দাদুর মোটা কালো ফ্রেমের চশমাটা একবার পরে দেখার বড্ড ইচ্ছে ছিল। ওটা চোখে পরলে নাকি সব অঙ্ক ফটাফট করে ফেলা যেত। দিদুনের কৌটো থেকে জর্দা চুরি করে খাওয়ার ছিল, কিন্তু তার আগেই দাদু-দিদুন ছোটবেলাটা সঙ্গে নিয়ে কোথায় চলে গেল, ঠিকানাটা দিয়ে গেল না। ভোকাট্টা বিভাগে প্রকাশিত হল পাঠকের দ্বিতীয় চিঠি। লিখেছেন তৃণা ঘোষাল।
প্রিয় ছোটবেলা,
মাঝে মাঝেই, কোনও রোদ ঝমঝম দুপুরে কিংবা অফিসের মেলে বিরক্ত ও বিব্রত বিকেলবেলায়, পুরনো কোনও বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা মারতে মারতে কিংবা চন্দ্রবিন্দুর গানের আদরে ডুবে যেতে যেতে তোকে বড্ড মনে পড়ে। জানি পার হয়ে যাওয়া সময় আর ফেরে না কখনও। ছোটবেলাটা এখন একটা সম্পদভরা বাক্স শুধু, সময়ে-অসময়ে খুললেই হল। মণিমুক্তো ঠিকরে বেরয়। আর তাই ভাবি কত কিছু বাকি থেকে গেল, করব বলে আর করা হল না।
দাদুর মোটা কালো ফ্রেমের চশমাটা একবার পরে দেখার বড্ড ইচ্ছে ছিল। ওটা চোখে পরলে নাকি সব অঙ্ক ফটাফট করে ফেলা যেত। দিদুনের কৌটো থেকে জর্দা চুরি করে খাওয়ার ছিল, কিন্তু তার আগেই দাদু-দিদুন ছোটবেলাটা সঙ্গে নিয়ে কোথায় চলে গেল, ঠিকানাটা দিয়ে গেল না।
দোতলার ঘর থেকে যে সোজাসুজি তালগাছটা দেখা যেত, ওটাতে অন্ধকার ঘনালেই যে চোখগুলো জ্বলজ্বল করত, সেগুলো কি পেঁচার চোখ ছিল, নাকি একানড়ের– সেই রহস্যটাও সল্ভ করা হল না। একদিন শুধু সবক’টা রঙের পেপসি খাওয়ার ইচ্ছে ছিল। একটা একটা করে খাব, আর ঠোঁটের রংও বদলাবে কমলা থেকে সবুজ থেকে খয়েরি… খাওয়া হয়নি।
সুরশ্রী, আমি, মৈত্রেয়ী মিলে আরেকবার শান্তিনিকেতন লজের ৩০১ নং ঘরটায় থাকব ভেবেছিলাম। আবার কঙ্কালিতলা থেকে কলাভবন ঘুরে দেখার ছিল। ক্লাস এইটের পর আমি আর কখনও শান্তিনিকেতনই যাইনি। আমার লেখা প্রথম প্রেমের গল্পটা আজও অসমাপ্ত রয়ে গেছে। গোটা উত্তরপাড়া যে সাইকেলে টহল মারার ছিল, সেটাও তো হল না বল!
দোতলার ছাদের কুলুঙ্গিতে বসে পিয়াকে ‘কহোনা প্যায়ার হ্যায়’-এর গল্প বলা শুরু করেছিলাম। ছাদটা নেই তো আর, তাই গল্পটাও শেষ হয়নি। এমনকী, মায়ের সিরিয়াল দেখার সময়ে ভূতের ভয় দেখানোর প্ল্যানটাও গুবলেট হয়ে গেছিল।
খুব বিরক্ত করত পাঁচি মাসি ছোটবেলায়। তাই একটা শিশিতে ছারপোকা পোষার প্ল্যান করেছিলাম। তন্ন তন্ন করে গোটা বাগান ঘুরেও একটা ছারপোকা খুঁজে পাইনি।
মহাভারতের গল্পটা বদলে ফেলে কর্ণ দ্রৌপদীকে মিলিয়ে দেওয়ার গল্পটা লেখা হয়নি, দুর্গার মতো বৃষ্টিতে ভিজে হিহি করে কাঁপতে কাঁপতে ‘লেবুর পাতায় করমচা, অ্যাই বৃষ্টি ধরে যা’ বলা হয়নি। এমনকী, কাশফুলের মধ্য দিয়ে কয়লার ট্রেনের ধোঁয়াও দেখা হয়নি।
আরও অনেক কিছু করা হয়নি রে ছোটবেলা। বড্ড মায়ামাখা ছিলিস তো তুই, আর তাই তোর ছোঁয়ামাখা বাক্সটা আজও রাখা আছে চারপাশটায়। চোখ চালিয়ে দেখতে গেলেই জল এসে যায়। চোখে পেরিস্কোপ নেই তো, তাই চারপাশটা নিজেরাই ছোটবেলা হয়ে যায়, আর দেখা যায় না। তোর আমাকে মনে পড়ে ছোটবেলা?
ইতি,
সেই মেয়েটা
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে যে মন্ত্রিত্বই তাঁর হাতে থাক, বুদ্ধদেব ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর কাছে অতি নির্ভরযোগ্য এক সেনাপতির মতো। ‘আপনারা বুদ্ধর কাছে যান, বুদ্ধ ওসব কালচার-ফালচার বোঝে’– জ্যোতিবাবুর এই উক্তি যথার্থ কি না জানি না, কিন্তু কথাটা মিথ্যে ছিল না।