ব্যক্তিগত দুঃখকে মানুষ উতরে যায় বারবার। ছোট ছোট পরিসরে, প্রায় প্রতি মুহূর্তেই। এমনও হয় যে, খুব নিকটজনের মৃত্যুর দিনও মানুষ কর্মবিরতি নেয় না। কাজেই ঢাকা পড়ে যায় অনন্ত শোকের সন্তাপ। তবু শোক থাকে, ছায়ার মতো, সঙ্গী হয়ে। সেই ছায়ামানুষের স্মৃতি ক্রমাগত স্বপ্ন দেখায়। সদ্য লুইস এনরিকের সঙ্গেও কি এরকমই হল না? ৯ বছরের কন্যাসন্তানের মৃত্যুর পর তাঁর উঠে দাঁড়ানো, আমাদের দুঃখের চির আবরণ থেকে বেরিয়ে, স্বপ্ন দেখতে শেখায়। হারবেন না, ক্লান্ত হবেন না, স্বপ্ন দেখুন।
মিউনিখে তখন মায়াবী রাত। আতশবাজির রোশনাইয়ে উজ্জ্বল আলিয়াঞ্জ এরিনার আকাশ, আবেগস্নাত গ্যালারি। সেই আনন্দধারার মাঝে কোনও এক জ্যোৎস্নার রাত কি খুঁজছিলেন লুইস এনরিকে? যে রাতের সন্ধান বহু যুগ আগে পেয়েছিলেন তাঁর মতো সন্তানহারা আরেক পিতা। রেলগাড়িতে আসতে আসতে যাঁর দৃষ্টি চলে যাচ্ছিল বাইরের দিকে। অন্তরে তখন সন্তাপের গাঢ় আঁধার। অথচ তিনি দেখছিলেন, জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে আকাশ। কোথাও কিছু কম নেই। বিন্দুমাত্র নয়। বরং পরিপূর্ণ। তাঁর মন বলছে, সে আছে, সমস্তর মধ্যে। আসলে সমস্তর মধ্যে সবই রয়ে গিয়েছে, তিনিও রয়েছেন তারই মধ্যে।
পুত্র শমীকে তো এভাবেই অনন্তের মাঝে খুঁজে নিতে চেয়েছিলেন পিতা রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু লুইস এনরিকে? তিনি কোথায় পেলেন এই জীবনবোধ, মৃত্যুর মোকাবিলায় যা তাঁর বেঁচে থাকার আশ্রয় হবে! হয়তো মেয়ে শানার কাছেই। যে একরত্তি মেয়ে ছ’-বছর আগে হারিয়ে গেছে চিরকালের মতো, তাঁকে নিঃসঙ্গ করে।
২০১৯-এর আগস্ট। এক পড়ন্ত বিকেল। নয় বছরের শানা আর লুইস এনরিকের মধ্যে দাঁড়ি টেনে দিয়েছিল মৃত্যু। মাত্র নয় বছর বয়সে অস্টিওসারকোমা (হাড়ের ক্যানসার) কেড়ে নিয়েছিল এনরিকে-কন্যাকে। সেই শোককে পাথেয় করে ফুটবল থেকে দূরে গিয়েছিলেন স্প্যানিশ প্রশিক্ষক। বিচ্ছিন্ন হতে পারেনি, হয়তো শানার টানেই। ফিরেওছেন। যেভাবে শোককে হারিয়ে ফিরে আসে মানুষ, নিজেকে অনন্য প্রমাণে।
তবু শোকসন্তপ্ত বাবার সেই বিচ্ছেদযন্ত্রণার মধ্যে জেগে ছিল এক অবিনশ্বর ছবি। এক বাবা-মেয়ের স্থিরচিত্র। বার্লিনের মাঠে– সেন্টার সার্কেলে বার্সেলোনার পতাকা গেঁথে দিচ্ছেন এনরিকে। পাশে শামিল তাঁর মেয়ে– শানা। সেই ছবি আবার ফিরবে, স্প্যানিশ কোচ বোধহয় জানতেন। চুপিচুপি সে-কথা কি তাঁকে বলে গিয়েছিল শানা? নয়তো কেনই বা মৃত সন্তানের অলীক উপস্থিতি মেনে নেবেন ধ্রুবতারা-জ্ঞানে, জীবনের পথ-প্রদর্শক রূপে!
চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ী পিএসজি-র গ্যালারিতে ভেসে ওঠা টিফো প্রমাণ করে দিয়েছে এনরিকের নির্ভুল ছিলেন। কী ছিল সেই টিফোয়? ২০১৫-র বার্সেলোনার মতো প্যারিস সাঁ জাঁ-র ক্লাব-পতাকা মাঠে গেঁথে দিচ্ছেন তিনি, পাশে ৮ নম্বর জার্সিতে কন্যা শানা। বছর দশেক আগের বার্সা-স্মৃতি উসকে এভাবেই পিএসজি-র সমর্থকরা মনে করালেন, এনরিকে ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে আছেন তারা। তফাত শুধু একটাই, সেদিন পাশে শানা ছিল। সশরীর। আজ নেই। তবু সে অমলীন, অক্ষয়।
মৃত্যু তাকে কাড়তে পারেনি এনরিকের কাছ থেকে, বরং আরও প্রত্যক্ষ করে তুলেছে প্রতিনিয়ত, মানস-ভুবনে। শোকের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে তাই নিজেকে ‘ভাগ্যবান’ বলে মনে করেন এনরিকে। কারণ, তাঁর কাছে শানার সঙ্গে কাটানো অমূল্যবান ন’টা বছর আছে। আছে সেই নয় বছরের অজস্র স্মৃতি, ছবি, ভিডিও। তাকে দৈনন্দিন জীবন থেকে মুছে ফেলেননি স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে। বরং নিজের যাপনের সঙ্গে জুড়ে নিয়েছেন। তাই সশরীরে না বা হোক, আত্মিক যোগে শানা এখনও বেঁচে এনরিকের জীবনে। মৃত্যুদাগ থামিয়ে দিতে পারেনি বাবা-মেয়ের পথ-চলা। ফাইনাল শেষে এনরিকে তাই যেন উত্তাল গ্যালারির মধ্যে মেয়েকেই খুঁজছিলেন। তার সজীব উপস্থিতি টের পাচ্ছিলেন গায়ে গলিয়ে নেওয়া ‘শানা ফাউন্ডেশন’-এর বিশেষ টি-শার্টে, যেখানে টিফোর মতো পিএসজির পতাকা নিয়ে কার্টুন-বেশে দাঁড়িয়ে এক বাবা, এক মেয়ে– এনরিকে আর শানা। এমনটাই তো চেয়েছিলেন স্প্যানিশ কোচ? এভাবেই মৃত্যুকে হারিয়ে জীবনকে ঘিরে বাঁচতে!
খেলার মঞ্চ ব্যক্তিগত শোক থেকে ফিরে আসার পথ দেখায়। বাবার মৃত্যুর পর শচীন ফিরেছিলেন, ক্রিকেটকে আশ্রয় করে। বিশ্বকাপের মঞ্চ তাঁকে আবিষ্কার করেছিল শোক-ভোলানো মহাকাব্যিক শতরানে। রনজির মঞ্চ খুঁজে পেয়েছিল এক অনন্য বিরাটকে, সদ্য বাবাকে হারানো সেই বিরাট দেখিয়েছিলেন ক্রিকেট আসলে সন্তাপ-হরণের সঞ্জীবনী। নবজাতকের মৃত্যুশোক ভুলতে ফুটবলকেই আশ্রয় করেছিলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো।
রবিবার রাতে পিএসজির কাছে ইন্টারের হারটা তাই নিয়তি নির্ধারিত ছিল। এনরিকের এই বাঁচার স্বপ্নের কাছে হার মানতেই হত মৃত্যুকে। এক মেয়ে-হারানো বাবার কাছে তো বটেই।
…………………………….
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিডিটাল
…………………………….