‘বঙ্গদর্শনে’র মতো একটি উচ্চমানের মাসিক পত্রিকা সচল থাকা অবস্থাতেই হঠাৎ সঞ্জীবচন্দ্র আর একখানি পত্রিকা প্রকাশ করলেন কেন? বঙ্কিমচন্দ্র ‘বঙ্গদর্শন’ সম্পাদনা করেছেন চার বছর, এর পরের ছ’বছর সঞ্জীবচন্দ্রই পত্রিকাটির সম্পাদক হয়েছিলেন। তাহলে ‘ভ্রমরে’র কি প্রয়োজন ছিল? কোথাও কি টেক্কা দেওয়ার ব্যাপার ছিল,নাকি নিজস্বতা দেখানোর অভিপ্রায় এই ভ্রমরের আত্মপ্রকাশ নাকি সুপ্ত কোনও ভ্রাতৃ-অভিমান?
প্রচ্ছদ দীপঙ্কর ভৌমিক
ঘরেতে ভ্রমর এলে আমরা মারতে বা তাড়াতে উদ্যোগী হই। নয়তো গুনগুন করে গেয়ে উঠি ঘরেতে ‘ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে’। সব ভ্রমর কি গুনগুন করে গুণাগুণ বিচার করে আসে! অথবা যে ভ্রমরের আয়ু স্বল্পকাল সেই ভ্রমরকে স্মৃতির ডালায় ক’জন সাজিয়ে রাখি?
এই ভ্রমর বাংলা সাহিত্যের বারান্দায় এসেছিল ১৫০ বছর আগে। ভণিতা না করে ব্যাপারটা একটু ঝেড়ে কাশি। ‘ভ্রমর’ নামে একটি মাসিক পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১২৮১ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে,অর্থাৎ ইংরাজি ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে। পত্রিকাটি প্রশ্বাস নিয়েছিল মাত্র এক বছর তিন মাস। ১৫টি সংখ্যা প্রকাশ করেই শিশু ‘ভ্রমর’এর গুঞ্জন স্তব্ধ হয়ে যায়। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ সহোদর সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সাহিত্য এবং সিলেবাসের জগতে তিনি উজ্জ্বল ‘পালামৌ’ ভ্রমণসাহিত্যের রচয়িতা হিসেবে।
একটা প্ৰশ্ন কিন্তু ভ্রমরের মতো ঘুরেই যায়, সর্বজনবিদিত বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পাদনায় ‘বঙ্গদর্শন’ বেরিয়েছিল ১২৭৯-এর বৈশাখ মাসে। এর ঠিক দু’বছর পর ‘ভ্রমরে’র আত্মপ্রকাশ। ‘বঙ্গদর্শনে’র মতো একটি উচ্চমানের মাসিক পত্রিকা সচল থাকা অবস্থাতেই হঠাৎ সঞ্জীবচন্দ্র আর একখানি পত্রিকা প্রকাশ করলেন কেন? বঙ্কিমচন্দ্র ‘বঙ্গদর্শন’ সম্পাদনা করেছেন চার বছর, এর পরের ছ’বছর সঞ্জীবচন্দ্রই পত্রিকাটির সম্পাদক হয়েছিলেন। তাহলে ‘ভ্রমরে’র কি প্রয়োজন ছিল? কোথাও কি টেক্কা দেওয়ার ব্যাপার ছিল,নাকি নিজস্বতা দেখানোর অভিপ্রায় এই ভ্রমরের আত্মপ্রকাশ নাকি সুপ্ত কোনও ভ্রাতৃ-অভিমান? বঙ্কিমচন্দ্র কিন্তু তাঁর দাদা সঞ্জীবচন্দ্র সম্বন্ধে লিখেছেন, ‘পত্রখানি অতি উৎকৃষ্ট হইয়াছিল। এখন আবার তাঁহার তেজস্বিনী প্রতিভা পুনরুদ্দীপ্ত হইয়া উঠিল। প্রায় তিনি একাই ভ্রমরের সমস্ত প্রবন্ধ লিখিতেন।’
তাহলে তো কোনও বিতর্কের গন্ধ নেই। আসল ইতিহাসটা এইরকম সঞ্জীবচন্দ্র যখন বর্ধমানে কর্মরত সেই সময় বঙ্কিমচন্দ্র বঙ্গদর্শন পত্রিকার সূচনা করলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের আকর্ষণেই সঞ্জীবচন্দ্রও কলম ধরলেন। ব্যক্তি জীবনের মজলিশি মেজাজটি উজাড় করে দিতে তিনি কার্পণ্য করলেন না। বঙ্কিমচন্দ্র বঙ্গদর্শন সম্পাদনা করলেন চার বছর। এই সময় সঞ্জীবচন্দ্রের জীবনে সাহিত্যিক সঙ্গ যথেষ্ট পরিমাণে হলেও নিজস্ব সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে কম। তবে লেখার প্রস্তুতিপর্ব এই সময় বেশ ভালোভাবেই সাধিত হয়েছিল সেটা তাঁর রচনাগুলির দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। ১২৭৯-১২৮০ সাল, এই দু’-বছরে তিনি একটা মাত্র প্রবন্ধ লিখেছিলেন, তাঁর নাম ‘যাত্রা’, বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ১২৭৯ ও ‘৮০ সালের দু’টি সংখ্যায় দু’টি কিস্তিতে প্রকাশিত হয়েছিল। রচনাটির মধ্যে তাঁর ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হলেও বাংলা সাহিত্য জগতে তা বিন্দুমাত্র সাড়া জাগায়নি। তিনি তখনও পর্যন্ত সাহিত্য ব্যবসায়ী হবেন কি না, তার কোনও প্রতিশ্রুতি ছিল না। তিনি শুধু বঙ্গদর্শন পত্রিকার কাজকর্মের তত্ত্বাবধান করেন মাত্র। এই রকম সময় বঙ্কিমচন্দ্র তাঁকে বঙ্গদর্শনের সঙ্গে আর একটি ছোট পত্রিকা প্রকাশ করতে পরামর্শ দিলেন। এতদিনে সঞ্জীবচন্দ্র যেন মনের মতো একটি কাজ পেলেন। বঙ্কিমচন্দ্র এই সময়কার একটি বর্ণনা দিয়েছেন, ‘১২৭৯ সালের ১লা বৈশাখ আমি বঙ্গদর্শন সৃষ্টি করিলাম। ঐ বৎসর ভবানীপুরে উহা মুদ্রিত ও প্রকাশিত হইতে লাগিল, কিন্তু ইত্যবসরে সঞ্জীবচন্দ্র কাঁটালপাড়ার বাড়ীতে একটি ছাপাখানা স্থাপিত করিলেন। নাম দিলেন বঙ্গদর্শন প্রেস। তাঁহার অনুরোধে আমি বঙ্গদর্শন ভবানীপুর হইতে উঠাইয়া আনিলাম। বঙ্গদর্শন প্রেসে বঙ্গদর্শনের ছাপা হইতে লাগিল। সঞ্জীবচন্দ্রও বঙ্গদর্শনে দুই একটা প্রবন্ধ লিখিলেন, তখন আমি পরামর্শ স্থির করিলাম যে, আর একখানা ক্ষুদ্রতর মাসিকপত্র বঙ্গদর্শনের সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশিত হওয়া ভাল। যাহারা বঙ্গদর্শনের মূল্য দিতে পারে না, অথবা বঙ্গদর্শন যাহাদের পক্ষে কঠিন, তাহাদের উপযোগী একখানি মাসিক পত্র প্রচার বাঞ্ছনীয় বিবেচনায়, তাঁহাকে অনুরোধ করিলাম যে তাদৃশ কোন পত্রের স্বত্ব ও সম্পাদনা তিনি গ্রহণ করেন। সেই পরামার্শনুসারে তিনি ভ্রমর নামে মাসিক পত্র প্রকাশিত করিতে লাগিলেন।’
১২৮১-র জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা ‘বঙ্গদর্শন’-এ একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ হয়। ‘ভ্রমর’ শিরোনামে এই বিজ্ঞাপনটি ছিল এইরকম, ‘ভ্রমর নামে একখানি অভিনব মাসিক পত্র বঙ্গদর্শন কার্য্যালয় হইতে বৈশাখ অবধি প্রকাশিত হইতেছে।
যাহা যাহা সুখপাঠ্য এবং যাহাতে বিশুদ্ধ আমোদ ও সুশিক্ষা একত্রে মিলিত করা যায়, তাহাই এই পত্রের উদ্দেশ্য। উপন্যাস, পদ্য, কৌতুকাবহ বৈজ্ঞানিকতত্ত্ব, দেশীয় সামাজিক কথা, ইত্যাদি বিষয় এই সামাজিক পত্রে লিখিত হইবে। যাহাতে কৃতবিদ্য এবং অল্পজ্ঞান উভয় শ্রেণীর লোকের মনোরঞ্জন হয় এমত যত্ন করা যাইবে।’
ঠিক এই বিন্দু থেকেই ভ্রমর হয়ে উঠল আলাদা। ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা উচ্চমানের, কিন্তু অল্পজ্ঞান লোকেদের জন্য পত্রিকা কোথায়? তাই কি ভ্রমরের আগমন দরকার ছিল। ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার মূল্য ছিল সডাক তিন টাকা ছ’আনা এবং ‘ভ্রমরে’র ছিল দু’টাকা। সেজন্যই বিজ্ঞাপনে লেখা হয়েছিল যে একত্রে নিলে পাঁচ টাকায় দু’টি পত্রই পাওয়া যাবে। প্যাকেজ নিয়ে কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
‘ভ্রমর’-এর বিভিন্ন রচনায় লেখকের নাম কখনও কখনও প্রকাশিত হয়েছে। অবশ্য প্রবন্ধ তো প্রায় সবই সঞ্জীবচন্দ্রের একথা বঙ্কিমচন্দ্রই জানিয়েছেন। পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যা ছিল ২৪ পৃষ্ঠার। প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল, ‘ভ্রমর’, ‘রামেশ্বরের অদৃষ্ট’, ‘নিদ্রা’, ‘জলে ফুল’ (কবিতা) এবং ‘স্ত্রীজাতি বন্দনা’। ‘রামেশ্বরের অদৃষ্ট’ একুশ পৃষ্ঠাব্যাপী উপন্যাসটি প্রথম সংখ্যাতেই শেষ হয়েছে। এটি বাদে পত্রিকায় আর একটি মাত্র উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে, সেটির নাম ‘কন্ঠমালা’। প্রথম সংখ্যা থেকে শুরু করে দশম সংখ্যা অবধি ধারাবাহিক ভাবে বেরিয়েছে এটি। পদ্য ছিল মোট সাতটি। পদ্য রচয়িতাদের কয়েকজনের নাম রয়েছে। এঁরা হলেন– জ্যোতিশ্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রাজকৃষ্ণ মিশ্র, প্রবোধ চন্দ্র ঘোষ ও গোপালচন্দ্র ঘোষ। কবিতা বাদ দিয়ে অন্যান্য রচনায় দু’জন লেখকের নাম রয়েছে– লালমোহন শর্ম্মা এবং শ্রীঃ। এই কবিদের কবিতা বাংলা সাহিত্য তো মনেই রাখেনি।
‘বঙ্গদর্শন’-এর আলোয় ‘ভ্রমর’ কিন্তু কোনওভাবেই নিষ্প্রভ ছিল না। তাই দ্বিতীয় বর্ষের শুরুতেই সম্পাদক সঞ্জীবচন্দ্র ‘ভ্রমরের আত্মকথা’ শিরোনামে পত্রিকা সম্বন্ধে লিখেছেন, “ভ্রমরের বয়ঃক্রম এক বৎসর পরিপূর্ণ হইল। এই অল্পকাল মধ্যে ভ্রমর যেরূপ আদরিত হইয়াছে তাহা আমরা প্রত্যাশা করি নাই। ভ্রমর অতি নম্রভাবে জন্মগ্রহণ করিয়াছিল; জন্মবার্ত্তা কোন সংবাদ পত্রে পাঠান হয় নাই, কুলা বাজাইতে কাহাকেও ডাকা হয় নাই; অথচ বাঙ্গালার পদ্মমাত্রেই ভ্রমরের বার্ত্তা পাইয়াছেন। এক্ষণে যেখানে পদ্ম সেই খানেই ভ্রমর। যে গৃহে ভ্রমর যায় না আমরা শুনিয়াছি যে গৃহে পদ্ম নাই কেবল শিমুল শর্ম্মারা বাস করেন।
অল্পকালমধ্যে ভ্রমর চট্টগ্রাম হইতে কাশ্মীর পর্য্যন্ত ভ্রমণ করিতে সক্ষম হইয়াছে, ইহাতেই বোধ হইবে ভ্রমর নিতান্ত দুর্ব্বল নহে।
ভ্রমরের গ্রাহক অনেক বাড়িয়াছে, নিত্য বাড়িতেছে; কিন্তু ভ্রমরের কলেবর বাড়িল না কেন, এই কথা জনৈক মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী জিজ্ঞাসা করিয়াছেন। আমরা প্রত্যুত্তরে বলি, বয়স বাড়িলে কলেবর বাড়িবে।“
সত্যি ভ্রমরের বয়স বাড়ল আর কলেবর বাড়ল না। এই আত্মকথা প্রকাশ হওয়ার পরেই মাত্র দু’মাস পরে আষাঢ় মাসে পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেল। যে পত্রিকা জন্ম দিতে পারত বহু প্রতিভার সেই পত্রিকা অচিরেই কেন বন্ধ হয়ে গেল, এ নিয়ে প্ৰশ্ন অন্তহীন। তাই হয়তো নীরবেই তাকে পেরিয়ে যেতে হয় দেড়শো বছর।
বিশ্ব ক্রীড়াক্ষেত্র যে বাঁকে দাঁড়িয়ে, তাতে ভবিষ্যতের সাক্ষী মালিক, মনিকা বাত্রা, লক্ষ্য সেনদের বিকল্প পথের কথা ভাবতে শুরু করতে হবে। কমনওয়েলথ গেমসকে ভুলে অলিম্পিক, এশিয়াডের প্রস্তুতি হিসেবে পাখির চোখ করতে হবে নিজ খেলার আঞ্চলিক, মহাদেশীয় ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপগুলোকে।