টেস্ট ম্যাচে স্পিন বোলারের একটা উইকেট দেখতে গেলে তার আগাপাশতলা দেখতে হবে। শুধুমাত্র তার উইকেট দেখলে হিমশৈলের চূড়াটুকু দেখলেন মাত্র। দেখতে হবে, সে কীভাবে একজন ব্যাটসম্যানের চারপাশে জাল বিস্তার করছে। কীভাবে আগের ওভারে চার খেয়েও এই ওভারে বলের লুপ আরও বাড়িয়ে দিল, কেন দিল। এ অনেকটা শাস্ত্রীয় সংগীতের মতো, অধৈর্য হলে চলবে না। সেই হিসেবে অশ্বিন একজন পণ্ডিত বা উস্তাদের চেয়ে কম কিছু নয়। তাই তাঁর বিস্তার, সমে ফেরা দেখে টিভি চাপড়ায়নি, এমন ক্রিকেট সমঝদার কমই আছে।
আজ আমার রিচারড বাক-এর লেখা ‘জোনাথন লিভিংস্টোন সিগাল’ গল্পটা মনে পড়ছে। শৈশবে আমাকে নাড়িয়ে দিয়ে যাওয়া একটা বই। জোনাথন ছিল একটি সিগাল। কিন্তু সে ছিল বাকি সিগালদের থেকে আলাদা, কারণ তার মনে প্রশ্ন ছিল, ছিল কৌতূহল। সে বাকি সিগালদের মতো শুধুমাত্র ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য আকাশ থেকে ছোঁ মেরে মাছধরাই জীবনের একমাত্র ব্রত করেনি। হ্যাঁ, সে মাছ ধরবে, কিন্তু সেটাই তার জীবনের একমাত্র ব্রত হবে না। সে বাকি পাখিদের মতো উড়তে চায়। একটা চিল কী করে আকাশের দোতলায় বাড়ি বানায়, তাও তাকে শিখতে হবে এই সিগাল জীবনেই।
জোনাথনকে তার সঙ্গী সিগালরা সমাজচ্যুত করে কারণ, সে সিগাল হয়েও নতুন নতুন ওড়া শিখতে চায়। তাও একলা সে তার শেখার সাধনা চালিয়ে যায়। বয়স হয়, আসে মৃত্যু। মৃত্যুর সময় সে জানতে পারে, তার আজীবন সাধনায় খুশি হয়ে ঈশ্বর তাকে স্বর্গে জায়গা দিয়েছেন। কিন্তু স্বর্গে গিয়ে জোনাথন দেখে, তার এতদিনের অধীতবিদ্যা কোনও কাজে লাগছে না। তার উড়তে রীতিমতো কষ্ট হচ্ছে, তখন সে স্বর্গের আরেকটি পাখিকে জিগ্যেস করে, ‘আমি তো এখন স্বর্গে, তাহলে আমার উড়তে গিয়ে এত নতুন নতুন লাগছে কেন?’ পাখিটি প্রত্যুত্তরে বলে, ‘তুমি তো এটাই চেয়েছিলে জোনাথন, তাই তোমাকে আবার সুযোগ দিয়েছে নতুন করে শেখার জন্য, তুমি কি ভেবেছিলে, স্বর্গে সব সহজ হয়ে যাবে? মনে রেখো জোনাথন, স্বর্গ কোনও জায়গা নয়, স্বর্গ কোনও সময় নয়, স্বর্গ নিজেকে শ্রেষ্ঠতর করার আরেকটা সুযোগ মাত্র।’
আমরা যারা রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে এত বছর ধরে সামনে থেকে দেখছি, তারা কি জোনাথনকে চিনতে পারছি না? স্টিভ ওয়া-র আত্মজীবনীর নাম ‘আউট অফ মাই কমফোর্ট জোন’। কারণ, স্টিভ ওয়া বিশ্বাস করেন, জীবন শুরু হয় কমফোর্ট জোনের বাইরে। অশ্বিনের ক্রিকেট দর্শনও তো তাই। নিজেকে নিয়ে একটার পর একটা পরীক্ষা চালিয়ে গিয়েছেন। যখন তার পক্ষে যথেষ্ট সহজ ছিল নিজের বোলিং নিয়ে একটা নিরাপদ বৃত্তে ঢুকে পড়া, কিন্তু অশ্বিন তা করেননি। নিজেকে নিরন্তর পরীক্ষার মধ্য দিয়ে নিয়ে গেছেন। রোজ নতুন কিছু করার চেষ্টা করেছেন নিজের বোলিং নিয়ে। ক্যারম বল, কখনও রান আপে থমকে দাঁড়িয়ে পড়া– আরও নানা কিছু। এত কিছু কিন্তু খেলাটাকে ভালোবেসে। কখনও অতিরিক্ত পরীক্ষার জন্য বিশেষজ্ঞর দ্বারা তিরস্কৃতও হয়েছেন, কিন্তু অশ্বিনের মস্তিষ্ক খেলা নিয়ে ভাবনা থামাতে পারেনি। আর সেই ভাবনা থেকে কখনও হাশিম আমলা ক্রিজের মধ্যে বেকুবের মতো তাকিয়ে থেকেছে– কোথা থেকে যে কী হইয়া গেল বুঝতে না পেরে! কখনও ওয়ার্নার চামুচে করে ‘কট অ্যান্ড বোল্ড’ উপহার দিয়ে প্যাভিলিয়নের পথ ধরেছে। সাড়ে সাতশোর ওপর আন্তর্জাতিক উইকেট তিন ফরম্যাট মিলিয়ে, এটা শুধু প্রতিভার ফসল নয়, তার সঙ্গে আছে হার না-মানা অদম্য মনোভাব, জেদ, পরিশ্রম, ঘাম এবং অধ্যবসায়।
দেখুন, টেস্ট ম্যাচে স্পিন বোলারের একটা উইকেট দেখতে গেলে তার আগাপাশতলা দেখতে হবে। শুধুমাত্র তার উইকেট দেখলে হিমশৈলের চূড়াটুকু দেখলেন মাত্র। দেখতে হবে, সে কীভাবে একজন ব্যাটসম্যানের চারপাশে জাল বিস্তার করছে। কীভাবে আগের ওভারে চার খেয়েও এই ওভারে বলের লুপ আরও বাড়িয়ে দিল, কেন দিল। এ অনেকটা শাস্ত্রীয় সংগীতের মতো, অধৈর্য হলে চলবে না। সেই হিসেবে অশ্বিন একজন পণ্ডিত বা উস্তাদের চেয়ে কম কিছু নয়। তাই তাঁর বিস্তার, সমে ফেরা দেখে টিভি চাপড়ায়নি, এমন ক্রিকেট সমঝদার কমই আছে।
মাঠের বাইরে অত্যন্ত সুভদ্র এই ব্যক্তিটি মাঠের ভিতর এক ইঞ্চি জমি কাউকে ছেড়েছে বলে দেখা যায়নি। অশ্বিনের মানকাডিং নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, কিন্তু আমার তো ভুল কিছু মনে হয়নি। আইপিএল এমনিতেই বোলারদের প্রতি নির্দয়, সেখানে জস বাটলার যদি বোলিং ক্রিজকে পৈত্রিক গোলাপবাগান ভেবে এলোমেলো পায়চারি করতে বেড়িয়ে যান, তার দায় অশ্বিনের ওপর কেন বর্তাবে! অশ্বিনের চোখে যে আগুন দেখতে পাওয়া যায়, তা অনেক পেস বোলারের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় না।
আপনারা অশ্বিনের পডকাস্ট চ্যানেল ‘কুট্টি স্টোরিজ’ দেখেছেন? না দেখে থাকলে দেখুন, ক্রিকেট নিয়ে রসে, অ্যানেকডোটসে, মজায় পরিপূর্ণ একটা শো। এবং সেখানে সঞ্চালক হিসেবে অশ্বিন যে কোনও পেশাদার সঞ্চালকের সঙ্গে টক্কর দিতে পারেন। আসলে কিছু মানুষ থাকেন, তাঁরা যাতেই হাত দেন তাতে নিজের শ্রেষ্ঠটা দেবেন বলেই হাত দেন, রবিচন্দ্রন অশ্বিন তাঁদের মধ্যে একজন। না-হলে অশ্বিনের ব্যাট হাতে অবদান ভাবুন একবার। ছ’টা টেস্ট সেঞ্চুরি, আর অজস্র ম্যাচ-বাঁচানো ইনিংস। ‘বুক চিতিয়ে ব্যাট’ যাকে বলে। অশ্বিন বোলার হিসেবে শুরু করলেও তিনি নিজের কৃতিত্বে এ দেশের একজন অন্যতম অলরাউন্ডার হিসেবে ক্যারিয়ার শেষ করলেন। এ কিন্তু কম বড় কৃতিত্ব নয়। এর নেপথ্যে কী? সেই অদম্য জেদ। টিম পেন যখন আউট করতে না পেরে পিছন থেকে স্লেজ করে– ‘তোমাকে তো টিমের কেউ ভালোবাসে না’, অশ্বিন ব্যাট থামিয়ে শুধু বলেন, ‘তুমি কথা বলা শেষ কর, তারপর আমি ব্যাট করছি।’ এবং তারপর নট আউট থেকে টেস্ট ড্র করিয়ে ফিরেছিল।
জোনাথনের গল্পটা শেষ করি। জোনাথন নিজের চেষ্টায় আবারও নানাভাবে উড়তে শুরু করে, অচিরেই তার ওড়ার দর্শন, জীবনবোধ একদল ভক্তের জন্ম দেয়, যারা ঈশ্বর-জ্ঞানে জোনাথনের পুজো করতে শুরু করে। এক সময় জোনাথনের স্বর্গ থেকে যাওয়ার সময় হয়। তখন জোনাথন নিজের ভক্তদের কাছে ডেকে বলে, ‘কাউকে আমার গল্প বললে বোলো না আমি ঈশ্বর’, ভক্ত জিগ্যেস করে, ‘তাহলে কী বলব আপনার সম্বন্ধে?’ জোনাথন যাওয়ার আগে বলে, ‘বোলো, আমি চেষ্টা করেছিলাম।’
অশ্বিন সম্বন্ধেও এটাই বলার।
……………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………….
যথাসম্ভব নো মেকআপ লুক নিয়ে ফ্লোরে গিয়ে বসলাম আমার নির্দিষ্ট জায়গায়। তরুণ চক্রবর্তী ঢুকল। অন্যান্য দিন কুশল বিনিময় হয়, আজ কেবল স্তব্ধতা। শুরু করলাম অধিবেশন, চিরাচরিত হাসিটি আজ মুখে নেই। তারপরেই তরুণের মুখে উচ্চারিত হল প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর নিহত হওয়ার সংবাদ। ঘোষিত হল রাষ্ট্রীয় শোক।