, ‘আশীর্বাদ কর বাবা’। আমিও ভয়ে ভয়ে বরাভয় দিলাম। এদিকে এই কাণ্ড দেখে রিকশাওয়ালাও ঠকাঠক কপালে হাত ঠেকাচ্ছেন। আচ্ছা এঁরা কি জানেন যে, জলে ভয় পাওয়ার জন্য আমি গঙ্গায় ডুব পর্যন্ত দিতে পারিনি? সিঁড়ির শেষ ধাপে নেমে মগে করে জল তুলে মাথায় ঢেলেছি ঠিক যেমনভাবে স্নান করি বাথরুমে? সেই যে ঘেঁটে গেল মনন, আর মন বসে না সন্ধেবেলা গায়ত্রী মন্ত্র জপ করার সময়। বরং লাইফ সায়েন্স মনে পড়ে, মাধ্যমিক ঘাড়ে চাপে। লোডশেডিং হয়ে গেলে আরও কঠিন মনকে সামলানো। গলন্ত মোমবাতির দিকে তাকালে ভেসে ওঠে এই সেদিন এক্কাদোক্কা খেলার সঙ্গী পাড়ার মেয়েটির অবয়ব। যার কানের লতিতে একবিন্দু ঘাম ঝুলে রয়েছে মুক্তোর মতো।
এইসব কঠিন সময়ে বন্ধুরাই ত্রাতা। আমার মাথায় সাদা ক্রিকেটীয় টুপি পরিয়ে তারা হগ স্ট্রিটে নিয়ে যায়। একটি বিখ্যাত দোকানে মাংসের রোল অর্ডার দেয়। আমি একটু আমতা আমতা করে জিগ্যেস করি, চিকেন খেলে চলত না? তারা বোঝায় বাড়িতে যে মাংস নিষিদ্ধ, সেটা বাইরে না খেলে প্রকৃত প্রায়শ্চিত্ত হয় না।
শুধু দই দিয়ে বিচার করলে দক্ষিণ কলকাতাকে উত্তর কলকাতা ১০ গোল দেবে! শ্যামবাজার ছাড়িয়ে সিঁথি, বরানগর, ব্যারাকপুরের দিকে যত যাওয়া যায়, সেই পথেও চমৎকার সব মিষ্টির দোকান আছে। সেখানকার রসগোল্লা মোটেই ‘স্পঞ্জ’ নয়। এবং অরিজিনাল দই তৈরি হয় সেখানে– যাকে বলে ‘পয়োধি’!