এই প্রজন্মের একজন শিল্পী হয়ে, প্রধানত ২০২৩-এর একজন মহিলা হয়ে আমি মোটেই বিশ্বাস করি না যে, একজন মহিলার দায়িত্ব বাড়ির সকল কাজ সেরে তারপর বাইরে ‘নিজের’ কাজ করতে যাওয়া। আমি বিশ্বাস করি প্রত্যেকের তাঁদের সামর্থ্য ও ইচ্ছে অনুযায়ী কাজ করা উচিত। নিজেদের প্রতিভাকে একশো শতাংশ গুরুত্ব দিয়ে। কিন্তু, তিনি যে পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করেছেন, তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা রয়েছে।
কিংবদন্তি গায়িকা সুচিত্রা মিত্র-কে নিয়ে কিছু বলার যোগ্যতা অর্জন করিনি আমি। আমি এই প্রজন্মের একজন গায়িকা। গান ভালবাসি। গান শোনার ব্যাপারে আমার বিচরণক্ষেত্র অবাধ। রবীন্দ্রসংগীতে সুচিত্রা মিত্র, দেবব্রত বিশ্বাস, এঁদের যেমন ভক্ত আমি, তেমনই এখনকার স্বনামধন্য শিল্পীরা আমাকে মোহিত করেন।
সুচিত্রা মিত্র-র জন্মকাহিনির মতোই, অন্যরকম তাঁর গানের স্বকীয়তা। ঝাড়খণ্ডের ডিহিরী জংশন লাইনে শালবন ঘেরা এক রেলস্টেশনের কাছে, ট্রেনের কামরায় জন্ম তাঁর। খুব অল্পবয়সে সংগীতশিক্ষায় হাতেখড়ি। বাড়িতে গানের পরিবেশ ছিল। তাঁর বাবা-মা সকলেই সংগীতে পারদর্শী ছিলেন। সংগীতের প্রতি পরিবারের এই গভীর অনুরাগ প্রবাহিত হয় শিল্পীর অন্তরের অন্তঃস্থলে। আমি নিজে সংগীতপ্রেমী পরিবারের সদস্য হওয়ায় প্রথিতযশা এই শিল্পীর বাল্যজীবনের সঙ্গে একাত্ম অনুভব করি।
শিল্পীর সংগ্রামী জীবন আমার অনুপ্রেরণা। রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা, এমনকী, ব্রিটিশ পুলিশের হাতে মার খাওয়াও বাদ যায়নি তাঁর জীবনের ইতিহাসে। এমন সংগ্রামী মানুষ বলেই হয়তো এমন দরাজ, উদাত্ত, বলিষ্ঠ গায়কি। ব্যক্তিজীবনেও তিনি ঠিক এমনই লড়াকু, পরিশ্রমী। কোনও একটা লেখায় পড়েছিলাম, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় একটি গানের অনুষ্ঠানে ক্লান্তদর্শন সুচিত্রা মিত্রকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘সুচিত্রা, তোমার কি শরীর খারাপ?’ তিনি উত্তর দেন, ‘দ্বিজেন, এমন শরীর খারাপ আমার রোজই থাকে। কারণ আমি রান্না করে, বাসন মেজে, ঘর গুছিয়ে তবে গাইতে আসি। তোমাদের মতো ফুলবাবু জীবন আমার নয়।’
তবে এই প্রজন্মের একজন শিল্পী হয়ে, প্রধানত ২০২৩-এর একজন মহিলা হয়ে আমি মোটেই বিশ্বাস করি না যে, একজন মহিলার দায়িত্ব বাড়ির সকল কাজ সেরে তারপর বাইরে ‘নিজের’ কাজ করতে যাওয়া। আমি বিশ্বাস করি প্রত্যেকের তাঁদের সামর্থ্য ও ইচ্ছে অনুযায়ী কাজ করা উচিত। নিজেদের প্রতিভাকে একশো শতাংশ গুরুত্ব দিয়ে। কিন্তু, তিনি যে পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করেছেন, তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা রয়েছে। তবে যেটা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল, তা হচ্ছে ওঁর এই স্পষ্ট কথা স্পষ্টভাবে বলার মানসিকতা এবং শিল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকার এক অদম্য ইচ্ছে। আমি বেশ কিছু কারণে ছোটবেলা থেকে মুগ্ধ হয়েছিলাম এবং একাত্ম বোধ করেছিলাম এই শিল্পীর সঙ্গে। বাড়িতে গানের পরিবেশ যেমন একটি কারণ, সেরকমই কিছু কোইন্সিডেন্স আছে বলা যেতে পারে, যা উল্লেখযোগ্য কিংবা গুরুত্বপূর্ণ সেভাবে না হলেও অল্পবয়সি আমি-কে তা আনন্দ দিয়েছিল। যেমন, তাঁর স্বামীর নাম ধ্রুব এবং ঘটনাচক্রে আমার জীবনে সংগীতের অনুপ্রেরণা এবং শিক্ষা আমি পেয়েছি আমার বাবার থেকে– যাঁর নামও ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়।
সুচিত্রা মিত্র শুধু গায়িকা ছিলেন না, তিনি লিখতেন, ছবি আঁকতেন, এমনকী ঋতুপর্ণ ঘোষের একটি ছবিতে অভিনয় পর্যন্ত করেছেন। এর মধ্যে প্রত্যেকটি শিল্পের সঙ্গেই আমি যুক্ত থাকতে ভালবাসি। ভাল কি মন্দ– কতটা দক্ষতা, তা আমি জানি না, তবে করি। ভালোবেসে চর্চা করি। কাজেই অজান্তেই এই শিল্পী আমাকে বিভিন্নভাবে উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং প্রেরণা দিয়েছেন।
তাঁর জন্মদিনে আমার বুক ভরা শ্রদ্ধা রইল। এরকমই নতুন প্রজন্মের জীবনে আলোর দিশারি হয়ে থাকুন।