এ ছবি শুধুমাত্র গতি আর ধীরতার দ্বন্দ্ব নয়। বরং, এ ছবি শেষমেশ প্রেমেরই, মানবতারই। প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক প্রেমের একবগ্গা দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি এর আগেও প্রশ্ন রেখেছেন পরিচালক প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য। তাঁর টেলিফিল্ম ‘পিঙ্কি আই লাভ ইউ’ থেকে ওয়েবসিরিজ ‘বিরহী’ পর্যন্ত চলতে থাকা প্রেমের ঘূর্ণন ‘নধরের ভেলা’-য় পৌঁছে ধরা দেয় আরেক লাট্টুপাকে। নেহাতই যৌন-আমোদ করে যে বাচাল যুবতী — সে-ই যখন শোনে অসহায় বালকের গলায় অস্ফুট ‘মা’– দিশাহারা হয়ে যায় নারীর হৃদয়। ভিজে গামছা দিয়ে পরম মমতায় মুছিয়ে দেয় নধরের ক্ষত। খিদে পায় নধরের, প্রেমও পায়।
মল্লিকপুর স্টেশন থেকে নামার ঢলানে, জড়ভরত একটা মেয়ে বসে থাকে রোজ, বিকেলে; এনজিও-র দেওয়া হুইল চেয়ারে। কোনও অভিব্যক্তি নেই; কোনও যাচনা নেই; কোনও স্বর নেই। কোলে একটা বাটি। লোকজন পয়সা ছুড়ে দেয়। পেশাদার ভিখারিদের মতো ফিরতি আশীর্বাদও করতে পারে না সে।
মেয়েটার শিশুকাল থেকে দেখছি। বাড়ির লোক বসিয়ে দিয়ে যায়। এখন খানিক বড় হয়ে গিয়েছে, গতরেই শুধু। ঘাড় বেঁকে মাথা পুঁতে গেছে বুকে। দেখে, ‘গঙ্গা-যমুনা’ মনে পড়ে আমার। অনেক অনেক বছর আগে কোচবিহারের কোনও মেলায় দেখেছিলাম। ঊর্ধ্বাঙ্গে পৃথক দুই নারী, অথচ শ্রোণীর সারণি থেকে শরীর একটাই। ওদের বাবা-মা মেলায় মেলায় তাঁবু বেঁধে, টিকিট বেচে মেয়ে দেখাত। প্রজননসূত্রেও উপার্জন খুঁজে নেওয়া যায়– তা একমাত্র মানুষই ভেবেছে।
তেমনটি ভেবেছে নধরের মা-ও। সাংঘাতিক ধীরগতির ছেলেকে বানিয়ে তুলেছে ঈশ্বরের অবতার। গ্রামের লোকজন এসে নমো করে তাকে; প্রণামী হিসেবে কেউ কেউ আলু, পটল, কয়েক মুঠো চাল দিয়ে যায়। যদিও, ঈশ্বরও জানে, ওটুকুতে আজকাল চলে না সংসার। মাকে তাই তরকারি কুটতে হয় বড়লোকের বাড়ি; বাসন মাজতে হয় সস্তা হোটেলে। পয়সা কতটুকু পায়, জানতে পারি না। তবে, এটুকু দেখতে পাই, মালিকের গালমন্দ জুটে যায় দেদার।
চাইলেও, নিজের গতি বাড়াতে পারে না নধর। চেষ্টা করে; বোঝা যায়, চেষ্টা করে সে। নিজের ব্যর্থতায়, নিষ্ফল আক্রোশে তার চোখ-মুখ আরও শক্ত হয়ে যায়। গুমরে বেরয় মায়ের হতাশা, এ ছেলে না জন্মালেই ভালো হত। রাগ হয় নধরের; জন্মের দায় তার নয়, সে দায় তার বাবা-মায়ের। রাগের বহিঃপ্রকাশে, খিদের প্রচণ্ড তাড়নায় কিছুই কি করতে পারে না সে? হ্যাঁ, পারে। ছরছর মুতে দেয় নিজেরই ধূলিমলিন ধুতির ভেতর। পেচ্ছাপ মাখামাখি পোশাকে সে যখন পা ঘষে হাঁটে উঠোনে, থলথলে শামুকের মতো– মনে হয়, এই প্রকাণ্ড সভ্যতার উল্লসিত মুখে লেপে চলেছে শ্লেষ ও বিদ্রুপের বর্জ্যসমূহ।
শ্লেষ এই ছবির পরতে পরতে। নধরের বাবার একমাত্র উপস্থিতি ছিটেবেড়ার দেওয়ালে ঝোলানো হলদেটে ফটোতে। পাড়া-পড়শিদের সঙ্গে নধরের মায়ের কথাবার্তা থেকে জানা যায়, মারা গিয়েছে বাবা, ট্রাপিজের খেলা দেখাতে গিয়ে। তখনই, মুখের ওপর, মসৃণ মতামত জানায় একজন, লোকটা মুসলমান ছিল বলেই ওই পরিণতি তার। আর, নধরের জীবন এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যায় যে দুর্ঘটনায়, আততায়ী সে গাড়ির পিছনে লেখা: ‘আওয়াজ করো’। দুর্ঘটনার সরাসরি কোনও দৃশ্য বা শব্দ না থাকলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না, উন্নয়নের মাটি-বোঝাই গাড়ি ঢুকেছে যে রাস্তায়, তন্বী সেই গ্রাম্য রাস্তা প্রস্তুত নয় ওই গাড়িকে বুক পেতে নিতে। এবং, টাল সামলাতে না পারা ড্রাইভার, যথারীতি, বেমালুম ধাঁ।
এলাকায় নতুন যে সার্কাস আসে, নাম তার ‘দ্যি গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস’। হ্যাঁ, বানানটা এমনই। কী কী খেলা আছে সেই সার্কাসে? জীব-জন্তু নিষিদ্ধ, তাই একজন মানুষই সেজে আসে জন্তুর মতো। শিশুমন ভোলাতে হরবোলা মানুষ নিজেই ডেকে যায় হাতি-ঘোড়ার ডাক, ফরমাশ মাফিক। সাইকেলের পিঠে উঠে আরেকজন পাখি হয়ে যায়, শরীরে গলিয়ে নেয় আগুনের বলয়। কারও খেলায় থাকে বালখিল্য ম্যাজিক। কারও খেলায় একটু-আধটু জিমন্যাস্টিক, অল্প-বিস্তর অ্যাক্রোব্যাট।
সঙ্গে আছে অভিনয়ে মন-প্রাণ উজাড় করে দিতে চাওয়া শ্যামার ‘মনসা পালা’। কিন্তু, এই কুঁচকি-কাতর ইন্টারনেটের যুগে, মোবাইলে মোবাইলে পর্ন দেখার জমানায়, কে ছাই দেখবে ওই ঘ্যানঘ্যান কাঁদুনি? বাংলার সেই নিজস্ব প্রাচীন শিল্পকলা থেকে কিছুটা দূরে, তাই, শুয়ে থাকে গ্রামীণ শ্মশান।
শ্যামার পারফর্ম্যান্স অর্ধেকে থামিয়ে ঢুকে পড়ে রূপা ও রহমান। দিগ্বিদিক কাঁপানো যৌন-গন্ধী গানে, যৌথ নিতম্ব-দোলায় উথলে পড়ে দর্শকের উদ্দাম লালা। রাত আরেকটু বাড়লে, এলাকার পয়সা-প্লাস-ক্ষমতাওয়ালা লোকজন দরদাম করে রূপা ও শ্যামার। ঢলঢলে তাঁবুতে জমে ওঠে লেনদেন, দেহের। অন্ধকার আকাশের নিচে, শীৎকার ও শ্মশানের মাঝামাঝি, স্থবির নধর বুঝতে চায় সুস্থতার জঙ্গম গণিত। দেখতে দেখতে, চকিতে মনে হয় ‘দ্যি গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস’ নামটা কি আদতে বিদ্রুপ নয়? ভাঙাচোরা এই বাংলায় যেসব সার্কাস হয়ে চলেছে নিয়ত, তারই অবয়ব কি দেখছি না পর্দায়? একটু অন্যভাবে?
গল্পের প্রতিটি চরিত্র ঘুরছে যে যার ধান্দায়। যাকে বেশ উপকারী পড়শি ভেবেছি, দেখি, সে-ও আসলে হিসাব মেলায় ব্যক্তিগত লাভের। তুলনামূলকভাবে দুর্বল পুরুষ ভালুকে নিয়ে আদিম আহ্লাদে মেতে ওঠে দু’জন যুবতী। সার্কাসের মালিক, চূড়ান্ত স্বার্থপর ও তিরিক্ষে মেজাজের হারাধন। সকলেই তাকে অপছন্দ করে। অপছন্দের আলোচনায় শ্যামা ও রূপার সখীপনা আর খিখিপনা থাকলেও, আসলে দু’জন দু’জনের প্রতিদ্বন্দ্বী। প্রতিদ্বন্দ্বের মুনাফা তোলে রহমান। সে চায় দু’জনকেই হাতে রেখে নিজের আলাদা দল খুলতে। তাদের শরীর-বেচা টাকার বখরা নেয় সে, ভবিষ্যৎ ‘চম্পা ড্যান্সের’ মূলধন সেটা।
এ ছবি শুধুমাত্র গতি আর ধীরতার দ্বন্দ্ব নয়। বরং, এ ছবি শেষমেশ প্রেমেরই, মানবতারই। প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক প্রেমের একবগ্গা দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি এর আগেও প্রশ্ন রেখেছেন পরিচালক প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য। তাঁর টেলিফিল্ম ‘পিঙ্কি আই লাভ ইউ’ থেকে ওয়েবসিরিজ ‘বিরহী’ পর্যন্ত চলতে থাকা প্রেমের ঘূর্ণন ‘নধরের ভেলা’-য় পৌঁছে ধরা দেয় আরেক লাট্টুপাকে। নেহাতই যৌন-আমোদ করে যে বাচাল যুবতী– সে-ই যখন শোনে অসহায় বালকের গলায় অস্ফুট ‘মা’– দিশাহারা হয়ে যায় নারীর হৃদয়। ভিজে গামছা দিয়ে পরম মমতায় মুছিয়ে দেয় নধরের ক্ষত। খিদে পায় নধরের, প্রেমও পায়। নারীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার একমাত্র আর্তি: বেহুলার ভেলায় করে ভাসিয়ে দাও আমায়। পুরুষ কি তাহলে খোঁজে একই অঙ্গে মা ও প্রেয়সী? নারী কি তাহলে চায় শুশ্রূষা বিলোতে?
প্রদীপ্তর এই ছবিতে লুকিয়ে আছে অনেক আঙ্গিক। দর্শক খুঁজে নিতে পারে, বুঝে নিতে পারে, যে যার অভিজ্ঞতা ও বোধ-বুদ্ধি মতো। পরিচালকের গল্প বলার নিজস্ব ছাপ আর ধরন এখানে থাকলেও, আসলে এ ছবি গোটা টিমের। নইলে, মাত্র ১৩ দিনে ৩ ঘণ্টার একটা সিনেমা এত চমৎকার শুট করা যায় না। ওই কাল্পনিক সার্কাসে যেমন একই মানুষ ঢুকে পড়ে নানা ভূমিকায়– কখনও যে পালাগান করে, সে-ই দাঁড়ায় টিকিট কাউন্টারে, সে-ই কখনও ভিড় সামলায়– তেমনই এই ছবির নেপথ্য টিম ও গ্রামবাসীরা নানা ভূমিকা পালন করেছে মেকিংয়ে। যেমন, শ্যামা, রূপা ও রহমানের কোরিওগ্রাফি নিজেদেরই করা– যথাক্রমে প্রিয়াঙ্কা সরকার, শতাক্ষী নন্দী ও সায়ন ঘোষের।
যোগ্য সঙ্গত দিয়েছে ছবির সিনেমাটোগ্রাফি। প্রদীপ্ত যেন নদীতীরে বিস্তীর্ণ প্রান্তরে ছেড়ে দিয়েছেন শিল্পী ও কলাকুশলীদের। তারা চলছে, ফিরছে, কথা বলছে। নেশা করছে, ঝগড়া করছে, ঠাট্টা করছে নিজেদের মতো। সূর্য উঠছে, সূর্য ডুবছে। সামনেই চরছে একপাল গরু। রাস্তায় হেলেদুলে চলেছে ছাগল। দূরের গাছ-সীমানায় হেঁটে যাচ্ছে গ্রামবাসী কেউ, আপনমনে। আর, অলক্ষ্যে ক্যামেরা পেতে এসব বেঁধে ফেলছেন জয়দীপ দে। সেনজিত হালদারের শিল্প নির্দেশনায়, নিলয় সমীরণ নন্দী ও পুনম সাহার পোশাক পরিকল্পনায়, সুরজিত পালের রূপসজ্জায়, সাত্যকি ব্যানার্জির সুরে আর সৌরভ গুপ্ত ও অনিন্দিত রায়ের শব্দায়োজনে সে ছবি আমাদের সামনে সেই জ্যান্ত গ্রামবাংলা হয়ে উঠে দাঁড়ায়– যে গ্রামকে, যে বাংলাকে শিরায় শিরায় রন্ধ্রে রন্ধ্রে না চিনলে, না বুঝলে, শুধুমাত্র শহুরে প্রযুক্তি দিয়ে ধরা সম্ভব নয়।
বিনোদনের নিরিখে এ ছবিতে সব মশলাই আছে– লাচাগানা, রোমান্স, ঝাড়পিট– বেশ রগরগে রঙিন হয়েই আছে। দুয়েকটা আপাতখুঁত নজরে পড়লেও, সেদিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না। বরং, খুব ইচ্ছে করে, হৃৎযন্ত্রের ছড়ে যে টুং বেজে ওঠে, সেখানেই আলতো হাত বোলাই খানিক। বললে অত্যুক্তি হবে না, নধরের চরিত্রে না-অভিনয়ের পাঠশিক্ষা দিয়েছেন অমিত সাহা। গ্ল্যামারের কৌটো সরিয়ে, শ্যামার চরিত্রে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন প্রিয়াঙ্কা সরকার। হারাধনের ভূমিকায় ঋত্বিক চক্রবর্তীকে দেখলে প্রত্যয় হতে বাধ্য, প্রদীপ্ত কেন পইপই বলেন, তিনি এই প্রজন্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা। তবে, সবকিছু ছাড়িয়ে নীরব নামহীন ভূমিকায় যিনি সূচ ফুটিয়ে দিয়েছেন– তিনি অপরাজিতা ঘোষ। সম্পূর্ণ সংলাপহীন, বস্তুত চলাফেরা-হীন একটা চরিত্রে তিনি শুধুমাত্র তাকিয়ে থেকেই আগাগোড়া যা করেছেন– তাঁকে একটা অবিমিশ্র প্রণাম।
সবশেষে, মার্জনামূলক দু’টি স্বীকারোক্তি: ১. ছবিটি যেহেতু এখনও সর্বসমক্ষে আসেনি, তাই মনে-মাথায় আরও কিছু থাকলেও, লিখতে হল হাত গুটিয়েই; আর, ২. এ-ছবি দেখামাত্র #MustWatch জাতীয় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেওয়া মূর্খতা; বরং, ধীর হয়ে, শান্ত হয়ে, একলাযাপন শ্রেয়।
………………………………………………………………….
লেখার সঙ্গে ব্যবহৃত প্রতিটি ছবিই লেখক মারফত প্রাপ্ত