এই যে ‘অপর’ বা ‘Other’-এর ধারণা– শিল্প বা সাহিত্য দিয়ে কি সত্যিই তাকে মুছে ফেলা সম্ভব? ‘নোয়া নোয়া’ বা বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’ পড়লে কিন্তু মনে হয় আপ্রাণ চেষ্টা করেও সত্যচরণ বা গগ্যাঁ কখনওই ‘ওদের’ একজন হয়ে উঠতে পারেননি। তাই বিভূতিভূষণের লেখা ‘আরণ্যক’ রাজকন্যা ভানুমতি, মঞ্চি অথবা ধাতুরিয়া কোনওদিন পড়বে না; যেমন গগ্যাঁর তাহিতিয় স্ত্রী তেহুরা কোনওদিন নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টে বা ইউরোপের কোন আর্ট গ্যালারিতে দেখতে আসেননি তাঁকে মডেল করে আঁকা যুগান্তকারী ছবিগুলো।
১৮৯১ সালের মাঝামাঝি কোনও একটা সময়। তৎকালীন বিশ্বের শিল্পকলার রাজধানী, সভ্যতার পীঠস্থান প্যারিসের জীবনযাত্রার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে, সাজানো-বানানো তথাকথিত আধুনিক সভ্যতার প্রতি বিরক্ত হয়ে ফরাসি শিল্পী পল গগ্যাঁ পাড়ি দিলেন প্রশান্ত মাহাসগরের বুকে অবস্থিত ছোট একটি দ্বীপ তাহিতির উদ্দেশে। তেষট্টি দিনের দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা শেষ করে তিনি গিয়ে পৌঁছলেন সেই দ্বীপে, যেখানে তখনও অরণ্যচারী প্রাচীন আদিবাসী জীবনযাত্রার অস্তিত্ব রয়ে গেছে। প্যারিসের সাজানো মেকি সভ্যতার প্রতি বীতশ্রদ্ধ গগ্যাঁ চেয়েছিলেন নিজেকে, নিজের শিল্পের আত্মাকে এই আদিমতার মধ্যে নতুন করে আবিষ্কার করতে।
‘প্রিমিটিভিজম’ শব্দটা তখনও শিল্পকলার তাত্ত্বিকদের কাছে সেভাবে পরিচিত নয়। গগ্যাঁর পূর্বসূরি ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীরা ইউরোপীয় রেনেসাঁসের ৫০০ বছরের ট্র্যাডিশনকে ভেঙেছিলেন বটে; কিন্তু একেবারে অস্বীকার করেননি কেউই। আফ্রিকা বা পলিনেশিয়ার আদিম অধিবাসীদের নির্মিত বাহ্যিক চাকচিক্যহীন, ফর্ম এবং ধারণা নির্ভর প্রাচীন শিল্পকলার ধারাকে ইউরোপীয় শিল্পের মধ্যে টেনে নিয়ে আসার কথা তখনও ইউরোপের মূল স্রোতের শিল্পীদের ভাবনায় ছিল না। যদিও জাপানি রঙিন কাঠখোদাই ছবি ‘উকিও-ই প্রিন্ট’ ইতিমধ্যেই আলোড়ন ফেলে দিয়েছে ইউরোপের শিল্পীমহলে। ‘জাপোনিজম’ তখন ইউরোপের উচ্চবিত্ত সমাজের অন্যতম ‘ট্রেন্ড’। গগ্যাঁর সমসাময়িক এবং বন্ধু তুল্যুজ লোত্রেক রঙিন লিথোগ্রাফি করছেন জাপানি শিল্পী হকুসাই, হিরোশিগে বা সারাকুর ছবি থেকে প্রভাবিত হয়ে। আর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ তো রীতিমতো তেলরঙে সরাসরি কপি করছেন পিয়ের ট্যাঙ্গির দোকান থেকে কিনে আনা হিরোশিগের কাঠখোদাই ছবি। গগ্যাঁ নিজেও একটা সময়ে এই জাপানি চিত্রকলার মতোই উজ্জ্বল সমতল রং এবং জোরালো স্পষ্ট রেখার প্রয়োগে বিম্ব নির্মাণ করতেন। তারপর একদিন একলা পথিক হয়ে সব ছেড়ে আদিম জীবন ও শিল্পের খোঁজে রওনা দিলেন তাহিতির উদ্দেশে। এর পরের দু’টি বছর তিনি কাটিয়ে দেবেন ওই দ্বীপেই আর ছবি আঁকার পাশাপাশি লিখে ফেলবেন ‘নোয়া নোয়া’, তাঁর প্রথম তাহিতি-বাসের অভিজ্ঞতার উপাখ্যান।
‘শীতের বৈকাল। বিস্তীর্ণ প্রান্তরে ঘন ছায়া নামিয়াছে। দূরে বনশ্রেণীর মাথায় মাথায় অল্প অল্প কুয়াশা জমিয়াছে। রেল-লাইনের দু-ধারে মটর ক্ষেত, শীতল সান্ধ্য বাতাসে তাজা মটরশাকের স্নিগ্ধ সুগন্ধে কেমন মনে হইল যে-জীবন আরম্ভ করিতে যাইতেছি তাহা বড় নির্জন হইবে, এই শীতল সন্ধ্যা যেমন নির্জন, যেমন নির্জন এই উদার প্রান্তর আর ওই দূরের নীলবর্ণ বনশ্রেণী, তেমনি।’ ‘আরণ্যক’ উপন্যাসের নায়ক এবং কথক সত্যচরণ প্রথম যেদিন জঙ্গলমহলে এসে পৌঁছলেন সেইদিনের বর্ণনা এটি। ছবি এঁকে মানুষ এবং প্রকৃতির সৌন্দর্যকে ধরে রাখা যায়। শব্দের পরে শব্দ সাজিয়ে হয়তো বলা যায় হৃদয়ের গভীরতম অনুভূতির কথা। কিন্তু গন্ধকে ধরে রাখার মতো কোনও মাধ্যম আছে কি? জানি না। অথচ আদিম অরণ্যভূমির বর্ণনাই হোক বা সেখানকার মানুষের কথা– রূপ, রস, বর্ণের সঙ্গে গন্ধেরও যে একটা বিরাট ভূমিকা আছে এইকথা জানতেন সত্যচরণ ওরফে বিভূতিভূষণ। যেমন জানতেন পল গগ্যাঁও। তাই চিত্রকর হয়েও, যা আঁকায় বা লেখায় ধরে রাখা যায় না, সেই অনুভূতির কথাই তিনি বলেন তাঁর তাহিতির জার্নালের শিরোনামে। ‘নোয়া নোয়া’। প্রাচীন তাহিতিয় ভাষায় যার অর্থ সুগন্ধ।
যদিও গগ্যাঁ তাহিতি দ্বীপে গিয়েছিলেন আধুনিক সভ্যতার সংস্রব ত্যাগ করে আদিম জনগোষ্ঠীর জীবনের সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদের সংস্কৃতিকে জানতে; এবং নিজের কাজের মধ্যে তার প্রয়োগ ঘটাতে। কিন্তু আদতে এই দ্বীপ তখন ছিল ফরাসি উপনিবেশ। ফলে জাহাজ থেকে নামতেই এই সাদা চামড়ার ফরাসি শিল্পীকে ‘প্রভু’ বলে সেলাম ঠোকে সেখানকার কৃষ্ণাঙ্গ গভর্নর লাকাসকাদে। আসলে গগ্যাঁর এই তাহিতি যাত্রাকে তৎকালীন ফরাসি সরকার দেখিয়েছিল এক ধরনের ‘কালচারাল এক্সচেঞ্জ’ হিসেবে। সেই অর্থে গগ্যাঁ ছিলেন একজন সরকার-প্রেরিত কালচারাল অ্যাম্বাসাডর। অতএব এই সৌজন্য প্রদর্শন, যা দেখে গগ্যাঁ প্রথমেই প্রমাদ গোনেন; এবং বুঝতে পারেন ফরাসি প্রভু বলে ধরে নিলে এরা আর কখনওই তাঁকে এদের একজন বলে গ্রহণ করবে না।
কলকাতা শহরের পথে পথে ঘুরে বেড়ানো কর্মহীন যুবক সত্যচরণ যেদিন ময়মনসিংহের জমিদারের প্রতিনিধি হয়ে লবটুলিয়ার জঙ্গলমহলের কাছারিতে পা রেখেছিলেন, সেদিনও ‘প্রভু’ বলে বলে তাকে সেলাম ঠুকেছিল সিপাহী মুনেশ্বর সিং। সত্যচরণ অবিশ্যি স্বেচ্ছায় জঙ্গলমহলে যাননি, গিয়েছিলেন পেটের দায়ে। কিন্তু অচিরেই প্রকৃতি-প্রেম এবং আদিবাসী মানুষের জীবনযাত্রার প্রতি ভালোবাসা তাঁকে এই জীবনের সঙ্গে একাত্ম করে তোলে। কিন্তু এই ‘প্রভু’ পরিচয় যে প্রান্তিক, অন্ত্যজ মানুষের সঙ্গে তাঁর একটা সম্ভ্রম মিশ্রিত দূরত্ব কায়েম করেই রেখেছিল– এই কথা বারেবারেই প্রতিফলিত হয়েছে ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে।
ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিল গগ্যাঁর ক্ষেত্রে। এই যে ‘অপর’ বা ‘Other’-এর ধারণা– শিল্প বা সাহিত্য দিয়ে কি সত্যিই তাকে মুছে ফেলা সম্ভব? ‘নোয়া নোয়া’ বা বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’ পড়লে কিন্তু মনে হয় আপ্রাণ চেষ্টা করেও সত্যচরণ বা গগ্যাঁ কখনওই ‘ওদের’ একজন হয়ে উঠতে পারেননি। তাই বিভূতিভূষণের লেখা ‘আরণ্যক’ রাজকন্যা ভানুমতি, মঞ্চি অথবা ধাতুরিয়া কোনওদিন পড়বে না; যেমন গগ্যাঁর তাহিতিয় স্ত্রী তেহুরা কোনওদিন নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টে বা ইউরোপের কোন আর্ট গ্যালারিতে দেখতে আসেননি তাঁকে মডেল করে আঁকা যুগান্তকারী ছবিগুলো। বরং আশ্চর্যের বিষয় এই যে গগ্যাঁর তাহিতির ছবিগুলোকে ‘মাস্টারপিস’ আখ্যা দিয়ে কোটি কোটি টাকা খরচ করে মিউজিয়ামে সাজিয়ে রেখেছে যারা– সেই সভ্য, চাকচিক্যময় জগতকেই বহু দূরে ঘৃণা ভরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন শিল্পী নিজে। সভ্যতার সবথেকে বড় স্ববিরোধিতা বোধহয় এইখানেই।
তাহিতি দ্বীপে পৌঁছেই গগ্যাঁ জানতে পারেন সেখানকার প্রাচীন আদিবাসী রাজা পোমারি তখন মৃত্যুশয্যায়। সেদেশের প্রাচীন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ রাজার স্বাস্থ্য সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তিত এবং বিষাদগ্রস্থ। বিষাদগ্রস্থতার কারণ এই প্রাচীন আদিবাসী রাজাই মাওরি সভ্যতার শেষ অভিভাবক। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তাহিতি চলে যাবে সম্পূর্ণরূপে ফরাসিদের দখলে। এই বর্ণনা পড়তে পড়তে অবধারিতভাবে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ান আর এক রাজা দোবরুপান্না বীরবর্দি, যাঁর মৃত্যুর সঙ্গেই শেষ হয়ে যায় ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে অরণ্যের মূলনিবাসী ভূমিপুত্রদের গৌরবময় লড়াইয়ের ইতিহাস। রাজা দোবরুপান্নাকে দেখে যেমন সত্যচরণের প্রথমে মনে হয়েছিল এক সাঁওতাল বৃদ্ধ, তাহিতির রানিকে দেখেও গগ্যাঁ সুঠাম চেহারার এক আদিবাসী মহিলা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেননি। ‘অপর’ বলে ভাবার কারণেই যে এমনটা মনে হওয়া, পরে তা স্বীকার করেছিলেন সত্যচরণ। আর গগ্যাঁ সরাসরি বলেছেন তিনি ছিলেন অন্ধ। যে আদিম আভিজাত্য রানির চেহারা জুড়ে বিদ্যমান ছিল, তাকে তিনি বুঝেই উঠতে পারেননি প্রথম দর্শনে। এর কিছুকাল পরে গগ্যাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন রাজকন্যা ভাইতুয়া। গগ্যাঁ বলেছেন, ‘প্রথম দর্শনে আমার ওর নরমাংসভোজী চোয়ালটাই শুধু নজরে এসেছিল, আর ধূর্ত ও নিষ্ঠুর পশুর লোলুপ দৃষ্টি ছিল ওর চোখে। এবং অপূর্ব সুন্দর ও চওড়া কপাল থাকা সত্ত্বেও ওকে আমার মোটের ওপর বেশ কুশ্রী বলেই মনে হয়েছিল।’ এছাড়াও গগ্যাঁ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন ভাইতুয়ার সুগঠিত নিতম্বের কথা, যা নিঃসন্দেহে পুরুষ হিসবে তাকে উত্তেজিত করেছিল।
লক্ষণীয় যে গগ্যাঁ তাঁর বর্ণনায় ‘ক্যানিবল’ ‘ক্রুয়েল’ এবং ‘কানিং অ্যানিমাল’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করছেন একজন আদিম জনগোষ্ঠীর প্রতিভূ রাজকুমারীর সম্পর্কে। হয়ত একদা বহুযুগ আগে সত্যিই তার কোনও পলিনেশিয় পূর্বপুরুষ ছিল নরখাদক। কিন্তু আধুনিক সভ্যতাকে অস্বীকার করে আদিম জনগোষ্ঠীকে আপন করে নেওয়ার বাসনায় তাহিতিতে আসা ফরাসি শিল্পী গগ্যাঁর মনেও অরণ্যবাসী আদিম সভ্যতার উত্তরসূরিদের সম্পর্কে সেই তথাকথিত সভ্য জগতের বপন করে দেওয়া ধারণাই রয়ে গেছে তখনও। আমরা দেখছি বারবার সেই সভ্যতার ধারণার সঙ্গে সংঘাত হচ্ছে গগ্যাঁর নিজেরই। এই মাওরি মেয়েরাই এর পরে হয়ে উঠবে তাঁর ছবির অন্যতম বিষয়, যা শেষপর্যন্ত সভ্য জগতে শিল্পী হিসেবে গগ্যাঁকে অমরত্ব দেবে। ‘ভানুমতী নিটোল স্বাস্থ্যবতী সুঠাম মেয়ে। লাবণ্যমাখা মুখশ্রী– তবে পরনের কাপড় সভ্য সমাজের শোভনতা রক্ষা করিবার উপযুক্ত প্রমাণ মাপের নয়। মাথার চুল রুক্ষ, গলায় কড়ি ও পুঁতির দানা।’ রাজকুমারী ভানুমতী সম্পর্কে সভ্য জগতের প্রতিনিধি যুবক সত্যচরণের এই ছিল প্রথম বর্ণনা। পরে সত্যচরণ নিজেকে সংশোধন করে বলছেন ‘সভ্যতার গর্বে উন্নতনাসিক আর্যকান্তির গর্বে আমি প্রাচীন অভিজাত-বংশীয় দোবরুপান্নাকে বৃদ্ধ সাঁওতাল ভাবিতেছি, রাজকন্যা ভানুমতীকে মুন্ডা কুলী রমণী ভাবিতেছি…।’
‘আরণ্যক’ উপন্যাসের শেষের দিকে সত্যচরণ বলেছেন– ‘এখানেই যদি থাকিতে পারিতাম। ভানুমতীকে বিবাহ করিতাম। এই মাটির ঘরের জ্যোৎস্না ওঠা দাওয়ায় সরলা বনবালা রাঁধিতে রাঁধিতে এমনি করিয়া ছেলেমানুষী গল্প করিত– আমি বসিয়া বসিয়া শুনিতাম।’ বাঙালী যুবক সত্যচরণ ওই ‘যদি’-তে আটকে গেলেও ফরাসি শিল্পী গগ্যাঁ কিন্তু থামেননি। তাঁরও অভ্যাস ছিল সত্যচরণের মতোই পাহাড়, জঙ্গল প্রকৃতিকে এক্সপ্লোর করে বেড়ানোর। চিত্রকর হিসেবে তা ছিল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। পুনারু উপত্যকা, অরোফেনা এবং আরোরাই পর্বতের বর্ণনা পড়তে পড়তে মহালিখারূপের সৌন্দর্যের বর্ণনা মনে পড়ে যাওয়া অসম্ভব নয়।
এমনই এক যাত্রায় ৪৩ বছর বয়স্ক গগ্যাঁ বিয়ে করেন মাত্র ১৩-১৪ বছরের তোঙ্গা উপজাতির কন্যা কিশোরী তেহুরাকে। গগ্যাঁ নিজেই বলেছেন যে তাঁর মতো প্রায়-বুড়ো একজন মানুষের সঙ্গে এই কিশোরী মেয়ের বিয়ে কতটা সঙ্গত এ নিয়ে তিনি নিজেও সংশয়ে ছিলেন। কিন্তু ‘বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা’ হলে যেমনটি ঘটে তাইই ঘটেছিল গগ্যাঁর সঙ্গে। যথারীতি এই আদিম অরণ্যময় দ্বীপমালার দেশেও উদয় হতেন এক ইহুদি ব্যবসায়ী। আদিবাসীদের ঠকিয়ে অনেক বেশি টাকায় অতি সাধারণ জিনিসপত্র বিক্রি করাই ছিল তাঁর ব্যবসা। সেই ইহুদি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অতি সাধারণ একজোড়া তামার তৈরি কানের দুল কুড়ি ফ্রাঁ খরচ করে কেনার আবদার করে তেহুরা। গগ্যাঁ যখন বোঝাবার চেষ্টা করেন যে ওই বস্তুটির যা মূল্য তার থেকে অনেক বেশি নিয়ে ঠকাচ্ছে ওই ব্যবসায়ী– তেহুরা তখন ছোট শিশুদের মতো কান্না জুড়ে দেয় এবং শেষপর্যন্ত গগ্যাঁকে তার আবদার মেটাতে বাধ্য হতে হয়। আমরা যারা তরুণী মঞ্চী আর তার বৃদ্ধ স্বামী নকছেদিকে চিনি, তারা গগ্যাঁর অবস্থাটা বিলক্ষণ বুঝতে পারি। বহু পরিশ্রমে রোজগার করা ফসলের একটা বড় অংশ এইভাবেই মঞ্চীর কাছ থেকে ঠকিয়ে নিয়েছিল এদেশেরই কোনও ধূর্ত ব্যবসায়ী, একছড়া নীল ও সাদা হিংলাজের মালার বিনিময়ে। লবটুলিয়ার মঞ্চী, তাহিতির তেহুরা, নকছেদি আর পল গগ্যাঁ সবাই যেন এখানে একাকার হয়ে যায়।
প্রিয় পাঠক এতক্ষণে নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন মহৎ ‘পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট’ শিল্পী পল গগ্যাঁর শিল্প বিচার এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। সে প্রয়োজনও নেই, কারণ পৃথিবীর শিল্পকলার ইতিহাসে গগ্যাঁর অবদান আজ সর্বজনস্বীকৃত। তাহিতির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে নিজের ছবিতে যে ‘প্রিমিটিভিজম’ তিনি নিয়ে এসেছিলেন, পরবর্তীকালে ইউরোপীয় শিল্পের মূল ধারাকে ‘মডার্ন আর্টের’ পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তার বিরাট অবদান রয়েছে। আগামী প্রজন্মের দুই মহাশিল্পী পিকাসো এবং মাতিসের কাজের ওপরে গগ্যাঁর আদিম শিল্পের উপাদানের ব্যবহার এবং বর্ণপ্রয়োগ সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে। গগ্যাঁ তাহিতিতে না গেলে হয়তো পিকাসো ‘দেমোয়াজেল দ্য আভিনিঁও’ আঁকতে পারতেন না, মাতিস তাঁর ‘ডান্স’ ছবিতে নৃত্যরত মেয়েগুলির শরীরে লাগিয়ে দিতে পারতেন না সমতল লাল রং। শিল্পের আধুনিকতার এই ইতিহাস সকলেরই জানা। যেমন বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি অনুসন্ধিৎসু পাঠক জানেন আরণ্যকের সত্যচরণকে। এই লেখা, বলা যেতে পারে এক বাঙালি পাঠকের সমান্তরাল পাঠ প্রক্রিয়ার ফসল, যেখানে গগ্যাঁর দেওয়া তাহিতির বর্ণনায় অবধারিতভাবেই বারবার ফিরে ফিরে আসেন বিভূতিভূষণ। আদিম জীবনের এত কাছাকাছি এসে, প্রকৃতি ও মানুষের সঙ্গে গভীরভাবে একাত্ম হয়েও শেষপর্যন্ত ওই সভ্য জগতের একজন হয়েই তাঁদের থেকে যেতে হয়। গগ্যাঁ তাঁর আঁকা ছবি নিয়ে ফিরে আসেন প্যারিসে, কিন্তু চিরকালের মতো ছেড়ে যান তেহুরাকে। দ্বিতীয়বার তাহিতিতে ফিরেও আর খোঁজ রাখেননি তার। বিভূতিভূষণ ‘আরণ্যক’ শেষ করেন ‘কতকাল তাহাদের আর খবর রাখি না’ এই কথা বলে। তেহুরা, মঞ্চী, ভাইতুয়া, ভানুমতী অথবা দুলির সঙ্গে গগ্যাঁ, সত্যচরণ, অসীম, হরিদের মধ্যিখানের ওরা-আমরার দূরত্বটা শেষপর্যন্ত স্থায়ী হয়ে রয়েই যায়, অদৃশ্য দেওয়ালের মতো।