জ্বালা যত আমাদের মতো পাতি সমর্থকদের। আসলে কখনও পারফর্মার যে নই আমরা। কখনও ছিলাম না! তাই শ্রেষ্ঠত্বের সংজ্ঞা কী, প্রকৃত লড়াই কাকে বলে, রোনাল্ডো-মেসির উচ্চতায় পৌঁছতে পরিশ্রমের স্বেদবিন্দুতে ক’ফোঁটা লোহিতকণা মিশে থাকে, আমরা কিস্যু জানি না। জানতে চাইও না। আসলে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পৃথিবীর বাসিন্দাদের যত কারবার ‘রিফ্লেকটেড গ্লোরি’ নিয়ে। আকাঙ্ক্ষার মহানায়করা দুর্ধর্ষ খেললে, আমরা ঋত্বিকের ধাঁচে অক্ষম কোমর বাঁকাই। হেরে গেলে নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে বালিশ ভিজিয়ে দিই।
১১.
‘ভামোস রাফা,
অ্যাজ ইউ গেট রেডি টু গ্র্যাজুয়েট ফ্রম টেনিস, আই হ্যাভ গট আ ফিউ থিংস টু শেয়ার বিফোর আই মেবি গেট ইমোশনাল।
লেটস স্টার্ট উইথ দ্য অবভিয়াস: ইউ বিট মি– আ লট। মোর দ্যান আই ম্যানেজড টু বিট ইউ। ইউ চ্যালেঞ্জড মি ইন ওয়েজ নো ওয়ান এলস কুড। অন ক্লে, ইট ফেল্ট লাইক আই ওয়াজ স্টেপিং ইনটু ইওর ব্যাকইয়ার্ড, অ্যান্ড ইউ মেড মি ওয়ার্ক হার্ডার দ্যান আই এভার থট আই কুড জাস্ট টু হোল্ড মাই গ্রাউন্ড। ইউ মেড মি রিইম্যাজিন মাই গেম– ইভন গোয়িং সো ফার অ্যাজ টু চেঞ্জ দ্য সাইজ অফ মাই রাকেট হেড, হোপিং ফর অ্যান এজ… অ্যান্ড ইউ নো হোয়াট, রাফা, ইউ মেড মি এনজয় দ্য গেম ইভন মোর…।’
‘সদ্য প্রাক্তন’ রাফায়েল নাদালের উদ্দেশে রজার ফেডেরারের লেখা পড়তে পড়তে চোখ ভিজে আসছিল। কে লেখে এমন? চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী সম্পর্কে কখনও এ লেখা লিখতে আছে? ঘোর শত্রুর বিদায়বেলায় কখনও তাঁকে বলতে আছে, তুমিই আমায় খেলাটাকে আরও উপভোগ করতে শিখিয়েছ, ভালোবাসতে শিখিয়েছ? আর রাফারও বলিহারি! ফেডেরার টেনিস কোর্ট ছেড়ে চলে গেলেন যে দিন, ঝরঝরিয়ে কাঁদতে বসে গেলেন! রজারের পাশে বসে। হাতে হাত রেখে। গুগল সার্চ দিন, আজও ছবি পাবেন। সে দিনই তো এই অলুক্ষুনে ভ্রাতৃত্ববোধের জন্ম! কিন্তু বলুন তো মহাশয়, এ সমস্ত চলে? যায় মানা? তওবা, তওবা! তা হলে প্রতিদ্বন্দ্বী শব্দখানা রেখে লাভ কী? ‘যা-হ্যাট’ বলে অভিধান থেকে হিমঘরে পাঠিয়ে দিলেই হয়।
প্রতিদ্বন্দ্বী!
বাংলা অভিধানের পুঁচকে একটা শব্দ। কিন্তু দেখুন দেখি, কী বিশাল প্রপঞ্চময় এক প্রহেলিকা সে! অবিকল সূর্যালোকের মতো। আমরা দেখছি সাদা, কিন্তু মোটেও ঠিক দেখছি না! না-হলে মেসি বনাম রোনাল্ডো, শচীন বনাম শোয়েব, বিরাট বনাম রোহিত, আনন্দ বনাম কাসপারভ– সমস্ত লড়াই-যুদ্ধের ঘ্রাণে হিংসা-রেষারেষির দূষিত বাতাস মিশে থাকত। কিন্তু কোথায়, তা তো থাকছে না। থাকেনি কখনও। নেই। উল্টে ইদানীং দেখছি, মেসি নিয়ে বলতে-বলতে সিআর সেভেন কেমন প্রগলভ হয়ে পড়ছেন। অক্লেশে বলে দিচ্ছেন, ‘টপ প্লেয়ার’। নয়ের জাতকদের যে ‘কুরুক্ষেত্র’ নিয়ে রাত্তিরে ঘুম হত না, সেই শচীন-শোয়েবও তো দেখি আজকাল বড়ই সৌহার্দ্যপূর্ণ পারস্পরিক বচন-ব্যবহারে ব্যস্ত থাকেন! আনন্দ নিয়ে কখনও কাসপারভকে খারাপ কিছু বলতে শুনিনি। বিরাট নিয়ে রোহিত, কিংবা রোহিত নিয়ে বিরাট– নাহ্, একদম না।
……………………………………………
সিনেমার পর্দায় শাহরুখ খান দশটা গুন্ডা একা না পেটালে, টিভির পর্দায় শচীন হাতের সুখ করে শোয়েব-আক্রম না ঠ্যাঙালে, রজারকে হারিয়ে নাদাল ট্রফি কামড়ে না ধরলে, বাঁচব কী নিয়ে আমরা? থাকব কী নিয়ে আমরা? কিন্তু আমরাও জানি, অবচেতনে বেশ জানি, আদতে পারফর্মার-পারফর্মারে রেষারেষি বলে কিছু হয় না। মহাশত্রু-মহাপ্রতিদ্বন্দ্বী বলেও কিছু হয় না। যা হয়, থাকে যা, সে-ও বড় ছোট্ট এক শব্দ– বন্ধুত্ব! কোর্ট বাদে, মাঠ বাদে, সর্বত্র যার বিচরণ।
……………………………………………
কী জানেন, জ্বালা যত আমার আর আপনার! জ্বালা যত আমাদের মতো পাতি সমর্থকদের। আসলে কখনও পারফর্মার যে নই আমরা। কখনও ছিলাম না! তাই শ্রেষ্ঠত্বের সংজ্ঞা কী, প্রকৃত লড়াই কাকে বলে, রোনাল্ডো-মেসির উচ্চতায় পৌঁছতে পরিশ্রমের স্বেদবিন্দুতে ক’ফোঁটা লোহিতকণা মিশে থাকে, আমরা কিস্যু জানি না। জানতে চাইও না। আসলে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পৃথিবীর বাসিন্দাদের যত কারবার ‘রিফ্লেকটেড গ্লোরি’ নিয়ে। আকাঙ্ক্ষার মহানায়করা দুর্ধর্ষ খেললে, আমরা ঋত্বিকের ধাঁচে অক্ষম কোমর বাঁকাই। হেরে গেলে নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে বালিশ ভিজিয়ে দিই। করারও নেই কিছু। আহা, সাধ্য না থাকলেও সাধ যে আছে! নিজেরা না পারলে, পূজিত বিগ্রহের মাধ্যমে সে সাধ-আহ্লাদ মেটানোর শখ আছে। আরে বাছা, চাঁদও তো সূর্যের আলোয় আলোকিত হয় নাকি? তা হলে আমাদের সঙ্গে পাঁয়তারা কষে কী লাভ? আমরা কী দোষ করলাম?
আর তাই, এ সমস্ত ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘প্রতিপক্ষ’, ‘শত্রু’, ‘ঘোর শত্রু’, ‘মহাশত্রু’– সবই আমাদের সৃষ্ট শব্দ। আমাদেরই শব্দ। আমাদের মতো চার আনা-আট আনা মানুষের আড়াই টাকার অলঙ্কার। যা আমাদের ভুলিয়ে রাখে। বাস্তব থেকে দূরে রাখে।
করার নেই কিছু। নিখাদ আমোদ-আহ্লাদ যে বড় কম আমাদের। সিনেমার পর্দায় শাহরুখ খান দশটা গুন্ডা একা না পেটালে, টিভির পর্দায় শচীন হাতের সুখ করে শোয়েব-আক্রম না ঠ্যাঙালে, রজারকে হারিয়ে নাদাল ট্রফি কামড়ে না ধরলে, বাঁচব কী নিয়ে আমরা? থাকব কী নিয়ে আমরা? কিন্তু আমরাও জানি, অবচেতনে বেশ জানি, আদতে পারফর্মার-পারফর্মারে রেষারেষি বলে কিছু হয় না। মহাশত্রু-মহাপ্রতিদ্বন্দ্বী বলেও কিছু হয় না। যা হয়, থাকে যা, সে-ও বড় ছোট্ট এক শব্দ– বন্ধুত্ব! কোর্ট বাদে, মাঠ বাদে, সর্বত্র যার বিচরণ।
আসলে প্লেয়ারের ভুবনে যে দুই গোলার্ধ নেই, দুই গোলার্ধের মাঝামাঝি কোনও জ্বলুনির ‘বিষুবরেখা’ নেই। পারফর্মারের দুনিয়ায় দুই গোলার্ধ বরাবর এক। সব সময় এক।
হে চার আনা-আট আনার ছাপোষা মনুষ্যদল, তোমরা মানো কিংবা না মানো, খেলার পৃথিবীর ইহাই আদি ও অকৃত্রিম ওপেন সিক্রেট!
……………………… পড়ুন ওপেন সিক্রেট-এর অন্যান্য পর্ব …………………….
পর্ব ১০: অভিধানের যে শব্দটা সবচেয়ে বেশি মনুষ্যরূপ ধারণ করেছে
পর্ব ৯: জোট-অঙ্কে ভোট-রঙ্গ
পর্ব ৮: দক্ষিণ বিসর্জন জানে, উত্তর জানে বিসর্জন শেষের আগমনী
পর্ব ৭: পুজো এলেই ‘সর্বজনীন’ নতুবা নিঃসঙ্গ?
পর্ব ৬: এক্সক্লুসিভের খোয়াব, এক্সক্লুসিভের রোয়াব
পর্ব ৫: শাসন-সোহাগের দ্বন্দ্বসমাস
পর্ব ৪: পাঁকাল সাধনায় নাকাল
পর্ব ৩: দেখা ও না-দেখার সিদ্ধান্ত
পর্ব ২: মহাবিশ্বে যে টোকে না, সে বোধহয় টেকেও না
পর্ব ১: অফিসে দৈবের বশে প্রেমতারা যদি খসে
বাংলা ভাষা সেই পাঁচের দশকে যদি বারীন ঘোষের ‘ছিন্নমূল’, সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’, ঋত্বিক ঘটকের ‘অযান্ত্রিক’-এর (যেহেতু ‘নাগরিক’-এর মুক্তি পরে) জন্ম দিয়ে থাকে, তাহলে ১৯৬৯ সালে মৃণাল সেনের ‘ভুবন সোম’ ভারতীয় নববসন্তের অস্তিত্ব জানান দিল।