মনে হয়, তিতাসের আবহ তৈরির জন্যই বোধহয় জন্ম নিয়েছে দোতারা। এমন সুর পৃথিবীর আর কোথাও বুঝি বাজেনি কোনও দিন। এ-চলচ্চিত্রের মূল নেপথ্য গায়ক ধীরাজ উদ্দিন ফকির। কণ্ঠ নয়, যেন তিতাসের কান্না। ফকির না-হলে হয়তো গলায় ধারণ করা যায় না এই গভীরতা, এই হাহাকার। এছাড়াও গেয়েছিলেন রথীন্দ্রনাথ রায়, নীনা হামিদ, আবেদা সুলতানা, আবু তাহের, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, দীপু মমতাজ, পীলু মমতাজ। সবাই খুব অস্বাভাবিক ভাবে স্বাভাবিক। তাঁদের কণ্ঠে সুর যেন হয়ে ওঠে তিতাস-পারের দৈনন্দিন ভাষা।
নদীর নামটি একটি তিতাস– তিতাস একটি নদীর নাম। সে নদীর পাড় বেয়ে বয়ে চলে আকাশ-বাতাস-শূন্যতা বিদীর্ণ করা বিলাপগাথা। পশ্চিমে যাকে বলে ‘ল্যামেন্ট’। তিতাসের বালুচরের নিচে ইনিয়ে-বিনিয়ে বাঁশি কেঁদে চলে… কোমল করি সব আলো-আঁধারির নিঝুম অরণ্যে লুপ্ত হয়ে যাওয়ার আগে যেন একবার শেষ দেখা দেখে জলের চিকচিক মরীচিকা। গলা শুকিয়ে যাওয়া এক অমোঘ বেদনা জাগে হৃদয় খুঁড়ে।
আমার প্রিয়তম বন্ধু নির্ঝর– মানে এনামুল করিম নির্ঝরের বাড়িতে আলাপ হয়েছিল হাবিব ভাইয়ের সঙ্গে। হাবিবুর রহমান খান– ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এর অন্যতম প্রযোজক। ২৭ বছর বয়সের এক তরুণ, স্বপ্ন দেখেছিল ঋত্বিক ঘটককে দিয়ে এই ছবিটি করবেন। ঠিক দু’বছর আগে যে-তরুণ যুক্ত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীন দেশে, অবিভক্ত বাংলা নিয়ে তাঁর খাঁটি ভালোবাসা ঋত্বিক বুঝেছিলেন। এই একই ভালোবাসা যে তাঁকেও টেনে রেখেছে আজন্ম। একদিন একটু দুষ্টুমি করে বলেই ফেলেছিলেন, ‘আমাকে দিয়ে ছবি করাও… আমি কিন্তু ছবি করতে করতে অনেক সময় পালিয়ে যাই… শেষ হয় না ছবি! ঘোড়াকে নদীর কাছে নিয়ে আসতে পারো, তো সেই ঘোড়া যদি জল না খায়,’ উত্তরে সে তরুণ বলেছিলেন, ‘যে ঘোড়া আমায় স্বপ্ন দেখাতে পারে না আর, আমায় সোয়ারি করে না, তাকে আমি জানি কী করে গুলি করে মেরে ফেলতে হয়।’ ঋত্বিক হেসেছিলেন! এখনও তিতাসের কথা বললে ৮০ বছরের হাবিবের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। হাবিব ভাই আমাদের খুব প্রিয় মানুষ। ভাগ্যিস এরকম দু’-একটা মানুষ এ পৃথিবীতে থেকে যান। ভাগ্যিস ঋত্বিকের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়।
বাংলা ভাগের আজীবন যন্ত্রণা-পুরুষের নিরানব্বইতম জন্মদিন আজ। বাংলার মাঠ-ঘাট, নদী-নালা, ফুটপাথে বাংলা ও তার ভাষা-সংস্কৃতিকে মুঠো-ভরে হেঁটে-যাওয়া ছ’ফুটের এক বিশাল ছায়ার জন্মদিন। ছিন্নমূল বাস্তুহারাদের জীবনের চলচ্চিত্রায়নের জন্মদিন। ঋত্বিক কুমার ঘটকের নিরানব্বইতম জন্মদিন। যাঁর মনন থেকে জন্ম পেয়েছে প্রান্তিক জীবনের কালজয়ী সব চলমান দলিল। জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে নিজের নামের সঙ্গে একাত্ম করে দিয়েছেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। তিতাসকে অমর করে দিয়েছেন ঋত্বিক তাঁর খরস্রোতা সত্যির সৃষ্টিশীল চোখে।
জানি না, জানি না, জানি না। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ চলচ্চিত্রে অসহায় রাজারঝির কাছে বাসন্তী জানতে চায় তার স্বামীর নাম, ঠিকানা এবং সে দেখতে কেমন। শূন্য দৃষ্টির রাজারঝি জানায়– সে কিছুই জানে না। এই চলচ্চিত্র নির্মাণ আমাকেও বলতে বাধ্য করায় ‘জানি না, জানি না, জানি না’। কীভাবে চলচ্চিত্র এমন জীবনের ছবি আঁকতে পারে– জানি না। কীভাবে সংগীত এভাবে জীবনের কান্না-হাসি ধরতে পারে– জানি না। এমন চলচ্চিত্র হয়তো করা যায় না, তারা ‘হয়ে ওঠে’। যদি সেই নির্মাণের নেপথ্যে ঋত্বিক ঘটকের মতো মাটির সন্তান থাকেন, তবেই মাটির এইসব কথা জীবন্ত হয়ে ওঠে।
অদ্বৈত মল্লবর্মণের এই কালজয়ী উপন্যাসের প্রথম পাণ্ডুলিপি হারিয়ে যায়। ঠিক যেমন তিতাসের জল হারিয়ে যায়। তিতাসের জল আর ফিরে আসেনি। কিন্তু অদ্বৈত মল্লবর্মণ তাঁর এই উপন্যাসকে আবার লিখেছিলেন। ভাগ্যিস লিখেছিলেন। শোনা যায়, ঋত্বিক এই চলচ্চিত্রের প্রযোজককে বলেছিলেন, ‘তুমি মরে গেলেও কিছু হবে না, আমি মরে গেলেও কিছু হবে না। এই ছবিটা না-হলে সভ্যতার ক্ষতি হয়ে যাবে।’ সভ্যতা ভাগ্যবান, সেই ক্ষতি তাকে সইতে হয়নি। তিতাসের বাতাসে বইতে থাকা মাটি-জলের কথা আমরা জানার সুযোগ পেয়েছি।
উপন্যাস এবং এই চলচ্চিত্র নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। বলা ভালো, সেই ধৃষ্টতাও নেই। তবে আমরা, যারা সংগীতের শিক্ষানবিশ, তাদের প্রতিদিন নতুন করে ভাবায় এই চলচ্চিত্রের সংগীত ও তার প্রয়োগ। ঋত্বিক কুমার ঘটক এবং উস্তাদ বাহাদুর হোসেন খানের সাংগীতিক যুগলবন্দি এই চলচ্চিত্রকে করে তুলেছে তিতাস পাড়ের জীবন্ত চালচিত্র। ঋত্বিকের প্রতিটি নির্মাণেই সংগীতের যে গুরুত্ব থাকে, এ-চলচ্চিত্র তার ব্যতিক্রম নয়। আসলে ঋত্বিকের মতো কিছু মনন থাকে, যাঁরা সৃষ্টির জগতে নিজেরাই বিশাল ব্যতিক্রম। সংগীতের তাই যেন সংলাপ হয়ে ওঠে তাঁদের হাত ধরে। নদী হয়ে ওঠে নায়ক। সুর হয়ে ওঠে কান্না-হাসির ভাষা। আমরা ভাসতে থাকি সেই অমোঘ আকর্ষণে। তিতাসের বিলাপগাথা নদীর মতো ইনিয়ে-বিনিয়ে ছুটতে থাকে আমার মনে। তিতাস শুকিয়ে যায়, কান্নারা শুকায় না, সুর শুকায় না। বহুদূর পর্যন্ত তার রেশ থেকে যায় জীবনে। কিছুতেই পিছু ছাড়ে না। ঠিক যেমন করে ঋত্বিকের পিছু ছাড়ে না কোমল গান্ধার। গান্ধারের কোমলে মিশে যায় মাটির সোঁদা গন্ধ, জলের ছলাৎছল। সুর টলমল করে জীবনের রোজনামচায়। বিষণ্ণতার ঘোরে আছন্ন হয়ে থাকে মন।
আকাশের গভীর রাত্রি শূন্যে সেঁটে থাকা এক লালছবি, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। অদ্বৈত মল্লবর্মণের এই মহাকাব্য যখন ঋত্বিক ঘটকের হাত ধরে পর্দায় রূপ পেল, যেন সমস্ত চরাচর একটি দীর্ঘ, বিষণ্ণ ঢেউয়ে মিশে গেল। সরোদের সুরে খানিকটা বিষণ্ণতা, আবার সেই মেজর থেকে মাইনরে বাঁশির কান্না যেন ভোরের প্রথম আলোয় এক অজানা কাঁপুনির জন্ম দিল।
ঋত্বিকের দীর্ঘদিনের সঙ্গী ও দুর্লভ প্রতিভা সংগীতকার উস্তাদ বাহাদুর হোসেন খান এই চলচ্চিত্রের সম্পদ। উস্তাদের মাইহার ঘরানার সরোদ যখন ঝমঝম করে বেজে ওঠে, মনে হয় এ-এক অন্য পৃথিবী। মনে হয়, তিতাসের আবহ তৈরির জন্যই বোধহয় জন্ম নিয়েছে দোতারা। এমন সুর পৃথিবীর আর কোথাও বুঝি বাজেনি কোনও দিন। এ-চলচ্চিত্রের মূল নেপথ্য গায়ক ধীরাজ উদ্দিন ফকির। কণ্ঠ নয়, যেন তিতাসের কান্না। ফকির না-হলে হয়তো গলায় ধারণ করা যায় না এই গভীরতা, এই হাহাকার। এ-ছাড়াও গেয়েছিলেন রথীন্দ্রনাথ রায়, নীনা হামিদ, আবেদা সুলতানা, আবু তাহের, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, দীপু মমতাজ, পীলু মমতাজ। সবাই খুব অস্বাভাবিক ভাবে স্বাভাবিক। তাঁদের কণ্ঠে সুর যেন হয়ে ওঠে তিতাস-পারের দৈনন্দিন ভাষা।
অদ্ভুত এক সংগীতে ছেয়ে যায় পর্দা, বেজে ওঠে ‘লীলাবালী’– একটি গান, যা কেবল পূর্ববাংলার নদীর তীরে ভাসমান নয়, যেন সমস্ত গ্রামীণ জীবনের এক আদি স্পন্দন। কিশোরের বিয়ের পর ভেসে ওঠে স্ত্রীর মুখে আচারের সেই তীব্র গান, যেন অর্কেস্ট্রা টাইটেল ক্রেডিটে নিজস্ব শব্দে ঝড় তুলেছে। তার ঠিক পিছনেই, আলাউদ্দিন লিটল অর্কেস্ট্রার মৃদু বাজনার তলায়, এক অমোঘ কোরাসে ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে পড়ে লীলাবালী।
চির বিদায়ের আগে কিশোরের চোখে যেন এক বর্ণহীন স্বপ্ন ভাসে, তার প্রিয় মুখটি আশার আলোয় চিকচিক করে, সেই মুহূর্তেই ‘লীলাবালী’ গানের শেষ লয়ের সুর যেন স্নিগ্ধতায় মিলিয়ে যায়। হঠাৎই সমস্ত জলরাশি মুখ থুবড়ে পড়ে। তিতাসের জলে সেই স্বপ্নও যেন ডুবে যায়, আর কোনও এক বাসন্তীর ছায়ায় চঞ্চলতার ছাপ রেখে ফুরিয়ে যায় মুহূর্তের জন্য।
মালোপাড়ার বুকে বাজে কীর্তনের স্পন্দন, তীব্র লোকসংগীতের চলন। সেখানে শহর থেকে আসা যাত্রাদলের দাপটে লোকগানের ভুবন কোণঠাসা হয়ে পড়ে। আর বাসন্তী যেন তাদের সমগ্র পরাজয়ের প্রতীক হয়ে ওঠে। তখন সেই সপাং সপাং আওয়াজে নৌকা বাইচের ধাক্কায় ঝড়ের মতো ভাসতে ভাসতে ফিরে আসে শূন্যতায়।
মেঘে ঢাকা সেই রাতের আকাশে ঝিলমিলের মতো ভেসে ওঠে ‘কোমল গান্ধার’ থেকে চেনা একটি গানের সুর। ঘুমপাড়ানি সুরে মায়ের কণ্ঠ যেন তিতাসের ঢেউয়ে মিশে যায়। আর সেই সুরে ভেসে ওঠে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’– একটি নদী, যার শরীর জুড়ে শুধুই জল, অথচ তার আকাশে দোলা লাগে ইতিহাসের প্রতিটি স্পন্দনে।
একটি অনন্ত যাত্রায় মিলিয়ে যায় তিতাস, যেন নিজেকে প্রতিধ্বনিত করতে করতে হারিয়ে ফেলে অস্তিত্বের অন্তরালে। নদীর প্রতিটি ঢেউয়ে বাসন্তীর হৃদয়ে ঝড় ওঠে, কিশোরের মৃতপ্রায় চোখে ভাসে বিস্মৃতির ছায়াপথ। সরোদের টান আর বাঁশির কান্নায় বাঁধা থাকে সেই অকথিত ব্যথা, যা কিনা অতলস্পর্শী জলধারায় বহমান।
বাসন্তীর একাকিত্বে এসে মিশে যায় নদীর আদিগন্ত ঢেউ, কীর্তনের সুরে উচ্ছ্বাসিত হয়ে ওঠে প্রতিটি ঢেউ। নদীর বুকে প্রতিধ্বনিত হয় গ্রামীণ জীবনের পুরাণ, যেখানে প্রতিটি ধ্বনি যেন ছুঁয়ে যায় এক মহাজাগতিক ব্যথার স্বরলিপি। এই প্রতিচ্ছায়া এক গভীর, মায়াময় স্মৃতিমেদুরতার মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠে, যার চেহারায় একেকটি চরিত্র যেন দোলা খায় বিস্ময় আর অসীমতায়।
তিতাস শুধুই কি একটি নদীর নাম?
এই প্রশ্নে আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে মন। তিতাস কি ভালোবাসার নাম নয়? তিতাস কি সারল্যের নাম নয়? জীবনের বাঁকের নাম কি তিতাস? প্রতিবাদের নাম কি তিতাস? হারিয়া যাওয়া গ্রাম্য ঐক্যের নাম কি তিতাস নয়? এই চলচ্চিত্র ও তার জীবন্ত সংগীত এই প্রশ্নগুলোকেই করে দিয়েছে মনের সঙ্গী।
…………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………….