নাম আর ডাকনাম আসলে আদা আর কাঁচকলা, তেল আর নুন, অহি আর নকুল। তাদের মধ্যে মিলমিশ নেই। প্রতিহিংসা নামক বস্তুটা তাদের জন্মগত। একে অপরের ভালো তারা মোটে দেখতে পারে না। নামের সুখ্যাতি বাড়লে ডাকনাম আড়ালে চাপা পড়ে। উল্টোটাও হয়। ডাকনামে বিখ্যাত হলে পিতৃদত্ত নামটিকে ভুলে মেরে দেয় জগৎ সংসার। উভয়ের মধ্যে একটা ভৌগোলিক সীমারেখাও টানা আছে। ডাকনামের দৌড় বড়জোর পাড়া পর্যন্ত। সেই সীমানা পেরোলেই নামের প্রেস্টিজে ফলিডল! সবমিলিয়ে নামের সঙ্গে যতই স্বস্তি জুড়ে থাক, ডাকনামে আছে অস্বস্তি। সেই অস্বস্তি বাল্য থেকে বার্ধক্য– পিছু তাড়া করে।
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
আমার মা-র মেজমামার নাম ছিল কালী ভট্টাচার্য– কালনায় খুব নামী হোমিওপ্যাথ ছিলেন তিনি। মেজদাদুর ওষুধ না খেলে আমাদের বাড়ির অনেকেরই ব্যারাম সারতো না। এই মেজোদাদুর ডাকনাম ছিলো হাম্বুলি। ছোটোবেলা থেকে মা-কে অনেক জ্বালিয়েছি ‘হাম্বুলি’-র মানে জিজ্ঞাসা করে। মা প্রথম দিকে রেগে যেতেন, পরে উত্তর দিতেন না। কিংবা বিরক্ত হয়ে বলতেন, ‘ডাকনাম এইরকম হয়ে থাকে’। উল্টে চ্যালেঞ্জ করতাম– আরেকটা হাম্বুলি দেখাও আমায়। মেজদাদুর দাদার ডাকনাম ছিল খটু আর পরের ভাইয়ের নাম ছিল টন। আগে আর পরে দু’জনের দুই অক্ষরের নামের মাঝে এক তিন অক্ষরের যুক্তাক্ষর সমেত ডাকনাম– যার মানে কেউ জানে না– এই নিয়ে আমি প্রবল অস্বস্তিতে ভুগতাম। ওঁর সমসাময়িক মানুষ আমার ঠাকুরদাদা আর তাঁর ভাই– তাঁদের নাম ছিল জোতে আর তিনু– তখনকার দিনে এ’রমই নাম হত। এর মধ্যে কালাপাহাড়ের মতো ‘হাম্বুলি’– একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না।
মেজদাদু ছিলেন আমার ঠাকুরমার চেয়ে দুই-এক বছরের ছোট– তাঁর বাপের বাড়ির দিক থেকে এক আত্মীয়তা ছিল, তাই ঠাকুরমা ছোটবেলা থেকেই মেজদাদুকে চিনতেন আর নাম ধরে ডাকতেন। দাদুর মৃত্যুর পর যখন ঠাকুরমা পাকাপাকি ভাবে দেশের বাড়িতে থাকতে শুরু করলেন, স্বাভাবিকভাবেই বাড়ির ছোটদের অসুখবিসুখে মেজদাদু ছিলেন ঠাকুরমার এক মস্ত ভরসা। ‘বৌমা, একবার হাম্বুলির কাছে দেখিয়ে নাও’ ছিল এক বাঁধা ডায়লগ। ঠাকুরমা এই হাম্বুলি নামটা বাঁচিয়ে রেখেছিলেন, কারণ আমি যে সময়ের কথা বলছি– মেজদাদুকে ডাকনামে ডাকার মতো মানুষ আমার পরিচিত বৃত্তে আর কেউ ছিল না। ঠাকুরমা মারা যান ১৯৮১-তে, তাঁর মৃত্যুর পর আমি কাউকে ওই নামে ডাকতে শুনিনি।
এইরকম একটা ডাকনাম বেঘোরে হারিয়ে যাবে মেনে না নিতে পেরে আমি মেজদাদুকে হাম্বুলিদাদু বলে ডাকতে শুরু করি। তিনি মা-কে ‘তোর ছেলে বড় ডেঁপো হয়েছে’ অনুযোগ করায় সামনে মেজদাদু ডাকলেও আড়ালে হাম্বুলিদাদু ডাকতে লাগলাম। বাবাকেও দেখেছি, আড়ালে হাম্বুলিকাকা বললেও সামনে শুধু কাকা বলতেন– বুঝেছিলাম, এই নামটা নিয়ে মেজদাদুর একটা অস্বস্তি আছে। মেজদাদু মারা যান আজ থেকে বছর তিরিশ আগে আর তার সঙ্গে হাম্বুলি নামটা চলে যায়। মা-কে মেজদাদুর শোকে কাঁদতে দেখে সান্ত্বনা দিতে গেলে মা দাঁত খিঁচিয়ে ওঠেন– ‘এবার ওঁকে রেহাই দাও– আর হাম্বুলি-হাম্বুলি করা বন্ধ কর।’
……………………………………………….
কালনা গঞ্জ হিসেবে অনেক পুরনো। অনুষ্ঠানে পরবে রান্না করতে উড়িয়া পাচক আসতে আমি ছোটবেলা থেকে দেখেছি– হয়তো মেজদাদুর জন্মের আগে থেকেই সেখানে উড়িয়া পাচকরা আছে। বাঙালি বাড়িতে উড়িয়া পাচক রাখা এক সময় দস্তুর ছিল। শিশু কালী ভট্চাজকে হামাগুড়ি দিতে দেখে কোনও উড়িষ্যাবাসী তার মাতৃভাষায় ‘হাম্বুরি’ বলেছিল– বাচ্ছারা আধো-আধো কথায় ‘র’-কে ‘ল’ বলে থাকে– আর সেভাবেই হাম্বুরি থেকে কালক্রমে মেজদাদুর ডাকনাম হয়ে গিয়েছিল হাম্বুলি।
……………………………………………….
কলেজে ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশনশিপ পড়াতে গিয়ে গতবছরের প্রশ্নপত্রে দেখলাম ‘Red Hot Stove Rule’ নিয়ে প্রশ্ন এসেছিল। ছাত্রছাত্রীদের এই নিয়ে পড়ানোর সময় কর্মক্ষেত্রে যৌনহেনস্থার উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে সহকর্মী শ্বেতা পট্টনায়কের সঙ্গে দেখা। আমার আগে এই বিষয়টা সে পড়াতো। সে বিষয়টা শুনে বলল, তার অধ্যাপক এটা বোঝানোর সময় ‘গুট্টে পিলা হাম্বুরি জ্বলন্ত নেয়ারে হাত্তো দেলা’ বলে বুঝিয়েছিলেন। শুনে চমকে উঠলাম– জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ওটা কী বললে?’ শ্বেতা আমাকে বুঝিয়ে বলল যে, একটা বাচ্চা জ্বলন্ত উনুন দেখে কৌতূহলবশত হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে আগুনে হাত দিলে পরে আর কোনওদিন দেবে না। হামাগুড়ির উড়িয়া হল হাম্বুরি। আমার ৫০ বছর থেকে জমে থাকা প্রশ্নর উত্তর অবশেষে পেলাম।
…………………………………………………..
আরও পড়ুন বিশ্বজিৎ রায়-এর লেখা: রবীন্দ্রনাথ নিয়ে ইয়ার্কি কি বাঙালিরাও করে না?
…………………………………………………..
কালনা গঞ্জ হিসেবে অনেক পুরনো। অনুষ্ঠানে পরবে রান্না করতে উড়িয়া পাচক আসতে আমি ছোটবেলা থেকে দেখেছি– হয়তো মেজদাদুর জন্মের আগে থেকেই সেখানে উড়িয়া পাচকরা আছে। বাঙালি বাড়িতে উড়িয়া পাচক রাখা এক সময় দস্তুর ছিল। শিশু কালী ভট্চাজকে হামাগুড়ি দিতে দেখে কোনও উড়িষ্যাবাসী তার মাতৃভাষায় ‘হাম্বুরি’ বলেছিল– বাচ্ছারা আধো-আধো কথায় ‘র’-কে ‘ল’ বলে থাকে– আর সেভাবেই হাম্বুরি থেকে কালক্রমে মেজদাদুর ডাকনাম হয়ে গিয়েছিল হাম্বুলি। যাঁর এই ডাকনাম, তিনি কোনওদিন জানলেন না এই নাম কোথা থেকে উদয় হয়েছিল, বরং সারাজীবন এই রকম এক উড়িয়া ডাকনাম বয়ে বেড়িয়েছেন কুণ্ঠার সঙ্গে!
মেজদাদুর দুই মেয়ে মেজদাদুর কাছে পৌঁছে গিয়েছে, আমার মা-বাবাও সেখানে। এই নামের রহস্যভেদ যখন হল, তখন মেজদাদুর ডাকনাম জানা মানুষের সংখ্যা হাতে গুনে বলা যায়। কিন্তু সমাধান হল অবশেষে! জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা!
………………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………………