Robbar

হিন্দু কোড বিল-এর বিভিন্ন ধারা নিয়ে খাবার টেবিলে বসে আলোচনা চলেছে সবিতা ও ভীমরাওয়ের

Published by: Robbar Digital
  • Posted:November 30, 2024 6:02 pm
  • Updated:November 30, 2024 6:32 pm  

বিয়ের দু’-চারমাস আগে তাঁকে লেখা ডক্টর আম্বেদকরের চিঠিপত্র পড়ে মনে হয় প্রথম আলাপেই তাঁরা পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, যদিও বিয়ের কথা কেউই ভাবেননি। সারদা তাঁকে বিরাট পণ্ডিত এবং ভারতে জাতি-বর্ণ-লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে লড়ে যাওয়া একজন মানুষ হিসেবে বিশেষ শ্রদ্ধা করতেন। দেশের মানুষের স্বার্থে ডক্টর আম্বেদকরের দীর্ঘ জীবন জরুরি– এটা ছিল সারদার গভীর বিশ্বাস এবং একজন চিকিৎসক-বন্ধু হিসেবে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কতখানি স্বাস্থ্য সংকট ও একাকিত্বের মধ্যে ওই দেশবরেণ্য মানুষটি রয়েছেন।

শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত

৮.

এবারের ‘দোসর’ একটু অন্যরকম। এতদিন লিখেছি সেইসব জুটি/ত্রয়ীদের নিয়ে, যাঁদের আমি কাছ থেকে দেখেছি অথবা আমারই কাছের কোনও মানুষের চোখ দিয়ে তাঁদের সঙ্গে আমার যেন অনেক দিন ধরে নিবিড় পরিচয় ঘটেছে। কিন্তু এবারের সূত্রটা প্রথাগত, তাই লেখার স্বাদটাও একটু আলাদা।   

মাস তিন-চারেক আগে একটা বইয়ের দোকানের তাকে হঠাৎ করে নজর গিয়েছিল বাবাসাহেব  নামের একটি বইয়ের দিকে। প্রচ্ছদে ভীমরাও আম্বেদকরের পরিচিত স্যুট-টাই পরা গম্ভীর চেহারার পাশে এক অপরিচিত মহিলার ছবি দেখে বইটা হাতে নিয়েছিলাম। সবিতা আম্বেদকর তাঁর স্বামীর সঙ্গে কাটানো বছর দশেকের দাম্পত্য জীবন নিয়ে লিখেছেন বইটা। মারাঠিতে প্রথম বেরিয়েছিল ১৯৯০ সালে সবিতার জীবদ্দশায়। দু’-বছর আগে নাদিম খানের করা ইংরেজি অনুবাদ বেরিয়ে পরে। 

117 Savita Ambedkar Image: PICRYL - Public Domain Media Search Engine Public Domain Search}

বইটা কিনে পড়তে শুরু করে দেখি, পরতে পরতে খুলতে লাগল সারু ও রাজার অবাক-করা দাম্পত্য-কথা। ‘সারু’ মানে ডাক্তার সারদা কবীর, বিয়ের পর ভীমরাও যাঁর নাম রাখেন ‘সবিতা’। আর স্বামীর জন্য সারুর আদরের ডাক হল ‘রাজা’। সারুর বয়ানে তাঁদের যৌথজীবন-কথার ফাঁকে ফাঁকে গুঁজে দেওয়া আছে সারুকে লেখা রাজার কয়েকটি চিঠিও। এসবের মধ্যে থেকে ধরা দিচ্ছেন এক অচেনা ও অন্তরঙ্গ ভীমরাও, যাঁর স্ত্রী লিখছেন যে ডক্টর আম্বেদকরের অবয়বে একটা কাঠিন্য/গাম্ভীর্যের ছাপ থাকলেও অন্তরে তিনি ছিলেন পাথরের বুক-চেরা কল্লোলিত ঝরনার মতো! 

সারদা/সবিতা তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী রমাবাই, যাঁর সঙ্গে ১৫ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল ভীমরাওয়ের, দীর্ঘ অসুস্থতার পর মারা যান ১৯৩৫ সালে। ততদিনে তাঁরা পাঁচটি ছেলেমেয়ের মধ্যে চারজনকেই হারিয়েছেন। একমাত্র জীবিত সন্তান ছিলেন বড় ছেলে যশবন্ত। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর ১৩ বছর পরে ১৯৪৮ সালের এপ্রিলে, সারদা কবীরের সঙ্গে যৌথজীবন শুরু হয় বাবাসাহেব আম্বেদকরের। 

117 Savita Ambedkar Image: PICRYL - Public Domain Media Search Engine Public Domain Search}

১৯৩৭ সালে বম্বের গ্রান্ট মেডিকাল কলেজ থেকে পাশ করে সারদার ততদিনে পুরোদস্তুর ডাক্তারি করা হয়ে গিয়েছে বছর দশেক। ডাক্তার মেয়েটির পরিবার ছিল খুবই ব্যতিক্রমী– সে যুগে মেয়েকে ডাক্তারি পড়িয়ে জীবিকা অর্জনের স্বাধীনতা দিয়েছিল বলেই শুধু নয়, সারস্বত ব্রাহ্মণ বংশোদ্ভূত মেয়েটির সঙ্গে মাহার পরিবারের ছেলেটির বিয়ে সমর্থন করেছিল বলে– যা এখনও অতি বিরল ঘটনা। সারদার আট ভাইবোনের মধ্যে মোট ছ’-জন অসবর্ণ বিয়ে করেছিলেন। 

যাই হোক, সারদার সঙ্গে ভীমরাওয়ের আলাপ হয় বম্বের বর্ষীয়ান চিকিৎসক ডাক্তার এস. এম. রাওয়ের বাড়িতে এবং সেই পরিচয় গভীর হয় আরেক ডাক্তার মাভালাঙ্কারের চেম্বারে, যাঁর কাছে সে সময়ে প্রৌঢ় ও নানা রোগক্লিষ্ট, বড়লাটের  এগজিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য তথা শ্রমমন্ত্রী, ডক্টর আম্বেদকর নিয়মিত যেতেন চিকিৎসা করাতে। ডাক্তার মাভালাঙ্কারের সহকারী হিসেবে কাজ করার সুবাদে সারদা ওই পর্বে ভীমরাওয়ের চিকিৎসাও করেছেন অনেকটা।   

বুদ্ধের মূর্তি নিয়ে ভীমরাও ও সবিতা আম্বেদকর। নাগপুরের ধম্মদীক্ষা সম্মেলনে। ১৯৫৬

তাঁদের বিয়ের সময় ভীমরাও স্বাধীন ভারতের প্রথম আইন মন্ত্রী ও সংবিধান রচনার ড্রাফটিং কমিটির চেয়ারপারসন। কিন্তু সবিতা আম্বেদকরের লেখা থেকে জানা যায়, ততদিনে ডক্টর আম্বেদকরের স্বাস্থ্য ভেঙে গেছে এবং সঙ্গ দেওয়ার, ভালোবাসার ও যত্ন নেওয়ার মতো আপনজন কেউ নেই। বিয়ের দু’-চারমাস আগে তাঁকে লেখা ডক্টর আম্বেদকরের চিঠিপত্র পড়ে মনে হয় প্রথম আলাপেই তাঁরা পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, যদিও বিয়ের কথা কেউই ভাবেননি। সারদা তাঁকে বিরাট পণ্ডিত এবং ভারতে জাতি-বর্ণ-লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে লড়ে যাওয়া একজন মানুষ হিসেবে বিশেষ শ্রদ্ধা করতেন। দেশের মানুষের স্বার্থে ডক্টর আম্বেদকরের দীর্ঘ জীবন জরুরি, এটা ছিল সারদার গভীর বিশ্বাস এবং একজন চিকিৎসক-বন্ধু হিসেবে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কতখানি স্বাস্থ্য সংকট ও একাকিত্বের মধ্যে ওই দেশবরেণ্য মানুষটি রয়েছেন।

 

ডাক্তার ঘরণী পেলে তাঁর চিকিৎসা ও যত্নআত্তি ঠিকমতো হবে, অনেকটা সেই কারণে ৫৭ বছরের ভীমরাও ৩৯ বছরের সারদাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন বলা যেতে পারে। আবার এটাও স্পষ্ট যে, নিঃসঙ্গ মানুষটির গভীর আকুতি ছিল সারদার মতো একজন শিক্ষিত সমমনস্ক মানুষের সঙ্গলাভের, ভালোবাসার। তা নইলে বিয়ের মাসখানেক আগে লেখা একটা চিঠিতে তিনি কেন বলবেন, ‘গত পনেরো বছর ধরে আমি নিঃসঙ্গ জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম, ভালোই ছিলাম। তাহলে আজ কেন এত একা লাগছে? কারণ এখন সারু আছে। যখন সারু আসে নি আমার জীবনে, আমি একা ছিলাম কিন্তু এতটা সঙ্গীহারা বোধ করি নি। আজ সারু আছে কিন্তু তাঁকে এখনো কাছে পাচ্ছি না। ভাবছি তুমিও কি ও প্রান্তে আমার মতো কষ্ট পাচ্ছ।’ (বাবাসাহেব: মাই লাইফ উইথ ডক্টর আম্বেদকার ; ভিন্টেজ, ২০২২)।  

Babasaheb: My Life With Dr Ambedkar : Ambedkar, Savita: Amazon.in: Books

১৯৫৬ সালের ডিসেম্বরে ডক্টর আম্বেদকরের মৃত্যু পর্যন্ত, তাঁদের দু’জনের ন’বছরের বিবাহিত জীবনে সারু ও ভীমরাও কীভাবে পরস্পরের দোসর হয়ে উঠেছিলেন, দুর্ভাগ্যবশত সেই দিকটা নিয়ে সবিতা আম্বেদকার বিশদে লেখেননি। এমনকী, হবু স্বামীকে লেখা তাঁর একটি চিঠিও এই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করেননি তিনি। সব চিঠিগুলোই বাবাসাহেবের লেখা। আর সবিতার লেখনীর বেশিটা জুড়েই রয়েছে তাঁর স্বামীর শরীর-স্বাস্থ্যের অবনতির কথা এবং একজন চিকিৎসক-স্ত্রী রূপে তিনি ধারাবাহিকভাবে কী কী করেছেন ডক্টর আম্বেদকরকে যথাসম্ভব সুস্থ রাখার, তার প্রমাণ রাখাটা হয়ে উঠেছে মুখ্য। 

সেটা আশ্চর্যের কিছু নয় যখন জানতে পারি, রাজনীতির জগতে ও দলিত আন্দোলনের ক্ষেত্রে বাবাসাহেবের কিছু শিষ্যস্থানীয় ব্যক্তি এই বিয়েটা ভালোভাবে মেনে নেননি। একজন ব্রাহ্মণ কন্যাকে মেনে নিতে তাঁদের অনেকের অসুবিধা ছিল। বাবাসাহেবের প্রয়াণের পর দলিত আন্দোলন থেকে তাঁর ব্রাহ্মণ বংশোদ্ভূত স্ত্রীকে, যিনি স্বামীর সঙ্গে একযোগে কয়েক বছর আগেই বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন, সরিয়ে রাখার প্রবল চেষ্টা হয়। অথচ ১৯৫২-র প্রথম সাধারণ নির্বাচনে যখন আম্বেদকর প্রতিষ্ঠিত শেডিউলড কাস্ট ফেডেরেশনে অংশ নেয়, তখন সবিতা সেই দলের নির্বাচনী পরিকল্পনায় সক্রিয় ছিলেন। সবিতার প্রস্তাব অনুযায়ীই দলের নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে একটি হাতির ছবি গৃহীত হয়েছিল।  

যাঁরা সবিতার বিরুদ্ধে ছিলেন, আম্বেদকরের মৃত্যুর জন্যেও সবিতাকে দায়ী করেছিলেন তাঁরা। কেউ কেউ অভিযোগ করেছিলেন ডক্টর আম্বেদকরের ভুল চিকিৎসা করেছেন তাঁর স্ত্রী, আবার কেউ কেউ আরও এক ধাপ এগিয়ে এটা মৃত্যু না হত্যা সেই প্রশ্নও তুলেছিলেন। এরপর কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক থেকে একটি বোর্ড গঠন করে ডক্টর আম্বেদকরের মৃত্যুর কারণ তদন্ত করা হয় এবং লোকসভাতেও এই নিয়ে কিছুদিন চাপান-উতোর চলে। শেষ পর্যন্ত সমস্ত অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলেও, স্বামীর মৃত্যুর পর সবিতার হেনস্তা চলেছিল বেশ কিছু বছর।  

ভীমরাও আম্বেদকরের বই ও মূর্তির সামনে সবিতা আম্বেদকর

তাই হয়তো বিবাহিত জীবনে সাহচর্যের দিকটা নিয়ে সবিতা লিখেছেন অনেক কম, সেবার দিকটার কথাই বেশি। তবু যেটুকু লিখেছেন তা থেকে দেখি যে, নভেম্বর ১৯৪৮-এ ডক্টর আম্বেদকর গণ পরিষদে সংবিধানের খসড়া পেশ করার আগের মাসগুলোয় যখন দিনরাত এক করে কাজ করছেন, বিয়ের সেই প্রথম বছরে বাড়ির খাবার টেবিলে বসে সবিতার সঙ্গে তাঁর আলোচনা চলছে সংবিধানের বিভিন্ন ধারা নিয়ে। তারপর যখন হিন্দু কোড বিল-এর প্রস্তাবনা তৈরি হচ্ছে, সেই পর্বের কথা বলতে গিয়ে সবিতা লিখছেন, ‘‘আমি সবসময় মেয়েদের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলতাম এবং হিন্দু কোড বিল নিয়ে জোরের সঙ্গে আমার বহু মতামত রেখেছি। ডক্টর সাহেবের সেগুলোর প্রতি উৎসাহ ও পূর্ণ সমর্থন ছিল। আমি কোনোদিন মঙ্গলসূত্র পরিনি বিবাহিত নারীর চিহ্ন প্রদর্শনের জন্য। ওঁর উপহার দেওয়া পেন্ডেন্ট-সহ একটি সোনার চেন পড়তাম। পেন্ডেন্টটা ছিল নোঙর আকৃতির… হিন্দু কোড বিল-এ মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার, বিবাহ-বিচ্ছিণ্ণা মেয়েদের খোরপোষ পাওয়ার অধিকার, এসবের পক্ষে আমি বারবার সওয়াল করেছি।’’ সওয়ালগুলো হয়েছে স্ত্রী-স্বামীর মধ্যে, সংসদে নয়। তবে তাঁর লেখায় যেভাবে যুক্তি দিয়ে এই বিল প্রসঙ্গে বিশদ মতামত রেখেছেন সবিতা, তাতে বুঝতে অসুবিধা হয় না হিন্দু কোড বিল নিয়ে নিয়মিত আদানপ্রদান হত তাঁদের দু’জনের মধ্যে বাড়িতেই। 

ডক্টর আম্বেদকরের মৃত্যুর কয়েক বছর পর সবিতার কাছে প্রস্তাব এসেছিল কংগ্রেস দলের পক্ষ থেকে রাজ্যসভার সদস্য হওয়ার। কিন্তু যে রাজনৈতিক দলের কাছে সবিতার স্বামী বারবার অপমানিত হয়েছেন, তাদের মনোনয়নে সংসদ হয়ে বাবাসাহেবকে অশ্রদ্ধা করার কথা তিনি ভাবতেই পারেননি। বরং স্বামীর মৃত্যুর পর যে ৪৫-৪৬ বছর তিনি বেঁচেছিলেন, তার বেশিরভাগটাই কাটিয়েছেন ডক্টর আম্বেদকরের মতাদর্শ ও বিশ্বাসকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে—বাবাসাহেব আম্বেদকর ফাউন্ডেশান গঠন করে, বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শন প্রচারে, দলিত মানুষের পাশে থেকে, নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার কাজে। 

…পড়ুন দোসর-এর অন্যান্য পর্ব…

পর্ব ৭। সেই আলোভরা দিনের খোঁজে তিন কমরেড

পর্ব ৬। যে তিন ‘অনাত্মীয়’ মেয়ে সংসার পেতেছিলেন দিগন্ত-রেখায়

পর্ব ৫। উমাদি-চিনুদা-নিরঞ্জনবাবুর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল গভীর মনের মিল ও মতাদর্শ ঘিরে

পর্ব ৪। যাঁদের ‘ইমেজ’ ধরে রাখার ব্যাপার নেই, পার্টনার-ইন-ক্রাইম হয়ে ওঠার মজা আছে

পর্ব ৩। বাণী-শ্যামলীর প্লাস্টার অফ প্যারিসে ঢালাই হওয়া বন্ধুত্ব 

পর্ব ২। অমলেন্দুকে বিয়ে করেও সিঁদুর পরেননি কেন— ইন্টারভিউতে শুনতে হয়েছিল নাসিমাকে

পর্ব ১। ‘গীতাঞ্জলি’ আসলে বাংলা অনুবাদে বাইবেল, এই বলে জাপানিদের ধোঁকা দেন সুহাসিনী