সেই কবিতার বইটি পাঠক এখন হয়তো তার বুকশেলফের পিছনের দিকে রেখে দিয়েছেন; তবু তা তো আমারই তারুণ্যের অপমান ও ব্যথার যে সৌন্দর্য, তারই দাগ। সেই দাগ আমার মুছে যায়নি। সেই দাগ এখনও আছে, আমি পাঠককে দেখাতে পারি। সে সব কবিতা অমরত্ব পাবে না হয়তো, কিন্তু তা তো উল্টোনো ভাঙা কাপের মতো এখনও পড়ে আছে আমার জীবনের জীর্ণ টেবিলের এক পাশে বা বাতিল আলমারির এক কোণে! যা আরোগ্যের আকাঙ্ক্ষায় ভরা।
আমার দ্বিতীয় কবিতার বই– ‘শরীরে সন্দীপন নেই’। ১৯৯৮-এর বইমেলায় প্রকাশ পেয়েছিল। প্রচ্ছদ করেছিলেন দিব্যেন্দু বসু নামের এক তরুণ শিল্পী। সে আমার প্রথম কবিতার বই ‘একটি অল্পবয়সী ঘুম’-এরও প্রচ্ছদ করেছিলেন। ‘শরীরে সন্দীপন নেই’ আমার এই দ্বিতীয় কবিতার বইয়ের প্রকাশক ছিলেন অকাল প্রয়াত কবি শৌনক বর্মণ। তিনি ‘প্রচ্ছায়া’ নামের একটি পত্রিকার সম্পাদনাও করতেন।
১৯৯৬-’৯৭ সাল নাগাদ ‘বিজল্প’ পত্রিকার সম্পাদক প্রসূন ভৌমিক ও তার নয়ের দশকের কবি-বন্ধুরা মিলে কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলে প্রতি মাসে নয়ের দশকের কবিদের নিয়ে একটি করে কবিসভা করতেন। তার মধ্যে একটি সভায় কবিতা পড়েছিলাম আমি এবং নয়ের তরুণ কবি আবির সিংহ। সেই সভাতেই প্রচ্ছায়া-র সম্পাদক শৌনক বর্মণ আমাকে একটি দুই ফর্মার কবিতা বইয়ের প্রস্তাব দেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যাই। এই ছিল ‘শরীরে সন্দীপন নেই’ কবিতা বইয়ের জন্মপ্রস্তাব। তখন আমার মা বেঁচে। মা বেঁচে থাকতেই আমি ব্যারাকপুর থেকে বারাসতে শৌনকের বাড়ি যেতাম বইয়ের প্রুফ আনতে, তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিতে। সেখানে কবি আবির সিংহ-র সঙ্গে মাঝে মাঝে আড্ডা গল্প ইত্যাদি হত। সে সব দিনের বিকেল আমার কাছে ছিল কবিতার পঙক্তির মতো– সাজানো ও এলোমেলো এবং তারুণ্যেভরা এক আলোকিত পথ, পথের শুরু এবং চলতে থাকা।
‘শরীরে সন্দীপন নেই’ প্রকাশ পাওয়ার আগেই হঠাৎ আমার মা মারা গেলেন। তখন ১৯৯৭-র দিনগুলি আমাকে শোক ও কবিতার আগুনে পুড়িয়ে দিচ্ছিল আবার শুশ্রূষাও দিচ্ছিল। সে এক, ‘ভালোবেসে যদি সুখও নাহি…’-র তীব্র ‘আছে’র দিন যেন, আছে আবার নেই– এর মধ্যে দিয়েই আমি আমার দ্বিতীয় কবিতা বইয়ের কবিতাগুলো লিখছিলাম। বইটির মধ্যে তীব্র শ্লেষ-বিদ্রুপের কবিতা যেমন ছিল, তেমন শোকের কবিতাও ছিল। এসেছিল তারা এমন করেই, যেন একটা একটা করে দেশলাই কাঠি জ্বালাচ্ছি, আবার নিভিয়েও দিচ্ছি। আবার জ্বালাচ্ছি এবং সেই জ্বলন্ত কাঠি (এক্ষেত্রে কবিতাগুলি) ছুড়ে দিচ্ছি হাওয়ায় বাতাসে, অলক্ষ্যে।
খুব মজা-হাসি-ঠাট্টা কবিতাগুলোর মধ্যে সাজিয়ে দিচ্ছিলাম তখন। কবিতা-পণ্ডিতেরা হয়তো আমার ওই কবিতাগুলোকে তুচ্ছতাচ্ছিল্যই করবেন। কিন্তু আমার সেই অল্পবয়সের দিনগুলি খুব ইমোশনাল ও যুক্তিহীন ছিল, এবং তা ছিল ঝড়ের প্রস্তুতি এবং সেই ঝড় খুব অগোছালো, এলোমেলো এবং কিছুটা সৌজন্যহীনও বটে।
একটি চরিত্র যার নাম ছিল শৌনক, সেই শৌনক হয়তো আমি নিজে, তাকে নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছিলাম। শৌনকের বিষণ্ণতা, শৌনকের হোঁচট খাওয়া, শৌনকের জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকা– এইসব নিয়ে কবিতা। তাকে তীব্র বিদ্রুপ, শ্লেষ করতাম। হয়তো শৌনক দৈনিক খবর-কাগজের প্রথম পৃষ্ঠার খবর পড়তে পড়তে সে পঞ্চম পৃষ্ঠায় একটা জার্নি করছে, সেই প্রথম পাতা থেকে পঞ্চম পাতা অবধি (খবরের মাধ্যমে) যেতে যেতে সে কতবার হাসল, সে কতবার হাঁচি দিল, সে কতবার তার নরম দাড়িতে হাত বুলোল, সে কতবার হাই তুলল– সেই সব মজা কবিতায় আসত। শৌনক যেহেতু আমি নিজে, ফলে নিজেকে ব্যঙ্গ করা, নিজেকে আয়নায় দেখা, নিজের ফেইলিয়োর, নিজেকে নিজের অতিক্রম করে দেখা, এমনকী তার সামান্য ব্যথাতুর যৌনতাও আমি ‘শরীরে সন্দীপন নেই’-এর কবিতাগুলোতে আনছিলাম, খুব সচেতনভাবে নয় হয়তো, তা প্রায় ঘটনা ও দুর্ঘটনার এক রক্তাক্ত মিশ্রণ।
দুটো রাত্রিকালীন শেষ বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হচ্ছে, এবং তা থেকে মানুষের অসহায় রক্তপাত হচ্ছে, এবং তা রাত্রিকালীন দুঃখের আড়াল থেকে দেখছে আমাদের কবিতার শৌনক, সেই সবই কিছুটা চিৎকৃতভাবে আমার কবিতায় লিখিত হচ্ছিল। সেই কবিতার বইটি পাঠক এখন হয়তো তার বুকশেলফের পিছনের দিকে রেখে দিয়েছেন; তবু তা তো আমারই তারুণ্যের অপমান ও ব্যথার যে সৌন্দর্য, তারই দাগ। সেই দাগ আমার মুছে যায়নি। সেই দাগ এখনও আছে, আমি পাঠককে দেখাতে পারি। সে সব কবিতা অমরত্ব পাবে না হয়তো, কিন্তু তা তো উল্টোনো ভাঙা কাপের মতো এখনও পড়ে আছে আমার জীবনের জীর্ণ টেবিলের এক পাশে বা বাতিল আলমারির এক কোণে! যা আরোগ্যের আকাঙ্ক্ষায় ভরা।
সেই কবিতার বইতে শৌনক চরিত্রটিকে নিয়ে যে সব মজা বা শ্লেষ ছিল তার দুয়েকটি নমুনা এইরকম–
‘শৌনক রায় আসলে কে?/ কোনো মহিলার প্রিয় লজেন্সের নাম শৌনক/কোনো টেলিফোনের মিষ্টি ডায়ালটোনের নাম শৌনক…’ অথবা ‘শৌনক রায় যদি লম্বা হতে চান, হোন/তাতে আমরা আপত্তি করব কেন?/বরং আমরা হাততালি দিয়ে, তাঁকে আরও লম্বা হতে সাহায্য করব!’ ইত্যাদি।
আমি তখন খুবই, আমার আশপাশের চরিত্রদের নাম উল্লেখ করে কবিতা লিখতাম। যেমন আমার ভাগ্নে মেঘমনকে নিয়ে কবিতা, বা আমার বন্ধু অনিশ্চয় চক্রবর্তীকে নিয়ে কবিতা, বা কিশোরকুমারের গান নিয়েও কবিতা… এই সব ব্যঙ্গ-ঠাট্টা-মজা করতে করতে এগোনো বা সহজ দুর্গমের দিকে যাত্রা ছিল আমার।
কোনও নামকে বা ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে মজা বা ঠাট্টা করে কবিতা লিখতে গিয়ে আমি হয়তো কখনও কখনও কোনো ব্যক্তিকে আঘাতও করে ফেলেছি অজান্তে। দুঃখ দিয়ে ফেলেছি। পরে সেই আঘাত সময়ের নিয়মে অপমান হয়ে, অসম্মান হয়ে, আমার কাছে ফিরেও এসেছে– অল্প আলোর জোনাকি পোকার মতো।
শরীরে সন্দীপন নেই– আমার এই কবিতার বইটি দু’বার প্রকাশ পায়। প্রথম প্রকাশ– ১৯৯৮, প্রকাশক– শৌনক বর্মণ, প্রচ্ছায়া, বারাসত। দাম ১০ টাকা। প্রচ্ছদ– দিব্যেন্দু বসু।
দ্বিতীয় প্রকাশ– ২০১৫, প্রকাশক– আমার কবিবন্ধু রঞ্জন আচার্য, নাটমন্দির– পুরুলিয়া। প্রচ্ছদ– জিশান রায়।
এই বইটি নিয়ে নাটমন্দির পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদকের উদ্যোগে শ্রদ্ধেয় কবি মণীন্দ্র গুপ্তকে নাটমন্দির পত্রিকায় লিখতে বলা হয়। সেখানে মণীন্দ্রবাবু লিখেছিলেন, (স্মৃতি থেকে বলছি) যে: রাণা তার কবিতায় খুব দুমদাম, এলোমেলো শব্দ ব্যবহার করে। খুব অস্থিরতা তার কবিতায়। ভবিষ্যতে আশা করি রাণার কবিতা স্থিরতা পাবে, তার কবিতা নাভি থেকে উঠে আসবে… ইত্যাদি।
তারপর বিটি রোড দিয়ে অনেক গাড়ি ও মানুষ গেছে কলকাতার দিকে বা কোনও অনির্দিষ্ট কুয়াশার দিকে এবং তা ফিরেও এসেছে আবার– অনেক শোক ও অনেক ব্যথা অস্তও গেছে গঙ্গার ওপারে– ধীরে ধীরে হয়তো আমার লেখা নাভি থেকে উঠে এসেছে আমারই অজান্তে বা চর্চাবশত অথবা নাভি থেকে উঠে আসেওনি তা– তবু আমি লিখে যাচ্ছি এখনও হাসিঠাট্টা নিয়ে, মজা নিয়ে, অভিমান নিয়ে, অপমানের দাগের ওপর দিয়ে যাচ্ছি আমার কবিতা নিয়ে– ব্যারাকপুরের সূর্য অস্ত যাচ্ছে শ্রীরামপুরের দিকে, মেয়েদের রাত দখলের মধ্যে দিয়ে নতুন সম্ভাবনার উদয়ও হচ্ছে– সেই সম্ভাবনা লিখিতও হচ্ছে হয়তো বর্ধমানের কোনও তরুণের কবিতায়– যা আমি পারিনি হয়তো।
তবু আমি লিখছি– ‘আলো পাহাড়ের পথে তুমি শান্ত/ তোমার গান, তোমার মাতৃত্ব শতাব্দী শতাব্দী প্রবাহিত/ বিষণ্ণ তোমার ডানা সরাইখানার পাশে পড়ে আছে/ ভুল ট্যাবলেটে, ভুল চিকিৎসায় তুমি জাগতিক/ তোমার ছুটন্ত প্রতিভা, তোমার বেদনার ঢেউ/ আকাশে আকাশে, মেঘের ভাঁজে ভাঁজে জেগে আছে…’। (চিল/শরীরে সন্দীপন নেই)
……………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………
শরীরে সন্দীপন নেই-এর পরে আমি আরও অনেক কবিতা লিখেছি, কিন্তু তা ওই, ‘ভালোবেসে সখী সুখও নাহি’র মতো অতৃপ্ত, দীপ্তিহীন– কখনও তা একাকিত্বের আলো হয়ে জ্বলছে, নিভেও যাচ্ছে আমার ভিতর। এইভাবে মানুষের মিছিলে মিশে হাঁটছি একা একা, গন্তব্যহীন সৌন্দর্যের দিকে। সৌন্দর্য কাছেই কোথাও আছে এই জেনে…।
… দ্বিতীয় বই-এর অন্যান্য লেখা …
মৃদুল দাশগুপ্ত-র লেখা: জুতোর বাক্সে কবিতা জমাতাম, ভাবতাম, চাকরি পেলে একদিন বই হবে
অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা: আমায় ডিরেক্টর বানিয়েছে আমার আদরের দ্বিতীয়
স্বপ্নময় চক্রবর্তী-র লেখা: হলদে গোলাপ নয়, নবম পর্ব-ই তোমার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস, বলেছিলেন বুদ্ধদেব গুহ
রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়-এর লেখা: আমার সমস্ত ভয়েরিজম নিয়েই দ্বিতীয় বইতে নিজের প্রেমপত্রটি রেখেছি
মন্দাক্রান্তা সেন-এর লেখা: অবাধ্য হৃদয়ের কথা অন্যভাবে বলতে চেয়েছিলাম আমার দ্বিতীয় বইয়ে
অনিতা অগ্নিহোত্রী-র লেখা: পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ শুধু নয়, বহু অনাগত উপন্যাসের সম্ভাবনাও ছিল ‘বৃষ্টি আসবে’ বইটিতে