Robbar

বাঙালি জিলিপির মতোই রসিক এবং প্যাঁচালো

Published by: Robbar Digital
  • Posted:June 26, 2025 5:45 pm
  • Updated:June 27, 2025 12:44 pm  
Jilipi: A popular sweet snack in the Indian subcontinent

জিলিপি দু’ প্রকার– কড়া এবং নরম। রসিকভেদে নানাজনের নানা পছন্দ। আমার যের’ম ব্যক্তিগত প্রেফারেন্স নরম, পুরো রিংটা কড়া খেতে খেতে… মাঝের জায়গাটা চর্বির বড়ার মতো একগ্রাসে। নরমগুলোর রং একটু আদুরে হলদেটে, কড়ারা কমলা পেরিয়ে ব্রাউন স্কিন। পানিফলের ঘন সবুজ জিলিপি খেয়েছিলাম কোনও এক জন্মে। কিন্তু মনে রাখতে হবে– শান্তিগোপাল কখনই সত্যি নেতাজি নন।

অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়

রোগাগলির জাতীয় খাদ্য জিলিপি। খালিপেটে একসের গরম জিলিপির পর একগ্লাস মাথাঠান্ডা জল খেলে সব যুদ্ধ থেমে যেতে বাধ্য! বড় বাহারি পাকমারা বস্তুটি যদি অমৃতি হয়, তবে জিলিপির ভালো নাম নির্ঘাত অমৃতলাল বসু। বাঙালির ভোর মোরগডাকে হয় না, জিলিপির পাকে হয়। ধোঁয়াওঠা চায়ের পাশে গরম রসের শালপাতা আমাদের প্রাতকালীন ব্যায়াম। একচুমুক ভাঁড়ের চা, পাশে ভাঁড়-নিয়ার কন্সট্যান্ট ভাঙা জিলিপির টুকরো– নরম রোদে কী অমলিন এক জীবন। ঘোর বর্ষায় কখনও ভেজে না জিলিপি। কারণ তিনখানি হস্ব-ই পুরো শব্দটার মাথায় ছাতা ধরে আছে। এমনিতে লোকে বলে, বাঙালি কাঁকড়ার জাত। লোকে বলে না বাঙালি বলে, কে জানে! বাঙালি যে ক্যাঁকড়াকাঁচড়া এটা ভাবার জন্যও তো বাঙালিকেই লাগবে! যাই হোক, মোদ্দা এফিডেভিট হচ্ছে আমরা ক্লাব বা ক্র্যাব– কিসসু নই। বাঙালি জিলিপির মতো। যে রসিক এবং প্যাঁচালো। কিছুটা পোয়েটিক বাকিটা পৈঁচিক। আমাদের দেখতে পুরো জিলিপির মতো… রসে ভরা বসুন্ধরা কিন্তু পেটে পেটে প্যাঁচ। কোলাপসিবল গেট খুললে যেমন ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ, বাঙালির মগজের লকগেট তুললে তেমন প্যাঁচ প্যাঁচ গন্ধ। সেই যে কবি লিখেছিলেন, ‘‘প্যাঁচ কিছু জানা আছে কুস্তির?/ ঝুলে কি থাকতে পারো সুস্থির?/ নইলে/ রইলে/ ট্রামে না-চ’ড়ে…/ ভ্যাবাচ্যাকা রাস্তায় পড়ে বেঘোরে’’– এ পঙক্তিই কাল হল শেষে, প্যাঁচ কষে দিন যায় কায়ক্লেশে।

ছবি: সুখময় সেন

রসে মন দি। জিলিপিতে ফিরি। গলিপথের ছোট ছোট ভিয়েন। ছাঁকা তেলে জিলিপি পড়ছে মহাশূন্য থেকে। হাঁ করে এ সুখদৃশ্য দেখছেন পুণ্যবান। এর পরেই রসলাগা ঠোঙায় সাধের অমৃত হস্তগত হবে ফি সকালের মতো। বাঙালিকে অম্বল দম্বল নিয়ে যতই মশকরা করা হোক, আমরা কিন্তু তা বলে রিট্রিট করিনি। বরং একবার ট্রিট দেওয়ার পর অন্যের ঠোঙা খাবলে নিজেকে আবার রিট্রিট দিয়েছি। চপ-কাটলেট-জিলিপি খাওয়ার সঙ্গে শরীর খারাপের কোনও সম্পর্ক নেই।

জিলিপি দু’ প্রকার– কড়া এবং নরম। রসিকভেদে নানাজনের নানা পছন্দ। আমার যেরম ব্যক্তিগত প্রেফারেন্স নরম, পুরো রিংটা কড়া খেতে খেতে… মাঝের জায়গাটা চর্বির বড়ার মতো একগ্রাসে। নরমগুলোর রং একটু আদুরে হলদেটে, কড়ারা কমলা পেরিয়ে ব্রাউন স্কিন। পানিফলের ঘন সবুজ জিলিপি খেয়েছিলাম কোনও এক জন্মে। কিন্তু মনে রাখতে হবে– শান্তিগোপাল কখনওই সত্যি নেতাজি নন।

Jalebi (locally known as Jilipi), Kolkata - TimesTravel
শুধু ভলেন্টিয়ার বা পিকনিকের প্যাকেট নয়, জিলিপি আমাদের সামাজিক কাজেও সর্বদা জাগ্রত। ‘আন্তঃজাতিক পারা কিরা পতিযোগিতায়’ জিলিপি রেস সর্বাপেক্ষা হিট একটি ইভেন্ট। প্রতিযোগীদের হাত পিছন থেকে বাঁধা। সেই করুণ অবস্থায় সুউচ্চে ঝোল্লায়মান জিলিপি ভক্ষণই এ রেসের মূল উত্তেজনা। প্রচণ্ড রেষারেষিতে সুতলি দড়ি সমেত জিলিপি খেয়ে ফেলত বিজয়ীরা। হেরোরা পিছিয়ে পড়লেও ট্র্যাক থেকে চলে যেত না, বরং পরাজিত জিলিপিদের জুত করে খেত। জেতা-হারার বাইরে পাড়া-বেপাড়া জুড়ে জিলিপিময় এক মিত্র সকাল জেগে উঠত সেদিন।

বম্বেতে যেমন বড়া পাও, কলকাতায় তেমন জিলিপি পাও। লোকাল বেকারির রুটির মধ্যে গরম জিলিপি মনখারাপের দাওয়াই। দুধে বা রাবড়িতে জিলিপিও অত্যন্ত মনোজ্ঞ এক এক্সপেরিমেন্ট। আমার অবিশ্যি গরম কচুরির সঙ্গেও ভালো চলে। বম্বেতে খুব চলে ফাঁফরা আর জিলিপি কম্বো। নিমকি পাশে পাশে খাও! কলকাতায় এখন অবাঙালি দোকানে এক্সএল সাইজের জিলিপি ভাজে, গরম দুধের সঙ্গে পরিবেশন করা হয়। দেশের বিখ্যাত আইসক্রিম কোম্পানি ‘ন্যাচারাল’ মাঝে ‘জালেবি’ বলে একটি ফ্লেভার আমদানি করেছিল। আইসক্রিমের ভেতর ঘুমন্ত জিলিপি খেতে যে কী ভালো লাগছিল। কীভাবে বানাল এমন জিনিস? জেনেই বা কী হবে শুনি? অমৃতের আবার রেসিপি!

Festive Special Jalebi Ice Cream | Creamy Delight with a Crunchy Twist | Naturals ice cream
জিলিপি আমার ছেলেবেলার প্রিয় এক শার্টের মতো, এখন আর গায়ে হয় না। বোতাম-টোতামও গিয়েছে ভেঙে। পেটের প্যাঁচ শানাতে গিয়ে বেচারা নিজেই পড়ে গিয়েছে শক্ত গিঁটে। জেনজি বার্গার খায়, জেনজিলিপি খায় না। আলফা হাকুশ তেতো কালো কফি খায়, আলফাল খায় না। বিটা জাঙ্ক খেতে পারে, কিন্তু জিলিপি না, সুইট টুথ নাই তাহার। মার্কেটিং একটা খাবারকে কোন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে– ম্যাগি তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। জিলিপির হয়ে ঢ্যাঁড়া পেটানোর কোনও লোক নেই। সে যের’ম রোগা, সেরম সাব-অল্টার্ন রয়ে গিয়েছে। ডোনাটের কাছে সে ছ’গোল খায়। উঁচু ক্লাসের অঙ্কের থিটার মতো তার অবাস্তব চেহারা– অঙ্কটাও বোঝে না, জিলিপিও না। বাড়ির সবচেয়ে প্রতিভাবান, জীবনে ব্যর্থ সিনিক রাজপুত্র।

রসালো হওয়ার পাশাপাশি কেন গো আরও একটু প্যাঁচালো হলে না ও আমার জিলিপিবালা ?