এই পর্বে মস্কোর রাস্তায়-ঘাটে আগের মতো নিরাপত্তা ছিল না– বিশেষত রাতের বেলায়। যখন তখন ছিনতাই হত। আমার চেনা পরিচিত বেশ কিছু ভারতীয়কে এর শিকার হতে হয়েছিল– তাদের মুখে সেসব অভিজ্ঞতার রোমহর্ষক কাহিনিও শুনেছি– শুধু রাস্তায় কেন, দু’-একজনকে তো বাড়ির লিফ্টেই ওঠানামার সময় ছিনতাইয়ের কবলে পড়তে হয়েছিল। আমি তখন প্রায় রোজই সন্ধ্যাবেলায় এদেশে বিভিন্ন ভারতীয় বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের রুশ ভাষা শেখাতে যেতাম। বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যেত– বিশেষত শীতকালের রাত হলে তো কথাই নেই– দশটা এগারটা মানে নিশুতি রাত। উপরন্ত রাস্তাঘাটও আর আগের মতো জমজমাট থাকত না– একেবারে শুনশান হয়ে যেত।
৪০.
নতুন রাশিয়ায় ভারতীয়দের ব্যবসা-বাণিজ্যে রমরমা ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
সাংবাদিক বন্ধুর অফিস ছাড়া আরও দু’-একজন ভারতীয় ব্যবসায়ীর অফিসে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার এই সময় হয়েছিল। প্রায় একই ধরনের অভিজ্ঞতা, কোনও কোনও সময় আরও খারাপ। অনেক সময় চায়ের নমুনা নিয়ে মস্কোর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে বিভিন্ন বাণিজ্যসংস্থার অফিসে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। কিন্তু চা যে সমস্ত সংস্থা কিনবে, তারা তো ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করেই কিনবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেসব চায়ে ভেজালের বড় রকমের মাত্রা ধরা পড়েছে, তার জন্য কোম্পানির হয়ে গালমন্দও আমাকেই শুনতে হয়েছে। সেসব ভারতীয় সংস্থার অফিসেও জালিয়াতির চূড়ান্ত, অবশ্য সেটা বেসরকারিকরণের প্রথম দিকেই বেশি চলত, যখন রুশিরা ব্যবসা-বাণিজ্যের অনেক কিছুই বুঝত না। আমাদের দেশের অনেক ব্যবসায়ীই সেই সময় ‘রবার স্ট্যাম্প’ আর ‘লেটার হেড’ দিয়েই অনেক কাজ হাসিল করে ফেলত। রুশিরা তখনও জানত না যে, ওসব জিনিস আমাদের দেশে যে কোনও জায়গায় যখন-তখন ছাপানো যায়, যেহেতু তাদের দেশে ওটা কখনওই সম্ভব ছিল না। আমার মেয়েরাও স্কুলের দীর্ঘকালীন ছুটির সময় সেসব বাণিজ্যসংস্থায় কাজ করেছে। কিন্তু দেখলাম ওখানে কাজ করলে জালিয়াতি ছাড়া ওরা আর কিছুই শিখবে না, তাই আর্থিক অনটন সত্ত্বেও বেশিদিন কাজ করার আগেই ওদের ছাড়িয়ে নিয়েছি।
একবার মাস দুয়েকের জন্য অন্য আরেক বন্ধুর বিশেষ অনুরোধে তার বাণিজ্যসংস্থার অফিসে কাজ করতে হয়েছিল। তার ছিল চায়ের কারবার। এক সময় সেও এখানেই পড়াশুনা করেছিল। কাজটা আপাতদৃষ্টিতে বেশ সহজই মনে হয়েছিল; বেলা দশটা থেকে তিনটে পর্যন্ত অফিস খোলা রাখা– খোলা রাখা মানে টেলিফোনে নির্দিষ্ট কিছু গ্রাহকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা। প্রতিষ্ঠানের মালিক ব্যবসাসূত্রেই আপাতত লন্ডন যাচ্ছে, নির্দিষ্ট সময়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যবসা-সংক্রান্ত খবরাখবর তাকে জানাতে হবে। তখনও ওদেশে মোবাইল পরিষেবা চালু হয়নি, তবে landline-এর ফোনে indicator-এর ব্যবস্থা ছিল, তা থেকে জানা যেত কোন কোন নম্বর থেকে ফোন আসছে। বন্ধুটি বেশ কতকগুলি নম্বরের একটা তালিকা আমাকে ধরিয়ে দিয়ে বলল যে একমাত্র ওই সব নাম্বার থেকে ফোন এলেই যেন আমি ফোন ধরি, অন্যথায় নয়। আমি দেখলাম ভালোই হল, অফিসে বিশেষ কিছু করার নেই, ওখানে বসে বসে নিরিবিলিতে কলকাতার সংবাদপত্রের জন্য প্রতিবেদন লেখা যাবে।
অফিস খুলে রাখার অর্থ অবশ্য অফিসঘরের দরজা খুলে রাখা নয়। ভেতরের একটা ফোকর থেকে বাইরে হাত গলিয়ে দরজা, তালা বন্ধ করে রাখা হত। তাছাড়া নিচে প্রহরার বন্দোবস্তও ছিল। আমাকে সে আরও একটি কাজের দায়িত্ব দিয়েছিল: একগোছা ধূপকাঠি আর মোমবাতি হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল আমি যেন রোজ অফিসে ঢুকেই তার দুই ঘরে রাখা লক্ষ্মী-গণেশ আর অন্যান্য ঠাকুর দেবতার মূর্তি ও পটের সামনে ওগুলো জ্বালিয়ে দিই। যদিও জানত যে আমি ঘোর নাস্তিক তবু আমাকে বিশ্বাস করেই এই কাজের ভার সে আমাকে দিয়েছিল। আমিও অবশ্য তার বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষা করেছিলাম।
কিন্তু আমাকে বিশ্বাস করা সত্ত্বেও একটা কথা সে আমার কাছ থেকে গোপন করে রেখেছিল। পরে অন্যের মুখে শুনতে পেলাম। বেশ কয়েকদিন আগে মাফিয়া তাকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে দিন কয়েক একটা অন্ধকার কুঠুরিতে আটকে রেখেছিল, শেষমেশ একটা মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দিয়ে এবং আপাতত বেশ কিছুদিনের জন্য সে মস্কোতে তার কার্যকলাপ বন্ধ রাখবে– এই শর্তে ছাড়া পায়। এই কারণেই নাকি মস্কো থেকে সে গা ঢাকা দিয়েছে। শুনে আমি ভয়ে কাঁটা হয়ে রইলাম। কিন্তু সৌভাগ্যবশত কোনও দুর্ঘটনা ঘটল না।
এই পর্বে মস্কোর রাস্তাঘাটে আগের মতো নিরাপত্তা ছিল না– বিশেষত রাতের বেলায়। যখন তখন ছিনতাই হত। আমার চেনা পরিচিত বেশ কিছু ভারতীয়কে এর শিকার হতে হয়েছিল– তাদের মুখে সেসব অভিজ্ঞতার রোমহর্ষক কাহিনিও শুনেছি– শুধু রাস্তায় কেন, দু’-একজনকে তো বাড়ির লিফ্টেই ওঠানামার সময় ছিনতাইয়ের কবলে পড়তে হয়েছিল।
আমি তখন প্রায় রোজই সন্ধ্যাবেলায় এদেশে বিভিন্ন ভারতীয় বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের রুশ ভাষা শেখাতে যেতাম। আবার বাংলাদেশ দূতাবাসের কোনও কোনও কর্মীর স্কুল-পড়ুয়া ছেলেমেয়েকে বাংলা পড়াতে যেতাম। বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যেত– বিশেষত শীতকালের রাত হলে তো কথাই নেই– ১০-১১টা মানে নিশুতি রাত। উপরন্ত রাস্তাঘাটও আর আগের মতো জমজমাট থাকত না– একেবারে শুনশান হয়ে যেত। লোকে নেহাত কাজ না থাকলে বাড়ি থেকে বের হত না, যত সকাল সকাল সম্ভব বাড়ি ফিরে যেত। আমার বাড়ির কাছাকাছি মেট্রো স্টেশন থেকে বেশ খানিকটা পথ বরফ ভেঙে বাড়ি পৌঁছতে হত– রীতিমতো গা ছমছম করার মতো অভিজ্ঞতা, কিন্তু সময়ে গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল। কেউ কিন্তু আমাকে স্পর্শও করেনি। তবে হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে সেই আগেকার মতোই কোথা থেকে মাটি ফুঁড়ে ‘দকুমেন্ত!’ বলে হাঁক দিয়ে পুলিশের লোক স্যালুট দিয়ে সামনে এসে দাঁড়াত, তখন থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হত। আমাদের এলাকাটা নাকি বিদেশিদের বসবাসের পক্ষে এক ধরনের নিষিদ্ধ এলাকা– তাই এখানে পুলিশের একটু বেশি তৎপরতা!
সে যাই হোক, আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছিল যারা ছিনতাই করে তারা কার কাছে কী আছে বা থাকতে পারে তা জেনেই করে। বহু মাফিয়াও আবার রাস্তার আড়াআড়ি গাড়ি চালিয়ে পথরোধ করে গাড়ি থামিয়ে বিশাল বিশাল অঙ্কের টাকা লুটপাট করত। সবই সেই নতুন ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের কালো টাকা– লেনদেন ব্যাঙ্কের মাধ্যমে না হয়ে নগদ টাকায় হত। এদের অনেকেই ব্রিফকেস ভর্তি নগদ টাকাপয়সা নিয়ে ঘোরাফেরা করত।
………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………….
রাশিয়াতে কর্মরত আমাদের দেশের বিভিন্ন বাণিজ্য সংস্থার কর্মীদের রুশ ভাষা শেখানোর অভিজ্ঞতাটাও ভারি বিচিত্র। এদের অনেকেই ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে দু’-তিন জন মিলে ‘মেস’ করে বসবাস করত, ফলে একই জায়গায় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী জুটে যেত; পরন্তু বাড়ি থেকে তাদের জন্য রান্না-খাবারের জোগান দিয়ে বেশ খানিকটা বাড়তি আয়ও হয়ে যেত। সব লেনদেনই হত ডলারে, নয়ের দশকে রাস্তার যেখানে-সেখানে ব্যাঙের ছাতার মতো রুবল-ডলারের বিনিময় কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। রুবলের দর এত পড়ে গিয়েছিল যে ২০০-২৫০ ডলারে আমাদের মতো চারজনের পরিবারের মোটামুটি চলে যেত।
কিন্তু রান্না-খাবারের জোগান দেওয়ার একটা ঝক্কি ছিল: গ্রাহকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার শাকাহারী। অথচ শীতকালে সবজি বলতে বাঁধাকপি আর গাজর ছাড়া বিশেষ কিছু মিলত না।
…পড়ুন রুশকথা-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৩৯। হাওয়া বদলের আঁচ অনেকেই আগে টের পেয়েছিল, বদলে ফেলেছিল জীবনযাত্রা
পর্ব ৩৮। শুধু বিদেশে থাকার জন্য উচ্চশিক্ষা লাভ করেও ছোটখাটো কাজ করে কাটিয়ে দিয়েছেন বহু ভারতীয়
পর্ব ৩৭। একটা বিদেশি সাবানের বিনিময়েও নাকি মস্কোয় নারীসঙ্গ উপভোগ করা যায়– এমনটা প্রচার করেছে ভারতীয়রা
পর্ব ৩৬। মস্কোর ঠান্ডায় লঙ্কা গাছ দেখে পি.সি. সরকার বলেছিলেন, ‘এর চেয়ে বড় ম্যাজিক হয় নাকি?’
পর্ব ৩৫। রুশদের কাছে ভারত ছিল রবীন্দ্রনাথের দেশ, হিমালয়ের দেশ
পর্ব ৩৪। সোভিয়েত শিক্ষায় নতুন মানুষ গড়ে তোলার ব্যাপারে একটা খামতি থেকে গিয়েছিল
পর্ব ৩৩। দিব্যি ছিলাম হাসপাতালে
পর্ব ৩২। মস্কোর স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে সাধারণ ডাক্তাররা অধিকাংশই মহিলা ছিলেন
পর্ব ৩১। আমার স্ত্রী ও দুই কন্যা নিজভূমে পরবাসী হয়ে গিয়েছিল শুধু আমার জন্য
পর্ব ৩০। শান্তিদা কান্ত রায়ের প্রিয় কাজ ছিল মস্কোয় ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের কমিউনিজম পড়ানো
পর্ব ২৯। পেরেস্ত্রৈকার শুরু থেকেই নিরাপত্তার অভাব বোধ করছিলেন গোপেনদা
পর্ব ২৮। দেশে ফেরার সময় সুরার ছবি সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পাননি গোপেনদা
পর্ব ২৭। বিপ্লবের ভাঙা হাট ও একজন ভগ্নহৃদয় বিপ্লবী
পর্ব ২৬। ননী ভৌমিকের মস্কোর জীবনযাত্রা যেন দস্তইয়েভস্কির কোনও উপন্যাস
পর্ব ২৫। ননীদা বলেছিলেন, ডাল চচ্চড়ি না খেলে ‘ধুলোমাটি’র মতো উপন্যাস লেখা যায় না
পর্ব ২৪। মস্কোয় শেষের বছর দশেক ননীদা ছিলেন একেবারে নিঃসঙ্গ
পর্ব ২৩। শেষমেশ মস্কো রওনা দিলাম একটি মাত্র সুটকেস সম্বল করে
পর্ব ২২। ‘প্রগতি’-তে বইপুথি নির্বাচনের ব্যাপারে আমার সঙ্গে প্রায়ই খিটিমিটি বেধে যেত
পর্ব ২১। সোভিয়েতে অনুবাদকরা যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করত, সে দেশের কম মানুষই তা পারত
পর্ব ২০। প্রগতি-র বাংলা বিভাগে নিয়োগের ক্ষেত্রে ননীদাই শেষ কথা ছিলেন
পর্ব ১৯। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় নাকি খুব ভালো রুশভাষা জানতেন, প্রমথনাথ বিশী সাক্ষী
পর্ব ১৮। লেডি রাণু মুখার্জিকে বাড়ি গিয়ে রুশ ভাষা শেখানোর দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপর
পর্ব ১৭। একদিন হঠাৎ সুভাষদা আমাদের বাড়ি এসে উপস্থিত ফয়েজ আহমেদ ফয়েজকে নিয়ে
পর্ব ১৬। মুখের সেই পরিচিত হাসিটা না থাকলে কীসের সুভাষ মুখোপাধ্যায়!
পর্ব ১৫। রুশ ভাষা থেকেই সকলে অনুবাদ করতেন, এটা মিথ
পর্ব ১৪। মস্কোয় ননীদাকে দেখে মনে হয়েছিল কোনও বিদেশি, ভারতীয় নয়
পর্ব ১৩। যিনি কিংবদন্তি লেখক হতে পারতেন, তিনি হয়ে গেলেন কিংবদন্তি অনুবাদক
পর্ব ১২। ‘প্রগতি’ ও ‘রাদুগা’র অধঃপতনের বীজ কি গঠনপ্রকৃতির মধ্যেই নিহিত ছিল?
পর্ব ১১। সমর সেনকে দিয়ে কি রুশ কাব্যসংকলন অনুবাদ করানো যেত না?
পর্ব ১০। সমর সেনের মহুয়ার দেশ থেকে সোভিয়েত দেশে যাত্রা
পর্ব ৯। মস্কোয় অনুবাদচর্চার যখন রমরমা, ঠিক তখনই ঘটে গেল আকস্মিক অঘটন
পর্ব ৮: একজন কথা রেখেছিলেন, কিন্তু অনেকেই রাখেননি
পর্ব ৭: লেনিনকে তাঁর নিজের দেশের অনেকে ‘জার্মান চর’ বলেও অভিহিত করত
পর্ব ৬: যে-পতাকা বিজয়গর্বে রাইখস্টাগের মাথায় উড়েছিল, তা আজ ক্রেমলিনের মাথা থেকে নামানো হবে
পর্ব ৫: কোনটা বিপ্লব, কোনটা অভ্যুত্থান– দেশের মানুষ আজও তা স্থির করতে পারছে না
পর্ব ৪: আমার সাদা-কালোর স্বপ্নের মধ্যে ছিল সোভিয়েত দেশ
পর্ব ৩: ক্রেমলিনে যে বছর লেনিনের মূর্তি স্থাপিত হয়, সে বছরই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার সূচনাকাল
পর্ব ২: যে দেশে সূর্য অস্ত যায় না– আজও যায় না
পর্ব ১: এক প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে রাশিয়ার খণ্ডচিত্র ও অতীতে উঁকিঝুঁকি