রুশদি লিখছেন: অনেকে ভাবলেন, এক চোখ নিয়ে আমার লেখাও বদলে যাবে। বদলে যাবে লেখার বিষয়। পাল্টে যাবে লেখার স্টাইল। লেখার টেবিল কিন্তু আমাকে বলল, তোমার লেখার বিষয়, তোমার লেখার স্টাইল এই সবের ওপর তোমার শারীরিক ক্ষতির কোনও প্রভাব পড়বে না। ওই সব নিয়ে তুমি ভেবো না। কিন্তু একটি জরুরি কাজ তোমাকে করতেই হবে। তোমাকে আরও একবার ফিরে যেতে হবে সেই হামলার জায়গায়। সেই দুঃস্বপ্নের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াতে হবে আরও একবার। তবে তুমি মুক্তি পাবে সেই ছায়া থেকে। নিজেকে ফিরে পাবে সম্পূর্ণভাবে।
২০.
২০২২-এর ১২ আগস্ট। আমেরিকার Chautauqua Institution। সলমন রুশদি উঠে দাঁড়ালেন ভাষণ দেবার জন্য। তাঁর বক্তব্যের বিষয়, লেখকদের ওপর বিচিত্র হামলা থেকে কী করে তাঁদের রক্ষা করা যায়? আর তখুনি নিয়তির আবির্ভাব হল দুর্বার উপহাস রূপে। রুশদি দেখতে পেলেন, এক তাজা তরুণ তীব্র বেগে ছুটে আসছে তার দিকে। পোশাক তার ঘনঘোর কালো। মুখে তার কালো মুখোশ। হাতে তার শানানো ছুরি। রুশদির মন বলে উঠল, তাহলে তুমি এলে শেষপর্যন্ত সেখানেই যেখানে সবথেকে কম আশা করেছিলাম তোমাকে!
এই ঘটনার তেরো মাস পরে।
রুশদি তাঁর লেখার টেবিলের সামনে। তাঁর একটি চোখ উপড়ে নিয়েছে সেই কালো পোশাক আর কালো মুখোশে মুখ ঢাকা ধর্মান্ধ যুবক। তাঁর সর্বাঙ্গ ছিন্নভিন্ন ছুরির আঘাতে আঘাতে। তিনি কি আর একই মানুষ আছেন? শরীর আর মনের এই অবস্থায় আবার কি লিখতে পারবেন?
লেখার টেবিল সলমন রুশদির মনের মধ্যে কথা বলে উঠল: It is not fiction or myth. But a true story. About the Nawab of Pataudi and the game of cricket. Monsoor Ali Khan, the Nawab, known as Tiger, a one-eyed batsman, could face upto the bowling of such fearsome fast bowlers as Hall and Griffith of the West Indies, you Salman Rushdie should be able to manage to pour water into a glass without spilling it, cross sidewalks without colliding with other pedestrians and in general succeed at being functional as a one-eyed man in a two-eyed world.
তবু রুশদির মনে সংশয়, ঝাপসামি এবং প্রশ্ন: Who am I? Am I the same person as I was on August 11, or am I now another?
আরও একটি অদ্ভুত জিজ্ঞাসা এল রুশদির মনে, ওপরের প্রশ্নগুলির সূত্রে। তাঁর মনে হল, এই আত্মানুসন্ধান তাঁকে জুড়ে দিয়েছে দার্শনিক নিৎসের সঙ্গে। নিৎসে চোখে তখন প্রায় একদম দেখতে পাচ্ছেন না, মায়োপিয়া গ্রাস করেছে তাঁর দৃষ্টি। তখন তিনি বললেন, ‘shortsightedness has changed my way of writing!’
রুশদি লিখছেন: অনেকে ভাবলেন, এক চোখ নিয়ে আমার লেখাও বদলে যাবে। বদলে যাবে লেখার বিষয়। পাল্টে যাবে লেখার স্টাইল। লেখার টেবিল কিন্তু আমাকে বলল, তোমার লেখার বিষয়, তোমার লেখার স্টাইল এই সবের ওপর তোমার শারীরিক ক্ষতির কোনও প্রভাব পড়বে না। ওই সব নিয়ে তুমি ভেবো না। কিন্তু একটি জরুরি কাজ তোমাকে করতেই হবে। তোমাকে আরও একবার ফিরে যেতে হবে সেই হামলার জায়গায়। সেই দুঃস্বপ্নের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াতে হবে আরও একবার। তবে তুমি মুক্তি পাবে সেই ছায়া থেকে। নিজেকে ফিরে পাবে সম্পূর্ণভাবে।
সলমন রুশদি লিখছেন: থার্টিন মন্থস আফটার দ্য অ্যাটাক আমি ফিরে গেলাম সেই হামলার জায়গায়। আমার স্ত্রী এলিজা বলল, তোমাকে আর একলা যেতে দেব না। সঙ্গে আমি যাব। আমার স্ত্রী আর আমি গিয়ে পৌঁছলাম ঠিক সেই মঞ্চের ওপর, যেখানে ভাষণ দিতে উঠে দাঁড়াতে আমার দিকে ছুরি হাতে রকেটের মতো ছুটে এল কালো পোশাক আর মুখোশ পরা সেই যুবক। আমার স্ত্রীকে দেখালাম, মঞ্চের কোথায় ছিলাম আমি, যে মঞ্চ আজ একেবারে শুনশান। আর দেখালাম, ঘাতক প্রেক্ষাগৃহের কোন আসন থেকে কোন পথে আমাকে হত্যা করার জন্য ছুটে এসেছিল। তারপর বললাম, ছুরি খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম আমি ঠিক এইখানে। চিত হয়ে পড়ে ছিলাম। আমার বুকের ওপর চেপে বসে ছিল কয়েক সেকেন্ড। তিরিশ বার ছুরি মারল। আমি ভাগ্যবান এতবার ছুরি খেয়ে বেঁচে আছি। আসলে একবার ছুরি মেরে একটা মানুষকে কীভাবে মেরে ফেলা যায়, ওই যুবকের সেই ট্রেনিং ছিল না! আমার স্ত্রী আচমকা বলল, ‘It’s so beautiful here.’ আমি বললাম, “I’ve thought a lot about the dissonance between the beauty and the peacefulness of the place and the ugly violence of the event. Somehow the gorgeousness of the setting makes the crime even more shocking.”
আমি এলিজার চোখের সামনে সেদিনের দৃশ্যটা, ঘটনাটা আরও প্রত্যক্ষ করে তুলতে চাইলাম। বললাম, ‘There were two chairs, for Henry and me, approximately here and here and the microphone was over there. And when I first saw him, he must have jumped up from a seat about halfway up on the right. There. And he ran fast and came up these steps. Here. Right here. I was doing what I had imagined and needed to do : standing up on the spot, the exact spot, where I had fallen down.’
ক্রমশ বুঝতে পারছি, এলিজা এতটা আর নিতে পারছে না। তার এবার কষ্ট হচ্ছে। অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। পরস্পরের হাত নিবিড় করে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ওই স্পর্শটাই ছিল আমাদের না-বলা কথা: “It’s okay. It’s good that we came. We’re together. I love you. I love you too. This was important to do.”
কিছুক্ষণ লাগল আমার ভিতরে কী হচ্ছে অনুভব করতে। তার আগে অবশ্য এলিজা আর আমি পরস্পরকে গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরলাম, ‘telling each other wordlessly that we were there for each other, that we had come through the nightmare. It would have been completely different, sadder, less of an affirmation, less restorative, if I had been there alone.’
আকস্মিক একটা ভার নেমে গেল মন থেকে। অন্তর হালকা হল। টেবিলটার মনের কথা বুঝে ভাগ্যিস ফিরে ছিলাম দুঃস্বপ্নের জায়গায়। টেবিলটা, আমার লেখার টেবিল তো এটাই চেয়েছিল, ‘I would make my peace with my life.’ সেটা হয়তো হত না, আমি আমাকে হত্যার একেবারে নির্দিষ্ট স্পটে ফিরিয়ে না আনলে! টেবিলটার আদেশ মতো আমি তো দাঁড়িয়েছি, ‘where I had almost been killed, wearing my new Ralph Lauren suit.’ এলিজা ঠিক সেই মুহূর্তে বলল, ‘I could see that this was good for you and that made it good for me too.’ আর আমি আমার হত্যার শূন্য মঞ্চে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘Yes, we have reconstructed our happiness, even if imperfectly.’ সে হেসে বলল, “We’re done here. Let’s go home.”
আমি মনে মনে বললাম, ফিরে আসছি লেখার টেবিল। তোমার কাছে।
……………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………..
…………………….. পড়ুন কাঠখোদাই-এর অন্যান্য পর্ব ……………………
পর্ব ১৯: প্রতিভা প্রশ্রয় দেয় অপরাধকে, দস্তয়েভস্কিকে শেখায় তাঁর লেখার টেবিল
পর্ব ১৮: বিবেকানন্দের মনের কথা বুঝতে পারে যে টেবিল
পর্ব ১৭: ‘গীতাঞ্জলি’ হয়ে উঠুক উভপ্রার্থনা ও উভকামনার গান, অঁদ্রে জিদকে বলেছিল তাঁর টেবিল
পর্ব ১৬: যে লেখার টেবিল ম্যাকিয়াভেলিকে নিয়ে গেছে শয়তানির অতল গভীরে
পর্ব ১৫: যে অপরাধবোধ লেখার টেবিলে টেনে এনেছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে
পর্ব ১৪: লেখার টেবিল গিলে নিচ্ছে ভার্জিনিয়া উলফের লেখা ও ভাবনা, বাঁচার একমাত্র উপায় আত্মহত্যা
পর্ব ১৩: হ্যামনেট ‘হ্যামলেট’ হয়ে বেঁচে থাকবে অনন্তকাল, জানে সেই লেখার টেবিল
পর্ব ১২: রবীন্দ্রনাথের লেখার টেবিল চিনতে চায় না তাঁর আঁকার টেবিলকে
পর্ব ১১: আর কোনও কাঠের টেবিলের গায়ে ফুটে উঠেছে কি এমন মৃত্যুর ছবি?
পর্ব ১০: অন্ধ বিনোদবিহারীর জীবনে টেবিলের দান অন্ধকারের নতুন রূপ ও বন্ধুত্ব
পর্ব ৯: বুড়ো টেবিল কিয়ের্কেগার্দকে দিয়েছিল নারীর মন জয়ের চাবিকাঠি
পর্ব ৮: অন্ধকারই হয়ে উঠলো মিল্টনের লেখার টেবিল
পর্ব ৭: কুন্দেরার টেবিলে বসে কুন্দেরাকে চিঠি
পর্ব ৬: মানব-মানবীর যৌন সম্পর্কের দাগ লেগে রয়েছে কুন্দেরার লেখার টেবিলে
পর্ব ৫: বিয়ের ও আত্মহত্যার চিঠি– রবীন্দ্রনাথকে যা দান করেছিল লেখার টেবিল
পর্ব ৪: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টেবিল আর তারাপদ রায়ের খাট, দুই-ই ছিল থইথই বইভরা
পর্ব ৩: টেবিলের গায়ে খোদাই-করা এক মৃত্যুহীন প্রেমের কবিতা
পর্ব ২: লেখার টেবিল ভয় দেখিয়েছিল টি এস এলিয়টকে
পর্ব ১: একটি দুর্গ ও অনেক দিনের পুরনো নির্জন এক টেবিল