যথাসময়ে সঠিক কাজটা করতে জানা চাই– তারই ওপর মানুষের জীবনের সাফল্য বা প্রতিষ্ঠা নির্ভর করছে। এই যুবকটি তাই যথাসময়ে সাহিত্যচর্চা বা কবিতা লেখার বাতিক, এমনকী বিজ্ঞানচর্চার পালা পর্যন্ত চুকিয়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত একজন সফল ব্যবসায়ী রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল। অবশ্য এটাও ঠিক যে, ওগুলিও ছিল প্রকারান্তরে তার উন্নতির পথের একেকটি সোপান– যোগাযোগের একেকটি ক্ষেত্র। পথযাত্রার সূচনা হয়েছিল সমাজতন্ত্র দিয়ে, শেষকালে পুঁজিতন্ত্রে এসে সিদ্ধিলাভ হল। এমনকী নিজের প্রতিষ্ঠান সঙ্গে সঙ্গে নিকট আত্মীয় স্বজনকেও সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নে লেখাপড়া শিখিয়ে পুঁজির দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করে গেছে। আমাদের বন্ধুটি নিজেও অবশ্য এর ব্যতিক্রম ছিল না।
৩৯.
যারা হাওয়া বুঝেছিল
শিক্ষার্থী হয়ে তারা এসেছিল, হয়তো সমাজব্যবস্থা পাল্টানোর কথাও তাদের কারও-কারও মাথায় ছিল, কিন্তু চালাক চতুর হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে হাওয়া বুঝে এক সময় তারা নিজেরাই পাল্টে গেল। তাদেরই একজন ছিল আমাদের সেই সাংবাদিক বন্ধুটি।
১৯৮০-র মস্কো অলিম্পিকসের প্রস্তুতি দেখে ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক বিবরণী লেখার বরাত নিয়ে ১৯৭৯-এ মস্কোয় এসেছিলেন কলকাতার সাংবাদিক চিরঞ্জীব (চিত্ত বিশ্বাস)। সেই সময় আমি ও সাংবাদিকতার ডিগ্রিধারী আমার সেই বন্ধুটি– দুই বঙ্গসন্তান মস্কোর পিকিং হোটেলে তার সঙ্গে দেখা করতে যাই। চিরঞ্জীব মোট তিন সপ্তাহ সোভিয়েত ইউনিয়নে থেকে তালিন, রিগা, কিয়ের, লেনিনগ্রাদ ঘুরে অলিম্পিক্সের প্রস্তুতি দেখার পর অলিম্পক্স শুরু হওয়ার আগেই ‘দেশ’ পত্রিকায় মোট ১৫টি কিস্তিতে তাঁর ধারাবাহিক বিবরণী প্রকাশ করেন। সেই সূত্রে তাঁর সঙ্গে আমাদের আলাপ, পরবর্তীকালে আমার বন্ধুর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা: দু’জনেই তো সাংবাদিক– একজন পেশায়, অন্যজন ডিগ্রিতে। এরপরও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ক্রীড়ানুষ্ঠান উপলক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নে চিত্ত বিশ্বাসের যাতায়াত ছিল। ইতিমধ্যে অবশ্য তিনি ‘আনন্দবাজার’ ছেড়ে অন্য একটি সংবাদপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত ক্রীড়াপত্রিকার সম্পাদক পদে যোগ দিয়েছেন। তাঁরই সুবাদে তাঁর মস্কোর ‘জার্নালিস্ট’ বন্ধুটি পত্রিকার মস্কোস্থ সংবাদদাতা পদে নিযুক্ত হল; যথারীতি সরকারি স্বীকৃতি পেতেও বিলম্ব হল না। পদটা অনারারি, কিন্তু তাহলেও লাভজনক। এখন সে দস্তুরমতো সাংবাদিক, যদিও লেখালিখি তার ধাতে নেই। কিন্তু এরই দৌলতে সে মস্কোর দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে বেশ বড়সড় একটা অফিসঘর ভাড়া নিয়ে বসল– সংবাদসংস্থার অফিস ঘর বলে ভাড়াটাও তুলনায় কম, বাণিজ্যসংস্থার জন্য হলে বেশ কয়েকগুণ বেশি ভাড়া দিতে হত। অফিসে Telex, পরবর্তীকালে Fax ইত্যাদি বসল, আরও পরবর্তীকালে কম্পিউটারও এল। এই সময় বন্ধুর যোগাযোগের পরিধি যেন আরও বেড়ে গিয়েছিল, পরন্তু ততদিনে দেশের অর্থনীতিতে উদারীকরণও শুরু হয়ে গেছে। অতএব সোনায় সোহাগা। উৎসাহিত হয়ে সে তার আরও দুই বন্ধুর সঙ্গে মিলে (তারাও ভারতীয়-বাঙালি, পড়াশুনার সূত্রেই মস্কোয় ছিল) এই পত্রিকার অফিস ঘরেই এক বাণিজ্যসংস্থা খুলে বসল।
প্রথমে ছিল মূলত ওষুধের কারবার, ইতিমধ্যে আমাদের দেশের কয়েকটা ঔষধ প্রস্তুতকারী সংস্থার সঙ্গে সে যোগাযোগও করে ফেলেছিল। তখনও সে ধরনের কেনাবেচা ওদেশের সরকারি সংস্থার সঙ্গেই চলত– প্রাইভেট বাণিজ্যসংস্থা ওদেশে তখনও শুরু হয়নি, সেটা হয়েছিল পেরেস্ত্রৈকার আমলে। অর্থাৎ ক্রেতা বলতে ছিল সে দেশের সরকার, অতএব সরকারি আমলাদের ভজাতে পারলেই হল– সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত। চাহিদা ও সরবরাহের তত্ত্ব এখানে চলত না; মাল একবার সরকারি গুদামে ঢোকাতে পারলেই হল, সেখানে পচুক বা নষ্ট হোক তা নিয়ে কারও কোনও মাথাব্যথা ছিল না। বন্ধুবরের যোগাযোগ আর তার দুই অংশীদারের নিরলস পরিশ্রমের ফল ফলতে দেরি হল না। পেরেস্ত্রৈকার আমলে ক্ষেত্র আরও সম্প্রসারিত হল। ততদিনে রুশিরাও ব্যক্তিগত উদ্যোগে ব্যাপক হারে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে দিয়েছে। এক সরকারি অর্ডারই যা হত তা কম নয়, তার ওপর প্রাইভেট ব্যবসা। বাজার জমজমাট। ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে বড়জোর দু’-একটি লেখা কারও সুবাদে তার নামে বেরিয়েছিল। কিন্তু সেই সূত্রেই সে বছরের পর বছর ওদেশে জার্নালিস্ট হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি পেয়ে যেতে লাগল– এমনকী, সেই পত্রিকা উঠে যাওয়ার পরও। তার হাতে ছিল পত্রিকার ছাপানো ‘লেটার হেড’ আর ‘রাবার স্ট্যাম্প’। ওতেই কেমন করে যেন কাজ হাসিল হয়ে যাচ্ছিল।
‘রাদুগা’ উঠে যাওয়ার পর পেরেস্ত্রৈকার পরবর্তী যে কয়েক বছর আমি মস্কোতে ছিলাম, সেই সময় অবশ্য তারই সাহায্য আমাকে নিতে হয়েছিল। আমি তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের অফিসে বসতাম, যে সমস্ত সম্ভাব্য গ্রাহক অফিসে আসত, তাদের জন্য চা তৈরি করে পরিবেশনও করতাম। বিনিময়ে দেড়শো ডলার পেতাম। সেই সময় অবশ্য আমাদের দেশ থেকে অনেক বাণিজ্যসংস্থাও এদেশে ব্যবসা করার জন্য হামলে পড়েছিল। সন্ধ্যায় সেই রকম কোনও কোনও ভারতীয় বাণিজ্যসংস্থার প্রতিনিধিদের রুশ ভাষার পাঠ দিতে তাদের বাসস্থানে যেতাম, তাদের কারও কারও জন্য নিয়মিত বাড়িতে রান্না করা খাবারও সরবরাহ করতাম। এই রকম আরও অতিরিক্ত কিছু টুকিটাকি আয়ে আমি তখন দিন গুজরান করছিলাম।
কিন্তু আমার বন্ধুটির কারবার এলাহি। তার অফিসে ডিনারও আমাকে তৈরি করতে হত। পেরেস্ত্রৈকার আমলে বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্য সূত্রে দেশ থেকে লোকজন আসার হিড়িক পড়ে গেল। তাদের মধ্যে অনেকে আবার তার পূর্বপরিচিত, কেউ কেউ ঘনিষ্ঠ পরিচিত। তাদের ভালোমতো আপ্যায়ন করতে হয়, অতএব অফিসেই রান্না খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হত। সে কাজও আমাকেই করতে হত। রুশি গ্রাহকরা এলে, বিশেষত সম্ভাবনাময় বা শাঁসালো কোনও রুশি গ্রাহক এলে তাদের জন্য ঢালাও পানীয় এবং আনুষঙ্গিক চাটের ব্যবস্থা থাকত। সেই সময় আমাকে দোভাষীর কাজও করতে হত।
ব্যবসার তিন অংশীদারের মধ্যে একজন ইতিমধ্যে অন্য দু’জনকে বাদ দিয়ে গোপনে আলাদাভাবে গ্রাহকদের কারও কারও সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজের ব্যবসা শুরু করে দিয়েছিল, দেশ থেকে ভাইকে নিয়ে এসে তার নামে আলাদা অফিসও খুলে বসেছিল। তাকে বাকি দু’জনে তার বখরা না মিটিয়ে দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রেখেছিল; তারপর একদিন তহবিল তছরুপের অপরাধে তাকে প্রতিষ্ঠানে থেকে বহিষ্কার করা হল। তৃতীয়জনের কারবারেরও রমরমা কিন্তু বেড়েই চলল– তার অফিস তখন মস্কোর একেবারে কেন্দ্রস্থলে ‘উক্রাইনা’ হোটেলে। বন্ধুর মতো তারও পড়াশোনা সোভিয়েত ইউনিয়নে, সেও এখান থেকেই পিএইচ.ডি করেছে– অবশ্য সাংবাদিকতায় নয়, বিজ্ঞান বিষয়ে। তবে কথাবার্তায় সে আমাদের বন্ধুর একেবারে বিপরীত। কথায় কথায় বিজ্ঞানের কৃতী ছাত্র হিসেবে নিজেকে জাহির করত, নিজের সাহিত্যবোধেও তার অগাধ আস্থা ছিল; যে কোনও ভাবেই হোক বাংলা সাহিত্যিকদের মহলে তার যাতায়াত ছিল– দেশে গিয়ে মাঝে মাঝে সেই সম্পর্কটা ঝালিয়েও আসত। একসময় আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠিত এক সাহিত্যপত্রে সে দু’-একটি কবিতাও ছাপিয়ে ফেলেছিল। অর্থাৎ, সর্বতোভাবে একজন সফলকাম ব্যক্তি বলতে যা বোঝায় তাই। যে কোনও বিষয়ের আলোচনায় ‘মৌলিক’ কোনও মন্তব্য করতে তার বাধত না। একবার বলল, ‘রুশ ভাষাটা কোনও ভাষাই নয়’, যদিও ভাষাটা তার একেবারেই আয়ত্তে ছিল না। বেশ কয়েকবার নকশাল আন্দোলনের প্রতি সমবেদনার কথাও প্রকাশ করেছিল– এমনকী, আন্দোলনকারীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল এমন ইঙ্গিতও দিয়েছে। কিন্তু সে যে দূরদর্শী ছিল, তা মানতেই হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের বেশ কিছু আগেই, তখনও সে পুরনো প্রতিষ্ঠানের অংশীদার, সেই সময় অফিস ঘরে বসে সে লেনিন সম্পর্কে একটা কুরুচিকর মন্তব্য করেছিল। সেদিন আমি আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারিনি– বন্ধু মাঝখান থেকে বাধা না দিলে তাকে মেরেই বসতাম।
এটা ঠিক যে, যথাসময়ে সঠিক কাজটা করতে জানা চাই– তারই ওপর মানুষের জীবনের সাফল্য বা প্রতিষ্ঠা নির্ভর করছে। এই যুবকটি তাই যথাসময়ে সাহিত্যচর্চা বা কবিতা লেখার বাতিক, এমনকী বিজ্ঞানচর্চার পালা পর্যন্ত চুকিয়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত একজন সফল ব্যবসায়ী রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল। অবশ্য এটাও ঠিক যে, ওগুলিও ছিল প্রকারান্তরে তার উন্নতির পথের একেকটি সোপান– যোগাযোগের একেকটি ক্ষেত্র। পথযাত্রার সূচনা হয়েছিল সমাজতন্ত্র দিয়ে, শেষকালে পুঁজিতন্ত্রে এসে সিদ্ধিলাভ হল। এমনকী, নিজের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে নিকট আত্মীয়স্বজনকেও সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নে লেখাপড়া শিখিয়ে পুঁজির দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করে গেছে। আমাদের বন্ধুটি নিজেও অবশ্য এর ব্যতিক্রম ছিল না। ইতিহাসের প্রহসন– লেনিনের দেশেই এদের পুঁজিবাদের দীক্ষা। এবং ব্যবসায়িক সাফল্য।
ভারতীয় বাণিজ্যসংস্থার যে সমস্ত শিক্ষার্থীদের আমি রুশ ভাষার পাঠ দিতে যেতাম, তাদের মধ্যে বেশির ভাগেরই শেখার দিকে তেমন একটা ঝোঁক দেখা যেত না– কোনওমতে কাজ চালানো গোছের দু’-একটা শব্দ শিখে ফেললেই যথেষ্ট মনে করত। তাছাড়া কাজের জায়গায় স্থানীয় রুশি কর্মীরা তো আছেই, সর্বোপরি ওখানে অফিস কর্মচারীদের অনেকেই আবার মেয়ে, সুতরাং সেখানে আরও ভালো শেখার সুযোগ থাকত। তাই শিক্ষার্থীরা খুব একটা বেশিদিন টিকত না, তবে ভারতীয় খাবারের লোভটা অনেক সময় টোপের মতো কাজ করত– বিশেষত বাঙালিদের জন্য মাছের ঝোল আর ডাল-ভাতের। জোগান দিতে তখন খুব একটা অসুবিধে হত না।
মস্কোয় বহিরাগত বিদেশিরা ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করার বেশ কিছু আগে থাকতেই যে সমস্ত বিদেশি ছাত্র এককালে এদেশে পড়াশুনা করেছে, তারাই ব্যক্তিগত উদ্যোগে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে দিয়েছিল। যার উল্লেখ এর আগেও করেছি। তখনও সোভিয়েত ইউনিয়নে কম্পিউটারের তেমন চল হয়নি। বিদেশি ছাত্ররা সেই সময় সিঙ্গাপুরে গিয়ে কম্পিউটার কিনে এনে স্থানীয় বাজারে কয়েকগুণ চড়া দরে বিক্রি করত। এদের একটা বড় অংশ ভারতীয় ও বাংলাদেশি। এইভাবে পুঁজি সঞ্চয় করে তারা ব্যবসায় নেমে পড়ত। এদের মধ্যে একজন আবার ছিল আমাদের দেশের জনৈক বামপন্থী নেতার একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়– তাঁর ভাগ্নে। সেই বামপন্থী নেতাটি তাঁর পার্টির সংবাদপত্রের প্রতিনিধি হয়ে কিছুদিনের জন্য মস্কোয় এসেছিলেন। দেশ থেকেই তিনি টেলিফোনে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, অনুরোধ করেছিলেন আমি যেন মস্কোয় তাঁকে সাহায্য করি, কারণ রুশ ভাষা তাঁর জানা নেই, আর রুশ ভাষা জানা না থাকলে এদেশে কিছু করা কঠিন। ভাগ্নের আশ্রয়ে উঠলেও ভাগ্নে কাজে ব্যস্ত। আমি আধা-বেকার, আমার ভাষাজ্ঞান দিয়ে তাঁকে সাহায্য করেছিলাম। তাঁকে নিয়ে নানা জায়গায় ঘুরেছি, ভাগ্নের অফিসে তো গেছিই– পোশাক থেকে শুরু করে নানা ধরনের যন্ত্রপাতির কারবার। দুয়ারে ভাড়া করা স্থানীয় যে সমস্ত রক্ষী আছে, তাদের চেহারা দেখলেই ভয়ে প্রাণ উড়ে যাওয়ার দাখিল। খাওয়া-দাওয়ার ঢালাও ব্যবস্থা। দেখেশুনে মামা মুগ্ধ। ভাগ্নের প্রশংসায় তিনি পঞ্চমুখ। কীভাবে কত পরিশ্রম করে সিঙ্গাপুর থেকে দু’বগলে দুটো করে কম্পিউটার এনে তাই বেচে তিলে তিলে সে এই ব্যবসা গড়ে তুলেছে– উচ্ছ্বসিত ভাষায় সেই কাহিনি তিনি আমাকে শোনালেন।
আমি তখন দেশে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছি। বারবার মনে হচ্ছিল এইভাবে উঞ্ছবৃত্তি করে টিকে থাকার কোনও অর্থ হয় না, যে ব্রত নিয়ে এদেশে এসেছিলাম সেটাই তখন ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু পারিবারিক নানা দায়িত্বের কারণে তখনও আমাকে ওদেশে আটকে থাকতে হয়েছিল। আমার কথা শুনে পার্টি-কমরেডটি প্রস্তাব দিলেন যে আমি তাঁর ভাগ্নের অফিসে চাকরি নিয়ে যাতে ওদেশে থেকে ওদের পত্রিকার মস্কোস্থ সংবাদদাতা হিসেবেও কাজ করতে পারি সে রকম একটা ব্যবস্থা তিনি করে দিতে পারেন। আমি কোনও আগ্রহ প্রকাশ করিনি। উনি দেশে ফিরে যাওয়ার পরও টেলিফোনে আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, ওখানকার খবরাখবর নিয়ে পার্টির কাগজে লেখালেখিও করতেন। আমি যখন দেশে ফিরে আসি, তখন বিমানবন্দরে গাড়ি নিয়ে এসে সেই গাড়িতে আমাকে কলকাতার বাড়িতে পৌঁছেও দিয়েছেন। দেশে ফেরার পর বেশ কিছুকাল তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগও ছিল। কিন্তু পরে যখন দেখা গেল আমরা দু’জনে ঠিক একই পথের পথিক নই, তখন আপনা হতেই ধীরে ধীরে সেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এদের দেখে আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির মতো আমাদের দেশের বামপন্থীদেরও ঘুণ ধরে গেল কি না, নাকি সরষের মধ্যেই ভূত ছিল!
…পড়ুন রুশকথা-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৩৮। শুধু বিদেশে থাকার জন্য উচ্চশিক্ষা লাভ করেও ছোটখাটো কাজ করে কাটিয়ে দিয়েছেন বহু ভারতীয়
পর্ব ৩৭। একটা বিদেশি সাবানের বিনিময়েও নাকি মস্কোয় নারীসঙ্গ উপভোগ করা যায়– এমনটা প্রচার করেছে ভারতীয়রা
পর্ব ৩৬। মস্কোর ঠান্ডায় লঙ্কা গাছ দেখে পি.সি. সরকার বলেছিলেন, ‘এর চেয়ে বড় ম্যাজিক হয় নাকি?’
পর্ব ৩৫। রুশদের কাছে ভারত ছিল রবীন্দ্রনাথের দেশ, হিমালয়ের দেশ
পর্ব ৩৪। সোভিয়েত শিক্ষায় নতুন মানুষ গড়ে তোলার ব্যাপারে একটা খামতি থেকে গিয়েছিল
পর্ব ৩৩। দিব্যি ছিলাম হাসপাতালে
পর্ব ৩২। মস্কোর স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে সাধারণ ডাক্তাররা অধিকাংশই মহিলা ছিলেন
পর্ব ৩১। আমার স্ত্রী ও দুই কন্যা নিজভূমে পরবাসী হয়ে গিয়েছিল শুধু আমার জন্য
পর্ব ৩০। শান্তিদা কান্ত রায়ের প্রিয় কাজ ছিল মস্কোয় ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের কমিউনিজম পড়ানো
পর্ব ২৯। পেরেস্ত্রৈকার শুরু থেকেই নিরাপত্তার অভাব বোধ করছিলেন গোপেনদা
পর্ব ২৮। দেশে ফেরার সময় সুরার ছবি সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পাননি গোপেনদা
পর্ব ২৭। বিপ্লবের ভাঙা হাট ও একজন ভগ্নহৃদয় বিপ্লবী
পর্ব ২৬। ননী ভৌমিকের মস্কোর জীবনযাত্রা যেন দস্তইয়েভস্কির কোনও উপন্যাস
পর্ব ২৫। ননীদা বলেছিলেন, ডাল চচ্চড়ি না খেলে ‘ধুলোমাটি’র মতো উপন্যাস লেখা যায় না
পর্ব ২৪। মস্কোয় শেষের বছর দশেক ননীদা ছিলেন একেবারে নিঃসঙ্গ
পর্ব ২৩। শেষমেশ মস্কো রওনা দিলাম একটি মাত্র সুটকেস সম্বল করে
পর্ব ২২। ‘প্রগতি’-তে বইপুথি নির্বাচনের ব্যাপারে আমার সঙ্গে প্রায়ই খিটিমিটি বেধে যেত
পর্ব ২১। সোভিয়েতে অনুবাদকরা যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করত, সে দেশের কম মানুষই তা পারত
পর্ব ২০। প্রগতি-র বাংলা বিভাগে নিয়োগের ক্ষেত্রে ননীদাই শেষ কথা ছিলেন
পর্ব ১৯। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় নাকি খুব ভালো রুশভাষা জানতেন, প্রমথনাথ বিশী সাক্ষী
পর্ব ১৮। লেডি রাণু মুখার্জিকে বাড়ি গিয়ে রুশ ভাষা শেখানোর দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপর
পর্ব ১৭। একদিন হঠাৎ সুভাষদা আমাদের বাড়ি এসে উপস্থিত ফয়েজ আহমেদ ফয়েজকে নিয়ে
পর্ব ১৬। মুখের সেই পরিচিত হাসিটা না থাকলে কীসের সুভাষ মুখোপাধ্যায়!
পর্ব ১৫। রুশ ভাষা থেকেই সকলে অনুবাদ করতেন, এটা মিথ
পর্ব ১৪। মস্কোয় ননীদাকে দেখে মনে হয়েছিল কোনও বিদেশি, ভারতীয় নয়
পর্ব ১৩। যিনি কিংবদন্তি লেখক হতে পারতেন, তিনি হয়ে গেলেন কিংবদন্তি অনুবাদক
পর্ব ১২। ‘প্রগতি’ ও ‘রাদুগা’র অধঃপতনের বীজ কি গঠনপ্রকৃতির মধ্যেই নিহিত ছিল?
পর্ব ১১। সমর সেনকে দিয়ে কি রুশ কাব্যসংকলন অনুবাদ করানো যেত না?
পর্ব ১০। সমর সেনের মহুয়ার দেশ থেকে সোভিয়েত দেশে যাত্রা
পর্ব ৯। মস্কোয় অনুবাদচর্চার যখন রমরমা, ঠিক তখনই ঘটে গেল আকস্মিক অঘটন
পর্ব ৮: একজন কথা রেখেছিলেন, কিন্তু অনেকেই রাখেননি
পর্ব ৭: লেনিনকে তাঁর নিজের দেশের অনেকে ‘জার্মান চর’ বলেও অভিহিত করত
পর্ব ৬: যে-পতাকা বিজয়গর্বে রাইখস্টাগের মাথায় উড়েছিল, তা আজ ক্রেমলিনের মাথা থেকে নামানো হবে
পর্ব ৫: কোনটা বিপ্লব, কোনটা অভ্যুত্থান– দেশের মানুষ আজও তা স্থির করতে পারছে না
পর্ব ৪: আমার সাদা-কালোর স্বপ্নের মধ্যে ছিল সোভিয়েত দেশ
পর্ব ৩: ক্রেমলিনে যে বছর লেনিনের মূর্তি স্থাপিত হয়, সে বছরই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার সূচনাকাল
পর্ব ২: যে দেশে সূর্য অস্ত যায় না– আজও যায় না
পর্ব ১: এক প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে রাশিয়ার খণ্ডচিত্র ও অতীতে উঁকিঝুঁকি