তাঁর টেবিলের দিকে টেবিল ল্যাম্পের মায়াবী আলোয় অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন গ্রিন। ভাবেন লিখবেন নাকি চেপে যাবেন। শেষপর্যন্ত টেবিলটা ভর করে তাঁর ওপর। তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় এই স্বীকারোক্তি, ‘আনটিল দ্য এন্ড অফ টাইম বেস্টসেলার’-এর অন্তরে, জীবনে বড় প্রয়োজন একটি মরীচিকার। সেই মরু তৃষ্ণিকা অনন্তের। এই মহাবিশ্বে শুধু অবক্ষয়। শুধু মরণ। শুধু এনট্রপি। মৃত্যুই শেষ সত্য। ইটারনিটি, সেও মরছে। আমার সমীকরণ মরণহীন সময়ের সন্ধান দেয়নি। তবু আমি জানি, মানুষের মধ্যে চিরকাল থাকবে মৃত্যুহীন অসীমের ডাক।
২২.
ওঁর একটা ছোট্ট পড়ার ঘর। ওঁর একটা ছোট্ট স্বপ্নের জানলা। ওঁর একটা আলোকবর্ষ দূরের মন। ওঁর একটা ছোট্ট লেখার টেবিল। ওই জানলার সামনে। ওই টেবিলটা আমার চাই। আমার বিশ্বাস ওই টেবিলটা পেলেই আমি লিখতে পারতাম, ওই টেবিলে ল্যাপটপ রেখে, ‘Eternity itself may forever lie beyond the reach of our equations, but our analyses have already revealed that the universe we have come to know is transitory. From planets to stars, solar systems to galaxies, black holes to swirling nebulae, nothing is everlasting.’
অর্থাৎ, মহাবিশ্ব মরছে। আপনার আমার মতো প্রতি মুহূর্তে মরছে। মহাবিশ্ব জন্মেছে। অতএব, মহাবিশ্ব মরছে। বেঁচে থাকা মানেই প্রতি মুহূর্তে মরা। কিন্তু মহাকাল? সে তো মরছে না। মহাকালের তো মৃত্যু নেই। মহাকাল অমর। সে চিরকাল থাকবে। তার কোনও শেষ নেই। ভুল ভুল ভুল! মহাকাল মরছে মশাই। সময় জন্মে ছিল বিগ ব্যাং-এর সঙ্গে। সময়ও মরছে আপনার আমার মতো। কোন আহাম্মক বলেছেন এই অর্বাচীন কথা যে, মহাকাল মরছে? তিনি ব্রায়ান গ্রিন। তিনি আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্স-এর প্রধান অধ্যাপক। কী দারুণ দেখতে তাঁকে, কী বলব! হলিউডের নায়ক হতে পারতেন। কিন্তু আমার ধারণা ওই টেবিলটা তাঁকে করেছে, মানে তাঁর লেখা পড়ার ওই ছোট্ট টেবিলটা তাঁকে করেছে গণিতের ভগবান আর স্ট্রিং থিওরির নিরন্তর নায়ক।
তিনি মহাকাল কে জানার জন্য, বোঝার জন্য, উল্টেপাল্টে দেখার জন্য, আর মহাকালের শেষ দেখার জন্য ক্রমাগত তৈরি করে যাচ্ছেন নতুন নতুন সমীকরণ। যে সমস্ত সমীকরণ তাঁকে ধীরে ধীরে নিয়ে গেছে মহাকালের মৃত্যুশয্যায়। তিনি দেখতে পারছেন সময়ের মৃত্যু। দেখতে পারছেন সেই মুহূর্ত, যখন শেষ হল সময়। ঝরে গেল সময়ের শেষ বিন্দু, আমাদের সমস্ত সমীকরণের বাইরে অ-সময়ে। সময়ের বাইরে আমরা এখনও পা ফেলতে শিখিনি। তাই সময়ের কিনারে গিয়ে স্ট্যাচু হয়ে যেতে বাধ্য হই আমরা। কিন্তু আমাদের কল্পনা, সেও কি স্ট্যাচু হয়ে যায়? থেমে যায় ব্রায়ান গ্রিনের গণিত? এই কারণেই তো বলছিলাম, ব্রায়ান গ্রিনের ভাবনার টেবিলটা আমার চাই। ওই টেবিলে বসেই গ্রিন লিখেছেন তাঁর দৈবগ্রন্থ, ‘আনটিল দ্য এন্ড অফ টাইম’। সময়ের মৃত্যু পর্যন্ত!
লিখছেন ব্রায়ান গ্রিন, তাঁর গণিত প্রদত্ত সত্য কথাটি: চিরদিনের বলে কিছু নেই। ওই যে আকাশ ভরা সূর্য তারা, ওদের মধ্যে নক্ষত্রগুলো যে মরে ভূত হয়েছে, হিসেবেই। আলোকবর্ষ দূরত্বের ভেলকির জন্যে ওরা এখনও জ্বলছে। মোদ্দা কথা, সমীকরণ বলছে, ওরা এখনও জন্মাতে জন্মাতে, মরতে মরতে মহালুপ্তির দিকে এগিয়ে চলেছে। অনিবার্য তাদের এই মৃত্যু মিছিল! মহাবিশ্ব মহাকাল একসঙ্গে এগিয়ে চলেছে মহালুপ্তির পথে। এমনকী, ব্ল্যাকহোল, যার ক্ষমতার তুল্য ক্ষমতা মহাবিশ্বে আর কিছুর নেই, যার অন্ধকার শুষে নিতে পারে বিশ্বের সমস্ত আলো, এবং যার অন্ধকার থেকে আলোও খুঁজে পায় না বেরবার পথ, সেই সব কৃষ্ণগহ্বর মরছে!
আরও জানাচ্ছেন গ্রিন, ওই ম্যাজিক টেবিলে বসে লেখা তাঁর একের পর এক আধুনিক উপনিষদে: ‘দ্য হিডেন রিয়েলিটি, দ্য ফ্যাব্রিক অফ দা কসমস, দ্য এলিগান্ট ইউনিভার্স।’ টেবিল তো নয়, যেন এই যুগের তপোবন! সরস্বতী নদী বয়ে যাচ্ছে, আপন বেগে পাগলপারা, টেবিলটার বুকে। আর টেবিলটার হৃদয় থেকে উঠে আসছে ব্রায়ান গ্রিনের সেইসব সুবর্ণ সমীকরণ আর তাঁর অমিত মাধুর্যের গদ্য:
‘I do mathematics because once you prove a theorem, it stands forever. That is the romance of mathematics. No climbing to the mountaintop, no wandering the desert, no triumphing over the underworld. You can sit comfortably at a desk and use paper and pencil, and a penetrating mind to create something timeless. I was suddenly sure I wanted to be part of a journey toward insights so fundamental that they would never change.’
এক জায়গায় সত্যি তপোবনের ঋষির মতোই কথা বলছেন গ্রিন: আমি চাই না হতে এই পৃথিবীর নব যুগের চালক। আমি চাই না ক্ষমতা। চাই না ঐশ্বর্য। চাই না আধিপত্য। সব নশ্বর। আমি চাই না হতে চারিধারে এই ক্ষণস্থায়ী বাস্তবের অঙ্গ হতে। আমার কিছু এসে যায় না রাজনীতিতে কে এল গেল। কোন সরকার উঠল। কোন সরকার পড়ল। সিনেমা বা খেলার জগতে কত রূপকথা জন্মাচ্ছে মরছে, কিচ্ছু এসে যায় না আমার।
‘Let government rise and fall, let World Series be won and lost, let legends of film, television and stage come and go, I want to spend my life catching a glimpse of something transcendent.’
ব্রায়ান গ্রিনের এই অবিস্মরণীয় উক্তির পাশাপাশি আমার মনে পড়ে যায়, সার্ত্রের মতো অস্তিত্ববাদী দার্শনিকের অবিশ্বাস্য উচ্চারণ: ‘লাইফ ইজ উইদাউট মিনিং হোয়েন ইউ হ্যাভ লস্ট দ্য ইলিউশন অফ বিয়িং ইটার্নাল।’
পাশাপাশি এই মৃত্যুময় মহাবিশ্বে চিরন্তনের প্রতি ব্রায়ান গ্রিনের টানের কথাটিও তুলে না ধরে পারছি না। তাঁর টেবিলের দিকে টেবিল ল্যাম্পের মায়াবী আলোয় অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন গ্রিন। ভাবেন লিখবেন নাকি চেপে যাবেন। শেষপর্যন্ত টেবিলটা ভর করে তাঁর ওপর। তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় এই স্বীকারোক্তি, ‘আনটিল দ্য এন্ড অফ টাইম বেস্টসেলার’-এর অন্তরে, জীবনে বড় প্রয়োজন একটি মরীচিকার। সেই মরু তৃষ্ণিকা অনন্তের। এই মহাবিশ্বে শুধু অবক্ষয়। শুধু মরণ। শুধু এনট্রপি। মৃত্যুই শেষ সত্য। ইটারনিটি, সেও মরছে। আমার সমীকরণ মরণহীন সময়ের সন্ধান দেয়নি। তবু আমি জানি, মানুষের মধ্যে চিরকাল থাকবে মৃত্যুহীন অসীমের ডাক। আমার গণিতে মৃত্যুহীন অনন্ত আজও দেখা দেয়নি। তবু মনের মধ্যে অনন্তের মায়াটান হয়তো থেকেই যাবে। কী অসাধারণ গদ্যে মনের এই ভাবটি ফুটিয়ে তুলেছেন ব্রায়ান গ্রিন। উদ্ধৃতির লোভ সামলানো কঠিন:
‘Man is literally split in two; he has an awareness of his own splendid uniqueness that he sticks out of nature with a towering majesty, and yet he goes back into ground a few feet in order blindly and dumbly to rot and disappear for ever.’
মানুষ চিরদিন নিজের মধ্যেই দ্বিখণ্ডিত। একদিকে শেষ সমস্ত প্রকৃতিকে হারিয়ে দিয়ে যেন নিজের চিরস্থায়ী বৈভবে প্রকাশিত। অন্যদিকে, সেই মানুষই মাটির কয়েক ফুট নিচে অন্ধকারে অন্ধভাবে ফিরে যাচ্ছে তার শেষ মূক আশ্রয়ে, যেখানে সে পচতে পচতে একদিন স্রেফ উবে যাবে। তাহলে অনন্ত বলে কিছু নেই? সবাই মৃত্যু পথের যাত্রী? লিখছেন গ্রিন, তাঁর ওই ছোট্ট টেবিলটায় একা বসে কোনও এক মধ্যরাতের তাড়নায়:
‘What’s new in our age is is remarkable power of science to tell a lucid story not only of the past, back to the big bang, but also of the future.’
…………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………
মহাবিশ্বের ভবিষ্যতে যতদূর পৌঁছতে পেরেছে আমার গণিত, আমার সমীকরণ, কোথাও তো দেখতে পারছি না মৃত্যুহীন অনন্তকে। মৃত্যুহীন অনাদি এখনও গণিতের অতীত। ‘Eternity may for ever lie beyond the reach of our equations.’ যদি আমাদের অঙ্ক কোনও দিন নাগাল পায় লুপ্তিহীন অনন্ত কালের, সারা বিশ্ব জানবে। আপাতত মহাকাল মরছে। আমাদেরই মতো।
…………………….. পড়ুন কাঠখোদাই-এর অন্যান্য পর্ব ……………………
পর্ব ২১: গাছ আমাদের পূর্বপুরুষ, লেখার টেবিল বলেছিল হোসে সারামাগোকে
পর্ব ২০: টেবিলের কথায় নিজের ‘হত্যার মঞ্চে’ ফিরেছিলেন সলমন রুশদি
পর্ব ১৯: প্রতিভা প্রশ্রয় দেয় অপরাধকে, দস্তয়েভস্কিকে শেখায় তাঁর লেখার টেবিল
পর্ব ১৮: বিবেকানন্দের মনের কথা বুঝতে পারে যে টেবিল
পর্ব ১৭: ‘গীতাঞ্জলি’ হয়ে উঠুক উভপ্রার্থনা ও উভকামনার গান, অঁদ্রে জিদকে বলেছিল তাঁর টেবিল
পর্ব ১৬: যে লেখার টেবিল ম্যাকিয়াভেলিকে নিয়ে গেছে শয়তানির অতল গভীরে
পর্ব ১৫: যে অপরাধবোধ লেখার টেবিলে টেনে এনেছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে
পর্ব ১৪: লেখার টেবিল গিলে নিচ্ছে ভার্জিনিয়া উলফের লেখা ও ভাবনা, বাঁচার একমাত্র উপায় আত্মহত্যা
পর্ব ১৩: হ্যামনেট ‘হ্যামলেট’ হয়ে বেঁচে থাকবে অনন্তকাল, জানে সেই লেখার টেবিল
পর্ব ১২: রবীন্দ্রনাথের লেখার টেবিল চিনতে চায় না তাঁর আঁকার টেবিলকে
পর্ব ১১: আর কোনও কাঠের টেবিলের গায়ে ফুটে উঠেছে কি এমন মৃত্যুর ছবি?
পর্ব ১০: অন্ধ বিনোদবিহারীর জীবনে টেবিলের দান অন্ধকারের নতুন রূপ ও বন্ধুত্ব
পর্ব ৯: বুড়ো টেবিল কিয়ের্কেগার্দকে দিয়েছিল নারীর মন জয়ের চাবিকাঠি
পর্ব ৮: অন্ধকারই হয়ে উঠলো মিল্টনের লেখার টেবিল
পর্ব ৭: কুন্দেরার টেবিলে বসে কুন্দেরাকে চিঠি
পর্ব ৬: মানব-মানবীর যৌন সম্পর্কের দাগ লেগে রয়েছে কুন্দেরার লেখার টেবিলে
পর্ব ৫: বিয়ের ও আত্মহত্যার চিঠি– রবীন্দ্রনাথকে যা দান করেছিল লেখার টেবিল
পর্ব ৪: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টেবিল আর তারাপদ রায়ের খাট, দুই-ই ছিল থইথই বইভরা
পর্ব ৩: টেবিলের গায়ে খোদাই-করা এক মৃত্যুহীন প্রেমের কবিতা
পর্ব ২: লেখার টেবিল ভয় দেখিয়েছিল টি এস এলিয়টকে
পর্ব ১: একটি দুর্গ ও অনেক দিনের পুরনো নির্জন এক টেবিল