Robbar

ধর্ম উপভোগের রাজকীয় ভাব কালকূটের কুম্ভমেলায় ছিল না

Published by: Robbar Digital
  • Posted:January 10, 2025 9:27 pm
  • Updated:January 10, 2025 9:27 pm  

কুম্ভের কথা বলতে বলতে কালকূট তাঁর পুরী দর্শনের অভিজ্ঞতায় ফিরেছিলেন। সেখানে পেটের দায়েই হোটেলওয়ালা কমদামের কচুকে আলু বলে চালিয়ে দিয়েছিল। এখানে অবশ্য টাকা ফেললে বালির উপরে চা-খাওয়ার হোটেল খুলে যায়। মোদি-যোগীর ভারত ধর্মক্ষেত্র ও মেলাকে দু’-ভাবে ব্যবহার করতে চায়। পুঁজির স্পর্শে ধর্ম উপভোগের রাজকীয় ব্যবস্থা তৈরি করাই উদ্দেশ্য। বেনারস, পুরী, ইলাহাবাদ সেই কর্পোরেট হিন্দুধর্মের আবাসস্থল হয়ে উঠবে ক্রমশ। তাছাড়া আছে ভারতের ইসলাম পূর্ব স্থাননামকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা কিংবা নতুন নামকরণের বাসনা। এই কর্পোরেট পরিচ্ছন্ন হিন্দুধর্মে কালকূটের দেখা পাঁচবদ্যি, দিদিমা, শ্যামা কোথায় ঠাঁই পায় তা দেখার।

বিশ্বজিৎ রায়

ইংরেজ উপনিবেশিত ভারতবর্ষে মেলার গুরুত্ব নিয়ে কথা জমে উঠেছিল উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে – হিন্দুদের সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের নির্মাণের সূত্রেই সে-সময় ‘হিন্দুমেলা’-র সুপ্রকাশ। মেলার ভিড়কে পারস্পরিক মিলনের উপায় করে তুলে গঠনমূলক স্বাদেশিক পরিসর কীভাবে নির্মাণ করা যায় সে চেষ্টা নবগোপাল মিত্রের দেখানো পথে পরে অনেকেই করেছিলেন– সেই সব স্বদেশি মেলা মিলনের স্থল, প্রদর্শনের স্থান। ইংরেজদের আদলে একদিকে যেমন সভা-সমিতি, ক্লাব-আকাদেমির পত্তন হচ্ছিল তেমনি উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছিল মেলার। স্বদেশি সমাজের পুনর্গঠনে সে মেলার যে বিশেষ ভূমিকা থাকতে পারে সে-কথা রবীন্দ্রনাথ, রামেন্দ্রসুন্দর মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন।

This may contain: three men wading in the water on a foggy day

কালকূট সমরেশ যখন স্বাধীন ভারতে পাঁচের দশকের প্রথমার্ধে কুম্ভমেলা দেখছিলেন ও মেলা-অভিজ্ঞতার যে বিবরণ দিচ্ছিলেন, তা এখন আরেকবার মোদি-যোগীর ভারতে ফিরে পড়া জরুরি। কালকূট নেহেরু জমানায় বাস্তববাদী ধার্মিকতা বর্জিত নাগরিক হিসেবে মেলায় ঘুরছেন ও দেখছেন। ওভারকোট ও চশমা পরা কালকূট তাঁর লেখায় নিজের শহুরে নাগরিক সত্তাটির কথা গোপন করেননি। নিজের অবস্থানটিকে নির্দেশ করে মেলার ভিড়ের থেকে তাঁর দূরত্বের কারণ জানান দিচ্ছেন। এই দূরত্ব আছে বলেই তো লিখতে পারা। তাঁর সেই মেলার অভিজ্ঞতায় ঔপনিবেশিক পর্বের স্বাদেশিকতার প্রকল্প তখন স্বভাবতই ছিল না। নেহেরু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিপুল জনতার ভারে আন্দোলিত এই স্বাধীন দেশের পরিবেশে বৈজ্ঞানিক মেজাজের সুরটিকে প্রকট করে তুলতে চাইছিলেন। কালকূটের লেখায় ট্রেন থেকে নেমে মেলা-প্রবেশের আগে মেলারসিকদের স্বাস্থ্য-পরীক্ষার কৌতুককর ছবি। মেলার স্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য সরকার টীকা নেওয়ার যে ব্যবস্থা করেছেন আমজনতার অনেকেই তা নিতে চান না। কালকূট পেল্লাদকে বলতে শোনেন, ‘আমাকে তো নিতেই হল, আমার পরিবারকেও কিনা ছুঁচ ফোটালে।’ ইংরেজ আমলে আম-ভারতীয় যে ভঙ্গিতে প্লেগের টীকার বিরোধিতা করতেন স্বাধীন ভারতেও সে-ভাবেই মেলার টীকার বিরোধিতা চোখে পড়ে। এই পেল্লাদ যাঁর ভরসায় মেলায় পা দিয়েছে, পরিবার ও দিদিমা সহ, তিনি পাঁচবদ্যি। মাঝে মাঝে তার নামের আগে কথক প্রথম দিকে ডাক্তারবাবু অভিধাও যোগ করছিলেন। ক্রমে পাঁচবদ্যির পরিচয় খোলসা হল। কালকূট জানতে পারেন একদা সন্ন্যাস নেওয়া পাঁচবদ্যি মাদুলি-টাদুলি দিয়ে বদ্যিপনা করতেন। সে সবই ভেক, বলাই বাহুল্য।

This may contain: a large group of people standing around each other

মেলায় কালকূট যে ধর্মের ভারতকে দেখেছেন সেই ভারতে খিদে ধর্মে রূপান্তরিত। গাঁজার ছিলিমে টান দিয়ে সে খিদে মেটে না। ফলে অবধূত সন্ন্যাসীর কাছে মেলা সপরিবার ভিক্ষের স্থল। সাত-সকালে কৃষিজীবী সংসারী অবধূত সপরিবার নগ্ন হয়ে স্নান করছিলেন। সেই নগ্ন স্নানদৃশ্য কথক কালকূটকে বিচলিত করে। তবে ভিক্ষা দিতেও দ্বিধা করেন না। অবধূতের ভিক্ষা চাওয়ার ভঙ্গিটি বড় বিনত। সামনেই ‘তাঁবুর পায়খানা সারবন্দী। ফিনাইল আর ব্লিচিং পাউডারের হালকা গন্ধ নাকে লাগছে।’ এ যেন দুই ভারত– ধর্মে আর বিজ্ঞানে মাখামাখি।

কালকূটের এই ভ্রমণদর্শন ১৯৫৫-র আগে। হিন্দু বিবাহ বিল পাশ হয়নি। কাজেই হিন্দু-পুরুষের বহু-বিবাহ নানা সামাজিক শ্রেণির মধ্যে অবাধ। কালকূটও এমন এক দাম্পত্যের করুণ কাহিনির সাক্ষী, তাঁর কাহিনি যখন চলচ্চিত্রায়িত হয়েছিল তখন সেই চলচ্চিত্রের দর্শক-সাফল্য অনেকটাই এই করুণ-কাহিনির উপর নির্ভর করেছিল। কালকূট লিখেছেন, ‘ভুঁইহারদের কথা যখন শুনেছিলাম, তখন বাঙলার কৌলীন্যপ্রথার সঙ্গে তুলনা করতে পারি নি। আজ চোখের সামনে দেখছি সেই বাস্তব চিত্র।’ শ্যামার কুমারীত্ব ঘোচাবার জন্য তাকে লোলচর্ম বৃদ্ধের অঙ্কশায়িনী করা হয়েছে।

………………………………….

কালকূটের বয়ান থেকে মোদি-যোগীর ভারতে ফিরি। প্রসঙ্গত এই কুম্ভের কথা বলতে বলতে কালকূট তাঁর পুরী দর্শনের অভিজ্ঞতায় ফিরেছিলেন। সেখানে পেটের দায়েই হোটেলওয়ালা কমদামের কচুকে আলু বলে চালিয়ে দিয়েছিল। এখানে অবশ্য টাকা ফেললে বালির উপরে চা-খাওয়ার হোটেল খুলে যায়। মোদি-যোগীর ভারত ধর্মক্ষেত্র ও মেলাকে দু’-ভাবে ব্যবহার করতে চায়। পুঁজির স্পর্শে ধর্ম উপভোগের রাজকীয় ব্যবস্থা তৈরি করাই উদ্দেশ্য। বেনারস, পুরী, ইলাহাবাদ সেই কর্পোরেট হিন্দুধর্মের আবাসস্থল হয়ে উঠবে ক্রমশ। তাছাড়া আছে ভারতের ইসলাম পূর্ব স্থাননামকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা কিংবা নতুন নামকরণের বাসনা।

………………………………….

चित्र:Kumbh Mela 2001.jpg - विकिपीडिया

কুম্ভের বাস্তব থেকে অতীতের ইতিহাসে ফেরা কালকূটের স্বভাব। কালকূট লেখেন, ‘এক সময়ে প্রয়াগের নাম ছিল বৎসদেশ। ত্রিশ মেইল দূরে, যমুনাকূলে ছিল তার রাজধানী কৌশাম্বী নগরী। … তারপর মুঘলযুগের দুর্ধর্ষবাহিনী ছুটে এসেছে এই পথের উপর দিয়ে। মুঘলের শ্রেষ্ঠ সম্রাট আকবর প্রয়াগে এসে তার নাম রাখলেন ইলাহাবাস। ভিত্তি স্থাপন করলেন ইলাহাবাস দুর্গের।… শাজাহান ইলাহাবাসের নাম দিলেন ইলাহাবাদ।’ ইতিহাস বলার ভঙ্গিটি নির্মোহ ও উদাসীন। কথনে বস্তুবাদী যুক্তি আছে– প্রতিহিংসার উস্‌কানি নেই। মুঘোল মারাঠাদের লড়াই দেখেছে এখানকার পুরনো মানুষ– অতীত স্মৃতিতে জাগে। তারপর কোম্পানির আমল। তারপর স্বাধীন ভারত। বর্তমানের কোলে নানা কৌম তাঁদের অতীত সাংস্কৃতিক অভ্যাসের অনুশীলনে রত। নানা ভাষার ভারতকে দু’-চোখে দেখেছেন কালকূট। আর দেখতে দেখতে মাঝে মাঝেই তলিয়ে গিয়েছেন ব্যক্তিগত গল্পে। সেই গল্পে মানুষের বিচিত্র ধর্ম-স্বভাবের বিবরণ। দিদিমা উদার চিত্তে কথককে তাঁর তাঁবুতে রাতের বেলা ঠাঁই দেন কিন্তু তেল সাবান মেখে স্নান করতে গেলে ভয়ংকর রেগে যান। তীর্থক্ষেত্রে তেল-সাবাং [সাবান] দিদিমার কাছে নিতান্ত অপবিত্র বস্তু।

কালকূটের বয়ান থেকে মোদি-যোগীর ভারতে ফিরি। প্রসঙ্গত এই কুম্ভের কথা বলতে বলতে কালকূট তাঁর পুরী দর্শনের অভিজ্ঞতায় ফিরেছিলেন। সেখানে পেটের দায়েই হোটেলওয়ালা কমদামের কচুকে আলু বলে চালিয়ে দিয়েছিল। এখানে অবশ্য টাকা ফেললে বালির উপরে চা-খাওয়ার হোটেল খুলে যায়। মোদি-যোগীর ভারত ধর্মক্ষেত্র ও মেলাকে দু’-ভাবে ব্যবহার করতে চায়। পুঁজির স্পর্শে ধর্ম উপভোগের রাজকীয় ব্যবস্থা তৈরি করাই উদ্দেশ্য। বেনারস, পুরী, ইলাহাবাদ সেই কর্পোরেট হিন্দুধর্মের আবাসস্থল হয়ে উঠবে ক্রমশ। তাছাড়া আছে ভারতের ইসলাম পূর্ব স্থাননামকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা কিংবা নতুন নামকরণের বাসনা। এই কর্পোরেট পরিচ্ছন্ন হিন্দুধর্মে কালকূটের দেখা পাঁচবদ্যি, দিদিমা, শ্যামা কোথায় ঠাঁই পায় তা দেখার। যে রামমার্গের বাসিন্দা হয়ে উঠতে চাওয়া সেই বৃহত্তর রামমার্গে সতীনাথের তুলসীদাস পড়া তাৎমাটুলির মানুষেরা কোথায় থাকবে!

প্রশ্নটা ঘাই মারে। ইচ্ছে করে সমরেশ কালকূটকে ডেকে এনে শতবর্ষ পরের এই মেলার ব্যবসায় একবার পদচারণা করাই। নেহেরুর ভারত আর মোদি-যোগীর ভারতের ভেদটুকু আমাদের বলে দিয়ে যান।