সত্যজিৎ মনে করিয়ে দিয়েছেন মানুষে মানুষে অতি গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণিগত পার্থক্যের কথা। মনে করিয়ে দিয়েছেন, চিত্রনাট্যকার কীভাবে তাঁর নিজস্ব সত্তাকে ‘সম্পূর্ণ বিলীন করে, তার চরিত্রের অন্তরে প্রবেশ করে সেই চরিত্রের সত্তাটিকে সংলাপের দ্বারা’ ফুটিয়ে তুলতে পারেন। তিনি জানেন, সময়ের দাম কত বেশি। জানেন, অল্প কথায় যত বেশি বলা যায় তত ভালো, ‘আর কথার পরিবর্তে যদি ইঙ্গিত ব্যবহার করা যায়, তবে তো কথাই নেই।’
চিঠি, চিঠি, চিঠি, চিঠি, চিঠি… (‘পথের পাঁচালী’)
সরবতে কী দিয়েছিস রে? (‘জলসাঘর’)
সত্যজিৎ রায়ের যুগান্তকারী চলচ্চিত্রচেতনার সারাৎসার তাঁর নতুন ‘দেখার দৃষ্টি’। তিনি বদলে দিলেন ভারতীয় ছবির ফ্রেম, ক্যামেরার চোখ, ইমেজ, সম্পাদনা, যতি ও গতি, অভিনেতার প্রকৃতি, অভিনয়ের ধরন, কাঠামোর শৈল্পিক ও সাংগীতিক বিন্যাস, দৃশ্যসংস্থাপনের চরিত্র, কথা ও না কথা, শব্দ ও নৈঃশব্দ্য।
চিত্রপটের প্রতিটি উপাদান প্রায় জাদুমন্ত্রে মিশে গেল এক উষ্ণ আর নিবিষ্ট মানবিক বয়ানে। এর মধ্যে যেটির মূল্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হল ছবির সংলাপ, যার প্রায় অবিশ্বাস্য নিখুঁত ভারসাম্য চলচ্চিত্রকে জীবন্ত করে তোলে। সেখানে যুক্ত হয় নানা মুড ও নানা স্তরের ‘শেডস’।
ওপরের এপিগ্রাফে অপুর সেই বিখ্যাত আনন্দিত ঘোষণার কথা স্মরণ করুন, চলচ্চিত্রের সেই অবিস্মরণীয় মুহূর্ত, যা জীবনের মুক্ত জলধারা নিয়ে পর্দার ওপরে আছড়ে পড়ে। অথবা দ্বিতীয় এপিগ্রাফে জমিদার বিশ্বম্ভর রায়ের প্রশ্ন, যা জলের মতো ঘুরে ঘুরে এক অবচেতন রাগিনীর মতো গভীর দার্শনিক অন্বয় সৃষ্টি করে। প্রকৃষ্ট অর্থে ছবির ‘রচয়িতা’ (ফরাসিতে ‘auteur’) বলেই তাঁর পক্ষে এসব সম্ভব হয়েছে।
সংলাপ বিষয়ক এক প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন (‘চলচ্চিত্রের সংলাপ প্রসঙ্গে’, ১৯৬৩, ‘বিষয় চলচ্চিত্র’, ২০০৭ সং, পৃ ৬১): সংলাপ যদি স্বাভাবিক না হয় তাহলে অভিনয় স্বাভাবিক হওয়া মুশকিল। বাস্তব জীবনে মানুষ একই বক্তব্য বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্ন ভাষায় ব্যক্ত করে। একই কথা অলসমুহূর্তে একভাবে, কর্মরত অবস্থায় আরেকভাবে; এমনকী গ্রীষ্মে ঘর্মাক্ত অবস্থায় একভাবে এবং শীতে কম্পমান অবস্থায় আরেকভাবে ব্যক্ত হয়। নিরুদ্বিগ্ন অবস্থায় মানুষের কথার লয় হয় বিলম্বিত, উত্তেজক অবস্থায় মানুষের কথা কেটে যায়, বাক্য উত্থিত হয় নিঃশ্বাসের ফাঁকে ফাঁকে।
সত্যজিৎ মনে করিয়ে দিয়েছেন মানুষে মানুষে অতি গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণিগত পার্থক্যের কথা। মনে করিয়ে দিয়েছেন, চিত্রনাট্যকার কীভাবে তাঁর নিজস্ব সত্তাকে ‘সম্পূর্ণ বিলীন করে, তার চরিত্রের অন্তরে প্রবেশ করে সেই চরিত্রের সত্তাটিকে সংলাপের দ্বারা’ ফুটিয়ে তুলতে পারেন। তিনি জানেন, সময়ের দাম কত বেশি। জানেন, অল্প কথায় যত বেশি বলা যায় তত ভালো, ‘আর কথার পরিবর্তে যদি ইঙ্গিত ব্যবহার করা যায়, তবে তো কথাই নেই।’
চরিত্রোপযোগী সংলাপের জন্য অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও স্মরণশক্তির প্রয়োজন, যে বিষয়ে তাঁকে তালিম দিয়েছিলেন স্বয়ং বিভূতিভূষণ। কিন্তু ‘পথের পাঁচালী’-র চিত্রনাট্যকার তাঁর সমগ্র শিল্পকর্মে কীভাবে পরিবর্তমান সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের বহুস্তর মানসিকতাকে পর্দায় ফুটিয়ে তুললেন, তা প্রণিধানযোগ্য। এই কাজ ভারতীয় চলচ্চিত্রে আর কেউ পারেননি।
আমরা কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে সত্যজিতের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাকে অনুধাবন করার চেষ্টা করব।
‘সীমাবদ্ধ’ ছবিতে নব্য ধনীদের পার্টি।
রুনু সান্যাল (চশমা পরা সহকর্মীর দিকে তাকিয়ে): একটা লকেট।
সৌম্যেন (তির্যক কণ্ঠে মাথা হেলিয়ে): হাতে এসে গেল?
রুনুর স্ত্রী: Gold locket, জানেন, not an ordinary one…
রুনু (পাশে বসা ভদ্রমহিলাকে): Not just any locket– you know! একদিকে ভদ্রলোকের… CUT TO
খুব দ্রুত একবার পানরত শ্যামলেন্দু আর এক সহকর্মী মি. মল্লিক ও একবার টুটুলকে দেখা যায়। মি. মল্লিক গ্লাস হাতে একদৃষ্টে সুসজ্জিতা টুটুলকে দেখছেন। রুনু সান্যালের সংলাপ ওভারল্যাপ করে।
রুনু (নেপথ্যে): নিজের ছবি… আরেক দিকে তাঁর গুরুর ছবি…
ভদ্রমহিলা (নেপথ্যে): তারপর?
রুনু (নেপথ্যে): এইটা পরে থেকো… CUT TO
রুনু: আর fit হবে না। And I know this for a fact…
চশমা পরিহিত সেই সহকর্মী প্যাকেট থেকে সিগারেট নিয়ে মুখে দেন। রুনুর বাকি সংলাপ ওভারল্যাপ করে।
রুনু (নেপথ্যে): তারপর ভদ্রমহিলার আর কোনও…
‘জন অরণ্য’। এক অন্য জগৎ। এখানেও দেখব শুধু সংলাপের মধ্য দিয়ে দু’টি চরিত্রের ওপর আলো ফেলার আশ্চর্য ক্ষমতা।
নটবর: ভদ্রলোকের গুরুটুরু আছেন? আপিসে বাঁধানো ছবি দেখলেন?
সোমনাথ: ছবি আছে– তবে ওঁর গুরু না, ওঁর স্ত্রীর গুরু।
নটবর: স্ত্রীর চাপে পড়ে ছবি রেখেছেন।
সোমনাথ: তাই তো বলল।
নটবর: সেক্রেটারি আছে?
সোমনাথ: আছে।
নটবর: দেখলেন?
সোমনাথ: হুঁ।
নটবর: কেমন?
সোমনাথ: ভালোই তো।
নটবর: আরও স্পষ্ট করে বলুন। শুকনো ভালো, না শাঁসালো ভালো?
সোমনাথ: শাঁসালোই বলা চলে বোধহয়।
নটবর: হুঁ…। অবিশ্যি সেটার উপর খুব বেশি নির্ভর করা চলে না। শখ করে শুকনো মেয়ে কেউ আপিসে রাখে না।
একটু পরে।
নটবর: আপনি মদ খান?… খান?
সোমনাথ মাথা নেড়ে না বলে।
নটবর: ড্রাগস? গাঁজা, চরস, ভাং, আফিং, চণ্ডু–? বেশ্যালয়ে যান?
নটবর: আপনি এই যে সৎ লোক হবার জন্য ছটফট করছেন– এর থেকে কী আশা করছেন আপনি? এ জন্য পদ্মশ্রী পাবেন আপনি? স্রেফ চরিত্র ভালো বলে খেতাব পেয়েছে একজন লোক– এরকম কোনও উদাহরণ দিতে পারেন? মিস্টার ব্যানার্জি– আজকের দিনে, আপনি একটি লোকের নাম করুন– public figure– একেবারে top থেকে ধরুন– যার নামে আজ পর্যন্ত একটাও কলঙ্ক রটেনি, যার চরিত্র ‘spotless’ বলে জানা গেছে, প্রমাণ পাওয়া গেছে–
সত্যজিৎ রায় এক মনস্তত্ত্ববিদের মতো করে চরিত্র নির্মাণ করছেন, সংলাপ তাঁর অস্ত্র।
(চলবে)
ফটোগ্রাফির মস্ত শখ বিপুলদার। মাঝে মাঝেই ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন ছবি তুলতে পত্রপত্রিকার জন্য। নানা বিষয়ে আজগুবি সব ছবি দেখেছি সে ছবি খুব একটা কোথাও প্রকাশ করতেন না। অবাক হয়েছিলাম ওঁর পাবলিক টয়লেটের প্যান ভর্তি বিষ্ঠার ছবি দেখে। অনেক। গা ঘিনঘিন করেনি, বরং মনে হচ্ছিল যেন চমৎকার সব বিমূর্ত চিত্রকলা।