Robbar

বুদ্ধদেব গুহ বাঙালির স্লো ট্যুরিজমের পথপ্রদর্শক

Published by: Robbar Digital
  • Posted:May 5, 2025 8:14 pm
  • Updated:May 5, 2025 8:14 pm  

ভারতের স্লো ট্যুরিজম যে ‘স্থান-নিবিড়’ ভ্রমণের প্রবণতা বাড়ছে– তা অনেকাংশেই বুদ্ধদেব গুহর পাঠকরা বহু আগেই অভ্যস্ত। ২০২২ সালের একটি ভারতীয় পর্যটন মনিটরিং সমীক্ষায় দেখা গেছে: ৬১% অভ্যন্তরীণ পর্যটক ‘নেচার কানেকটেড লং স্টে’-এর প্রতি আগ্রহী, যার মধ্যে ৪০% চেয়েছে সাহিত্য ভিত্তিক গন্তব্য। যেমন– ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়ার জঙ্গল, ডুয়ার্স, বাঁকুড়া– এসব জায়গা এখন ‘ গুহ-অনুরাগী স্লো ট্র্যাভেলার’ -দের কাছে নতুন গন্তব্য। তাঁর লেখা ‘মাধুকরী’, ‘কোয়েলের কাছে’, ‘একটু উষ্ণতার জন্য’, ‘ঋজুদার সঙ্গে জঙ্গলে’, ‘বন জ্যোৎস্নায় সবুজ অন্ধকারে’,– এই উপন্যাসগুলো ভ্রমণের বাহ্যিক গল্প নয়, বরং স্থানের সঙ্গে গভীর আত্মিক সংলাপ।

আদিত্য ঘোষ

পুবে সবে আলো ফুটেছে। পুবের পাহাড়টার জন্য আলো পৌঁছাতে একটু দেরি হয় উপত্যকাতে। আলো এসে পোঁছাতেই ভোঁর ঘাসের মাঠের উপর রাতভর জমা শিশিরে লক্ষ লক্ষ হীরে ঝিকমিক করে। লাল সাদা ফুল এসেছে ঘাসগুলোতে। ঘাসের মাঠের আঁচল ঘিরে শুখরা বা চোরকাঁটার বর্ডার। তারপরই গহীন জঙ্গল। চারিদিকে সাজা, শাল, ধাওয়া, বহেড়া, কাসসী কুহমী, বেল, চ্যাঁর, জামুন, পলাশ ইত্যাদি নানা গাছগাছালি…

Bengali Novel | MADHUKORI | Buddhadeb Guha | Bengali Fiction Literature [Hardcover] Buddhadeb Guha [Hardcover] Buddhadeb Guha : Amazon.in: Books

এই অংশটিমাধুকরী’ উপন্যাসের অন্তর্গত। লেখক বুদ্ধদেব গুহ। না, লেখক নয় জংলী বুদ্ধদেব গুহ। এই উপন্যাসের শুরুতে একটি কথা লেখা আছে, বইটি একবিংশ শতাব্দীর নারী এবং পুরুষদের জন্য উৎসর্গীকৃত! একেই বলে দূরদর্শিতা। গুহ মশাইয়ের প্রতিটা উপন্যাসই আসলে একটা ভ্রমণ। যেখানে কিছু চরিত্র একটি নির্দিষ্ট স্থানে একটি জীবন গড়ে তুলে তুলেছে। একটা জীবনের মধ্যে অনেকগুলো জীবন ভেসে উঠেছে। একটি স্থানের আত্মকথা উঠে এসেছে। কোনও পিছুটান নেই। ছুটে যাওয়া নেই। দৌড় নেই। আছে চুপি চুপি পাথরের উপরে বসে থাকা। একটা জঙ্গলের মধ্যে অনেকগুলো জঙ্গলকে আবিষ্কার করা। পেয়ারা গাছের ডাল বেয়ে আসা প্রথম রোদের আলোকে গালে মেখে ওপাশ ফিরে শুয়ে থাকা। স্থানীয় খাদ্যসম্ভারের স্বাদ পেয়েছি ওঁর লেখা থেকে। জঙ্গলে বুনো শুয়োরের মাংস সেঁকেছি যেন ওঁরই পাশে বসে। গুহ মশাইয়ের লেখা জীবন্ত। উনিই তো আমাদের শিখিয়ে গিয়েছেনস্লো ট্যুরিজমমাহাত্ম্য।

প্রসঙ্গতস্লো ট্যুরিজমশব্দটা একেবারেই আজকের আমদানি নয় এবং এর সঙ্গেসোলো ট্যুরিজম’-এর কোনও সম্পর্ক নেই। স্লো ট্যুরিজম ধারণা প্রথম উঠে আসে ১৯৮০এর দশকে ইতালিরস্লো ফুড মুভমেন্ট (Slow Food Movement)’-এর প্রেক্ষাপটে, যার মূল কথা ছিল: স্থানীয়, প্রাকৃতিক, ধীর এবং সচেতন খাদ্যগ্রহণ। সেখান থেকেই জন্ম নেয় স্লো ট্রাভেল বা স্লো ট্যুরিজমযার মূল লক্ষণ: প্রকৃতির সঙ্গে সম্পূর্ণ সাযুজ্য রেখে চলা, স্থানীয় সংস্কৃতি, খাবার, ভাষা, মানুষের সঙ্গে গভীর সংযোগ, পর্যটক হিসেবে নয়, সহযাত্রী হিসেবে থাকা  এবং ‘চেকলিস্টনির্ভর দ্রুত ভ্রমণের বিরোধিতা! অর্থাৎ প্ল্যানিং করে নয়, মন যা চাইছে সেটা শুনে পরবর্তী গন্তব্য ঠিক করা। বিশ্ব পর্যটন সংস্থা (UNWTO)- মতে, স্লো ট্যুরিজম হল এমন এক ভ্রমণ পদ্ধতি, যা সময়, স্থান এবং মানুষের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানায়। স্লো ট্যুরিজম– আজকের দ্রুতগামী যান্ত্রিক জীবনে এক বিকল্প দর্শন। এটি কেবল ভ্রমণ নয়, বরং একটি মনোভাব: ‘ভোগ নয়, সংযোগ; দ্রুততা নয়, স্থিতি।এই দর্শন ভারতবর্ষের প্রাচীন আচারসংস্কারতীর্থভ্রমণ, আশ্রমবাস, বনবাস, একান্ত আত্মিক সাধনার সাথে একসূত্রে বাঁধা। আজ যখন বিশ্বব্যাপী টেকসই পর্যটনের কথা বলা হচ্ছে, তখন ভারতও তার নিজস্ব উপায়ে স্লো ট্যুরিজমকে এগিয়ে আনছে– অবশ্যই সীমাবদ্ধতা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে। ২০২২  সালের বুকিং ডট কম (Booking.com)এর সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতের ৭৪% পর্যটক টেকসই ভ্রমণের গুরুত্ব মানেন। আবার সেই সমীক্ষাতেই দেখা যায়, ৪৬% ভারতীয় পর্যটক চান কম জনবহুল, কমকমার্শিয়াল গন্তব্যে যেতে।

ভারত সরকারেররুলাল সার্কিট’ (Rural Circuit)ইকো  ট্যুরিজম’ (Eco Tourism Circuit)-এর ২০২৩ সালে বরাদ্দ হয়েছিল ১২০০ কোটি টাকা। বিশ্ব পর্যটন সংস্থা (UNWTO)-এর ২০২৩ রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে স্লো ট্যুরিজম (slow tourism)থেকে আয় হয়েছে আনুমানিক ৪৭০০ কোটি টাকা। কেরালায় ২০২৩ সালের পর থেকে ১২,০০০এরও বেশি হোমস্টের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। সিকিম, নাগাল্যান্ড, লাদাখে ২০২০২৪এর মধ্যে হোমস্টে বৃদ্ধি পেয়েছে ২৫%-৩০% হারে। ২০২৩ সালের পর এয়ারবিএবনি (Airbnb)তে ভারতেনো ওয়াইফাই রুলাল স্টে‘( no-WiFi rural stays) সার্চ ৩১% বেড়েছে। সমীক্ষা বলছে ভারতীয় পর্যটকেরা ১০ দিনের বেশি সময় ধরে এক জায়গায় থাকার প্রবণতা বেড়েছে। হিমাচল, গোয়া, উত্তরাখণ্ডের কিছু হোমস্টে এখনস্লো ওয়ার্ক হাব’ বানাচ্ছে। ভারত সরকার এই বিষয়ে জোর দিচ্ছে।দেখো আপনা দেশকর্মসূচি ২০২৩২৪: ১০টি স্লোভিত্তিক ট্রেল চালু হয়েছে। একটা সময় ছিল যখন কোথাও ট্যুরে গেলে, সকাল থেকে রাত অবধি কোথায় যাব সেই প্ল্যানিং নিয়েই মাথা ব্যথা থাকত, এখন সেই ট্রেন্ড পাল্টাচ্ছে। একেই বলে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা! এখন চুপচাপ কোনও একটি স্থানে গিয়ে বসে থাকা। জোনাকির ডাক শোনা। পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে ছুটে আসা আলোকে ধরতে না চেয়ে, স্থির হয়ে চেয়ে থাকা গভীরতার দিকে। কোনও শূন্যতার খোঁজে প্রতীক্ষা করতে করতে ঝিমিয়ে থাকা কোনও নির্জন স্থানে। একেই তো বলে বেঁচে থাকা।

Darjeeling Tourism | Darjeeling Travel Guide

ভারতের স্লো ট্যুরিজম যেস্থাননিবিড়ভ্রমণের প্রবণতা বাড়ছে– তা অনেকাংশেই বুদ্ধদেব গুহর পাঠকরা বহু আগেই অভ্যস্ত। ২০২২ সালের একটি ভারতীয় পর্যটন মনিটরিং সমীক্ষায় দেখা গেছে: ৬১% অভ্যন্তরীণ পর্যটকনেচার কানেকটেড লং স্টে‘-এর প্রতি আগ্রহী, যার মধ্যে ৪০% চেয়েছে সাহিত্য ভিত্তিক গন্তব্য। যেমন– ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়ার জঙ্গল, ডুয়ার্স, বাঁকুড়া– এসব জায়গা এখনগুহঅনুরাগী স্লো ট্র্যাভেলার‘ –দের কাছে নতুন গন্তব্য। তাঁর লেখামাধুকরী’, ‘কোয়েলের কাছে’, ‘একটু উষ্ণতার জন্য’, ‘ঋজুদার সঙ্গে জঙ্গলে’, ‘বন জ্যোৎস্নায় সবুজ অন্ধকারে’,– এই উপন্যাসগুলো ভ্রমণের বাহ্যিক গল্প নয়, বরং স্থানের সঙ্গে গভীর আত্মিক সংলাপ।

তখন বৈশাখের শেষ। বুদ্ধদেব গুহ তখন ত্রিশের কোঠায়। ‘দেশ’ পত্রিকায় তখন ওঁর কবিতা ছাপা হয়। শিকারের গল্প প্রকাশিত হয়। দক্ষিণীতে গান শেখেন। সিএ পরীক্ষার জন্য পড়ছেন এবং চাকরিও করছেন। সেই গুহ মশাই তখন ঋতু গুহের প্রেমে পড়ছেন। কিন্তু কীভাবে বলবেন, বুঝে উঠে পারছেন না। তাঁরা তখন একই জায়গায় গান শেখেন। তবুও তাঁদের মধ্যে কথাবার্তা নেই। একদিন তিনি একটি ১৬ পাতার চিঠি লিখলেন। কিন্তু সেই চিঠি দেব দেব করে দেওয়া হল না। ইতিমধ্যে সেই চিঠি বুকপকেটে ঘামে ভিজে গিয়েছে। অর্ধেক লেখাই উবে গিয়েছে। তিনি আবার লিখলেন এবং সাহস করে একদিন তাঁকে দিয়ে বললেন তিনদিনের মধ্যে জবাব চাই। বেশ গম্ভীরভাবে। ঘটনাটা একটি ট্রাম লাইনের পাশে। তবে তিন দিনটা প্রায় তিন সপ্তাহে ঠেকল। তবুও উত্তর পেলেন না। তারপর হঠাৎ একদিন একটি টেলিফোন পেলেন ঋতু গুহের এক আত্মীয়ের থেকে।আগামীকাল আকাশবাণীতে তাঁর গানের অনুষ্ঠান আছে। অনুষ্ঠান শেষে তিনি আপনার চিঠির জবাব দেবে।

গুহ মশাই গেলেন। গানের অনুষ্ঠান শেষে ঋতু গুহ গীতবিতান বুকের মাখখানে নিয়ে এলেন এবং বললেন, ‘আমি এসেছি!’ এই পুরো ঘটনাটা ভিতর একটা অন্তহীন অপেক্ষা আছে। দীর্ঘ চিঠি লেখার মধ্যে তাড়াহুড়োর জীবন থেকে সাময়িক বিচ্যুতি আছে। পালামৌর জঙ্গলের মাদকতা আছে। তাঁর ‘খেলা যখন’ উপন্যাসও তো এক ধরনের ভ্রমণ। কাউকে পাওয়ার জন্য ধীরে পায়ে অপেক্ষা করা।

ইট প্রে লাভসিনেমাটির কথা মনে আছে? সেখানে এক দৃশ্য বলা হচ্ছে , ‘সুইটনেস অফ ডুইং নাথিং‘! হ্যাঁ, এইরকম এক ভাবধারার উদাহরণ আছে গোয়াতে। স্থানীয়দের ভাষায় এটিকে বলা হয় সুসেগাড। সুসেগাড (Susegad)হল গোয়ার একটি বিশেষ সাংস্কৃতিক জীবনদর্শন। এই শব্দটি এসেছে পর্তুগিজ শব্দ সুসেগাডো (sossegado)থেকে, যার অর্থশান্ত, ‘নিরুদ্বেগবানির্বিঘ্ন জীবনধারা গোয়ার মানুষজন জীবনের প্রতি একটি ধীর, নির্লিপ্ত, এবং পরিপূর্ণ উপভোগধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন।সুসেগাডমানে হল– কাজ এবং অবসরের মধ্যে ভারসাম্য রাখা, জীবনের ছোট ছোট আনন্দ উপভোগ করা, তাড়া না দিয়ে ধীরে বাঁচা, মানসিক শান্তি পারিবারিক সময়কে গুরুত্ব দেওয়া। অফিস বা দোকান অনেক সময় দেরিতে খোলে, দুপুরে দীর্ঘ বিরতি নেয়, ধীরে ধীরে ঘোরা, প্রকৃতি দেখা, গ্রামের ভিতরের সংস্কৃতি বোঝা– এটাই আসলস্লো ট্যুরিজম। বিশ্বব্যাপী ভ্রমণকারীরা এখন দীর্ঘ সময় ধরে একটি গন্তব্যে অবস্থান করতে পছন্দ করছেন। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৮৯.% ভ্রমণকারী পুরো ছুটির সময় একটি স্থানেই থাকতে চান, যা স্লো ট্যুরিজমের মূল দর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। হিলটনের ২০২৫ সালের ট্রেন্ড রিপোর্ট অনুযায়ী, ৭৩% ভ্রমণকারী তাদের সন্তানদের সঙ্গে ভ্রমণের সময় স্থানীয় অভিজ্ঞতা খুঁজে পান। ভ্রমণকারীরা এখন কম পরিচিত, কম ভিড়যুক্ত গন্তব্যে ভ্রমণ করতে আগ্রহী, যা স্লো ট্যুরিজমের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। বুদ্ধদেব গুহর উপন্যাস এবং গল্পগুলিতে আমাদের যে পরিবেশ, প্রকৃতি, এবং জীবনযাপনের চিত্র দেখতে পাওয়া যায়, তা আধুনিক স্লো ট্যুরিজমের সঙ্গে এক গভীর সংযোগ স্থাপন করে। তাঁর রচনাগুলিতে ভ্রমণ কোনও  তাড়াহুড়ো বা নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছনোর প্রক্রিয়া নয়, বরং একটি অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে স্থিতি, শান্তি এবং আত্মঅনুসন্ধান করা। দার্জিলিং কালিম্পংয়ের মতো পাহাড়ি এলাকায় স্লো ট্যুরিজমের ধারণা ভালোভাবে প্রবল হয়েছে। এখানকার পরিবেশ, প্রকৃতি এবং স্থানীয় সংস্কৃতি এই ধরনের পর্যটনকে এক বিশেষ স্থানে নিয়ে গেছে। পর্যটকরা তাড়াহুড়ো না করে, পাহাড়ি গ্রামে বাস করা, চা বাগানগুলো পরিদর্শন করা, এবং স্থানীয়দের সঙ্গে মিশে জীবনযাত্রার প্রকৃত সৌন্দর্য অনুভব করার সুযোগ পান। মুর্শিদাবাদ, যা তার ঐতিহাসিক সৌন্দর্যের জন্য পরিচিত, সেখানে স্লো ট্যুরিজমের ধারণা এগিয়েছে। পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন ছোট ছোট শহর গ্রামে ধর্মীয় স্থানসমূহ যেমন বর্ধমানের মহম্মদপুর মন্দির, বীরভূমের প্রাচীন শক্তিপীঠ– এগুলো স্লো ট্যুরিজমের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে। সুন্দরবন গাঙচিল এলাকায় স্লো ট্যুরিজমের ধারণা বিশেষভাবে জনপ্রিয়। সুন্দরবনের অদ্ভুত সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ব্যবস্থা এখানে পর্যটকদের ধীরে ধীরে প্রকৃতির সঙ্গী হওয়ার সুযোগ দেয়। ২০২৩ সালে পশ্চিম বাংলায় মোট ১৮ কোটি পর্যটক আগমন ঘটেছে, যা একটি নতুন রেকর্ড। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৪. কোটি। এই প্রবৃদ্ধি রাজ্যের পর্যটন খাতের উন্নতির ইঙ্গিত দেয়। রাজ্যের পর্যটন খাত ১৫% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এটি রাজ্যের মোট জিডিপির ১৩% অবদান রাখছে। এছাড়া, রাজ্যের মোট কর্মসংস্থানের প্রায় % এই খাতে রয়েছে।

ভ্রমণ একসময় ছিল আত্মার যাত্রা, ছিল ধীরে দেখা, অনুভব করার অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ধরনটি বদলেছে। ভ্রমণের মানে বদলে গেছে; আর এই বদলের নেপথ্যে অন্যতম চালিকা শক্তি হচ্ছে পুঁজিবাদ। আজকের দিনে দাঁড়িয়েভ্রমণ’ মানে শুধুই নয় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া– এটি এক সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক পণ্যে রূপান্তরিত হয়েছে, যেখানে গন্তব্য নয়, বিক্রয়যোগ্যতা মুখ্য হয়ে উঠেছে। পুঁজিবাদ ভ্রমণকে দেখেছে একটি নতুনমার্কেট সেগমেন্টহিসেবে। ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আজ বাজারজাত পণ্যে পরিণত হয়েছে। প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রাম, নির্জন সমুদ্রতট, জঙ্গলের কিনার– সবই এখন বিজ্ঞাপনের ভাষায়এক্সক্লুসিভ ডেস্টিনেশন।সেখানে যাওয়ার জন্য তৈরি হয় প্যাকেজ, নির্ধারিত হয় দাম, পর্যটক হয়ে ওঠে গ্রাহক। ফলে জায়গাগুলোর মৌলিকতা হারিয়ে যায়, স্থানগুলি হয়ে পড়ে একঘেয়ে, কপিপেস্ট অভিজ্ঞতার ধারক। তবে এই পুঁজিবাদী ভ্রমণ শুধু স্থান সংস্কৃতির ওপরই নয়, মানুষের মানসিকতার ওপরও গভীর প্রভাব ফেলেছে। আজ আমরা ভ্রমণ করি ক্লান্তি কাটাতে নয়, বরং অন্যদের চোখেভালোহয়ে উঠতে। আমরাভ্রমণকরি না, ‘ভ্রমণের প্রমাণতৈরি করি। ইনস্টাগ্রামের জন্য ছবি, টিকটকের জন্য ভিডিও, ইউটিউবের জন্য রিভিউ– এই হচ্ছে ভ্রমণের চালিকা শক্তি। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নয়, ডিজিটাল চর্চা এখন মুখ্য। ফলে যা হারিয়ে যায় তা হলো ভ্রমণের নিজস্ব নীরবতা– একাকিত্ব, মুগ্ধতা, থমকে দাঁড়ানো। পুঁজিবাদ এমন এক দ্রুতগামী কাঠামো তৈরি করেছে, যেখানে ভ্রমণও হতে হবে চটজলদি। দিনেই পাহাড় দেখা, জঙ্গল ঘোরা, ট্রেকিং করে ফিরে আসা– এই হাইস্পিড অভিজ্ঞতা মানুষের মনে স্থায়ী কিছু রেখে যায় না। অথচ প্রকৃতি নিজে ধীর; সে ধৈর্য দাবি করে। পুঁজিবাদ সেই ধৈর্যকে মানে না। তার কাছে সময় মানে পণ্য। আর প্রতিটি মুহূর্তকে সেক্যাশকরতে চায়। স্লো ট্যুরিজম এক ধরনের প্রতিরোধ– তাড়াহুড়োর বিরুদ্ধে, পোস্টযোগ্য জীবনের বিরুদ্ধে, এবং একঘেয়ে শহুরে ছাঁচের বিরুদ্ধে। অনেকে একেট্যুরবলে মানবেন না, কারণ তারা ভুলে গেছেন ভ্রমণের আসল মানেনিজেকে জানা, অন্যকে উপলব্ধি করা, প্রকৃতিকে ফিরে পাওয়া। তাই স্লো ট্যুরিজম হয়তো কম জনপ্রিয়, কিন্তু সময়ের দাবি। যারা একেট্যুরবলে মানেন না, তাঁরা হয়তো এখনও প্রকৃতভ্রমণবুঝে উঠতে পারেননি। এখন তো ভ্রমণ মানেই সকালে গিয়ে কমপ্লিমেনটারি ব্রেকফাস্ট আর গাড়ি করে স্টেশন অবধি পৌঁছে দেওয়া। আর কতগুলো লোকদেখানো মুহূর্ত।

……………………………..

ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল

……………………………..

আজ থেকে বহু বছর আগেই বাঙালির রক্তে স্লো ট্যুরিজিমের বীজ পুঁতে রেখে গিয়েছিলেন বুদ্ধদেব গুহ। যিনি নিজেকেজংলী’ বলতেন। জিজিটাল যুগেও চিঠি লেখাকে গুরুত্ব দিতেন। রং-তুলি দিয়ে ছবি আঁকাতে ভালবাসতেন। সমাজের একেবারে নিম্ন স্তরের মানুষদের সঙ্গে মিশতে ভালবাসতেন। জঙ্গলের মাদকতাকে বুকে নিয়ে ঘুমোতে যেতেন। সোনালী রোদের বৃষ্টির তলায় টেবিল পেতে বসে থাকতে পারতেন বছরের পর বছর। এক মুহূর্তে ভালোবাসতে পারতেন প্রাকৃতিক সব কিছুকেই, সেই গুহ মশাই তো বাঙালিদের মনে বুনো গন্ধটা ধরিয়ে দিয়েছেন অনায়াসে। মাধুকরী তো জীবনের গল্প, উনি বলতেন ‘সাগা অফ লাইফ’! ঋতু গুহ যখন মারা যান, তখন বুদ্ধদেব গুহ তাঁর মৃতদেহের সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘জীবনটা তো একটা ভ্রমণ, সেখানে তো ভুল-ত্রুটি হবে।’

সত্যিই তাই, জীবনটা তো একটা যাত্রা, কেউ উপভোগ করছে, কেউ ছুটছে। 

Buddhadeb Guha, Slow Tourism, Literature and Travel, Bengali Literature, Travel Philosophy, Modern Tourism Critique