বিশেষভাবে সক্ষম, বয়সে ভারাক্রান্ত, যাদের দায়িত্ব নেওয়ার কেউ নেই, তাদের কথা স্বতন্ত্র। অনেকের আবার পরিবার প্রতিপালন করতে হয়। তাই পেটের দায়ে ভিক্ষাবৃত্তিই একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু যারা বিকল্প থাকা সত্ত্বেও সহজ পেশা হিসাবে ভিক্ষাকে বেছে নেয়, অলস ও কর্মবিমুখ, তাদের ক্ষেত্রে উপায় কী? অনেকে সক্ষম কিন্তু কাজের কথা বললেই দে দৌড়। কেউ আবার পঙ্গুত্বের ভান করে। অনেক সময় শিশু চুরি করে তাদের বিকলাঙ্গ বানিয়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামানো হয়। রাষ্ট্র, প্রশাসন সে খবর জানে না, বিশ্বাসযোগ্য নয়।
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
আদিযুগ থেকেই মানব সমাজে ভিক্ষাবৃত্তি চালু ছিল। মধ্যযুগ ও তার আগেও এই পেশার উল্লেখ মেলে। তবে সে সময় মূলত উপার্জনে অক্ষম কেউ কেউ ভিক্ষা করতেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টে গিয়েছে। কথায় বলে, ‘বসতে পেলে শুতে চায়’। হাত পেতেই যদি ক্ষুন্নিবৃত্তি হয়, তার চেয়ে সহজ উপায় আর কী-ই বা হতে পারে! তাতে যদি মিশে থাকে অসম্মানের ক্লেদ, তাতেও কুছ পরোয়া নেই। অন্তত এই দেশ, বিশ্বের অন্যত্র এক শ্রেণির মানুষের কাছে যুগ যুগ ধরে সেটাই রোজগারের সহজ পন্থা। তাই তৈরি হয়েছে সংগঠিত ভিক্ষাচক্র।
কিন্তু যাদের দারিদ্র, অসহায়তা দেখে আমজনতার মনে করুণার উদ্রেক হয়, কখনও কি তাদের প্রকৃত অবস্থা জানার চেষ্টা করেন কেউ? সেই সময়ই তো আমাদের নেই। ‘কিছু’ দিয়েই আমরা খালাস। তাই যখন শুনি মুম্বইয়ের ভরত জৈনের কথা, চমকে উঠি। কে এই ভরত জৈন? বিশ্বের সবচেয়ে ‘ধনী ভিক্ষুক’। যাঁর সম্পত্তির পরিমাণ খুব কম করেও ৮ কোটি টাকা! হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন। ৮ কোটি! যা আমরা অনেকে সারা জীবন কঠোর পরিশ্রম করেও রোজগার করতে পারব না। ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাস, আজাদ ময়দানে ভিক্ষা করা ভরতের রয়েছে কোটি টাকার বাড়ি, মুম্বই ও পুনেতে বেশ কয়েকটি দোকান। সন্তানরা পড়াশুনা করে কনভেন্ট স্কুলে। সবটাই হয়েছে ভিক্ষাবৃত্তির উপার্জনে।
কোনও বিনিয়োগ নেই, নেই কোনও ঝুঁকি। তাই অসহায় একটি অংশকে বাদ দিলে সহজসাধ্য ব্যবসায় পরিণত হয়েছে আজকের ভিক্ষাবৃত্তি। মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে ইন্দ্রা বাঈ নামে এক মহিলা সন্তানদের সঙ্গে ভিক্ষে করেন। আর সেই উপার্জনে তিনি কিনেছেন জমি, দোতলা বাড়ি, একটি মোটরসাইকেল, স্মার্টফোন এবং জমেছে ২.৫ লাখ টাকা নগদ। এসেছিলেন রাজস্থানের গ্রাম থেকে। লব-কুশ স্কোয়ার মোড়ে স্বামী-স্ত্রী ও পাঁচ সন্তান মিলে ভিক্ষা করে অনেককে দশ গোল দিয়েছেন তিনি। এরপরেই অনুসন্ধানে উঠে আসে, শুধু ইন্দোর শহরেই রয়েছে ৭০০০ ভিক্ষুক। তার মধ্যে শিশু ৩৫০০!
সাম্প্রতিক হিসেবে ভারতে ভিখারির সংখ্যা প্রায় ৪ লক্ষ ১৪ হাজার। যদিও বাস্তবে তা আরও বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। ভারতের সবচেয়ে ধনী ২৫ জন ভিখারির আয় মাসিক ৫ থেকে ২৫ লক্ষ টাকা। এবং ভিক্ষাবৃত্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিরাট অর্থনীতিও। তার বহর নাকি প্রায় হাজার কোটি টাকা! সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলার সূত্রে জানা গিয়েছে, বিভিন্ন ট্রাফিক সিগন্যালে ভিক্ষার বরাত পেতে টেন্ডারের ধাঁচে দর কষাকষি হয়। যে সিন্ডিকেট বরাত পায়, শুধু তাদেরই লোক সেখানে ভিক্ষা করতে পারবে। মুম্বইয়ে তিনটি, দিল্লিতে তিনটি, আমেদাবাদে দু’টি, কলকাতায় একটি– সব মিলিয়ে ১২টি এলাকার উল্লেখ করা হয়েছিল। এখানে ভিক্ষার বরাত পেতে নজরানার পরিমাণ ৫০ লক্ষ থেকে ১০ কোটি টাকা। সেই সূত্রেই ভিক্ষাবৃত্তিকে নিষিদ্ধ করার আর্জি জানানো হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে। কিন্তু শীর্ষ আদালত সাফ জানিয়েছে, কিছু উচ্চশ্রেণির ‘এলিটিস্ট’ মানসিকতার মানুষ এ ব্যাপারে উঠেপড়ে লেগেছেন। যেন তাদের আর কোনও কাজ নেই। মামলাও খারিজ!
……………………………………………….
মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে ইন্দ্রা বাঈ নামে এক মহিলা সন্তানদের সঙ্গে ভিক্ষে করেন। আর সেই উপার্জনে তিনি কিনেছেন জমি, দোতলা বাড়ি, একটি মোটরসাইকেল, স্মার্টফোন এবং জমেছে ২.৫ লাখ টাকা নগদ। এসেছিলেন রাজস্থানের গ্রাম থেকে। লব-কুশ স্কোয়ার মোড়ে স্বামী-স্ত্রী ও পাঁচ সন্তান মিলে ভিক্ষা করে অনেককে দশ গোল দিয়েছেন তিনি। এরপরেই অনুসন্ধানে উঠে আসে, শুধু ইন্দোর শহরেই রয়েছে ৭০০০ ভিক্ষুক। তার মধ্যে শিশু ৩৫০০!
……………………………………………….
এবারে একটু প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের দিকে চোখ ফেরানো যাক। তাদের জনসংখ্যা কমবেশি ২৩ কোটি। যার মধ্যে পেশাদার ভিক্ষুক? ৩ কোটি ৮০ লক্ষ। যাদের সারা বছরের আয় ৪২ বিলিয়ন ডলার। টাকার অঙ্কে আর না-ই বা বললাম। এমনটাই জানিয়েছে পাক সংবাদপত্র ‘দ্য ডন’। ছোট-বড় সব পাকিস্তানি শহরেই চলছে সংগঠিত ভিক্ষাবৃত্তি। শুধু তাই নয়, অন্য দেশে ভিক্ষুক রপ্তানিও করছে তারা। বিদেশে গ্রেপ্তার হওয়া ভিক্ষুকদের ৯০ শতাংশই পাক বংশোদ্ভুত। মূলত সৌদি আরব, ইরাক, ইরানে গিয়ে ভিক্ষা করে। এমন ২০০০ ভিক্ষুকের পাসপোর্ট সম্প্রতি বাতিল করেছে পাক সরকার। অথচ বিশ্বের বহু দেশেই ভিক্ষাবৃত্তি আইনত অপরাধ। তার পরেও কিন্তু সংগঠিত ভিক্ষাবৃত্তি রোধ করা যাচ্ছে না। যেমন আসন্ন বড়দিনে লন্ডনে ক্রেতাদের ভিড় বাড়বেই। আসবে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা। রোমানিয়ান ‘ফ্যাগিন’ গ্যাং ইতিমধ্যেই সংগঠিত ভিক্ষুকদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে দিনে হাজার পাউন্ডেরও বেশি আয় করার জন্য তৈরি হচ্ছে। চার্লস ডিকেন্সের অলিভার টুইস্টে যেভাবে অনাথ শিশুদের দিয়ে সংগঠিতভাবে পকেটমারি ও চুরির চক্র চালাত ফ্যাগিন, এ-ও সেরকমই। ইউরাপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে নির্দিষ্ট সময় তিন-চার মাসের জন্য তারা লন্ডনে আসে। শহরের নামকরা পর্যটন এলাকা– অক্সফোর্ড স্ট্রিট, রিজেন্ট স্ট্রিট, লিসেস্টার স্কোয়ার, পিকাডিলি সার্কাস এবং দ্য রিটজের গ্রিন পার্কে ভিড় জমায়। শুধু লন্ডন নয়, প্যারিস, ভিয়েনা বা ব্রাসেলস– সর্বত্রই এক ছবি। এই ভিক্ষুকরা একটি সুসংগঠিত ব্যবস্থার অংশ, প্রায়শই যাদের ‘ভিক্ষুক মাফিয়া’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়।
বিশেষভাবে সক্ষম, বয়সে ভারাক্রান্ত, যাদের দায়িত্ব নেওয়ার কেউ নেই, তাদের কথা স্বতন্ত্র। অনেকের আবার পরিবার প্রতিপালন করতে হয়। তাই পেটের দায়ে ভিক্ষাবৃত্তিই একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু যারা বিকল্প থাকা সত্ত্বেও সহজ পেশা হিসাবে ভিক্ষাকে বেছে নেয়, অলস ও কর্মবিমুখ, তাদের ক্ষেত্রে উপায় কী? অনেকে সক্ষম কিন্তু কাজের কথা বললেই দে দৌড়। কেউ আবার পঙ্গুত্বের ভান করে। অনেক সময় শিশু চুরি করে তাদের বিকলাঙ্গ বানিয়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামানো হয়। রাষ্ট্র, প্রশাসন সে খবর জানে না, বিশ্বাসযোগ্য নয়। কিন্তু তার প্রতিকার কোথায়? এটা ঠিকই যে, রাষ্ট্র তার নাগরিকদের জন্য অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের বন্দোবস্ত করতে পারেনি।
………………………………………………….
আরও পড়ুন অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়-এর কপি: ‘সুপার হিউম্যান’ তৈরি করতে পারে বিজ্ঞান, কিন্তু নৈতিকতা?
………………………………………………….
‘দ্য বম্বে প্রিভেনশন অফ বেগিং অ্যাক্ট, ১৯৫৯’ এদেশে চালু ছিল। কেন্দ্রীয় আইন না থাকায় অনেক রাজ্য এটাকেই গ্রহণ করেছে। যার উদ্দেশ্য, ভিক্ষুকদের বর্তমান বেআইনি জীবিকা থেকে সরিয়ে অন্য পেশায় যুক্ত করা। আইন অনুযায়ী ভিক্ষাজীবীকে এক থেকে তিন বছরের জন্য সরকার নিয়ন্ত্রিত ‘বেগারস হোম’-এ স্থানান্তর করে খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণের সুযোগ দেওয়ার কথা। কিন্তু দিল্লি হাইকোর্টও বলেছে, ভিক্ষাবৃত্তি অপরাধ নয়। আগের আইনের ১১ নম্বর ধারা বহাল রেখে বলেছে, জোর করে ভিক্ষা করতে বাধ্য করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। উচ্চ ন্যায়ালয় বলতে চেয়েছে, ভিক্ষাবৃত্তি সামাজিক ব্যাধি, অপরাধ নয়। তার প্রতিকার সেভাবেই হওয়া দরকার। কিন্তু সংগঠিত ভিক্ষাচক্র ‘না শোনে ধর্মের কাহিনি’। এ ব্যাপারে প্রশাসনও অদ্ভুতভাবে নির্বিকার।
আসলে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে আমরা প্রত্যেকেই হয়তো কমবেশি ভিখারি, কাঙাল। অর্থ-নাম-যশ-প্রতিপত্তির। কোথাও না কোথাও করুণাপ্রার্থী। তাই হয়তো ভিক্ষাবৃত্তিকে ততটা ‘অন্যায়’ বলে বোধ হয় না।
………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………