রাহুল জানে এইসব অপারেশনের মূলমন্ত্র সেই প্রথম অ্যাসাইনমেন্টের আগে শেখা গোড়ার কথা, ‘দিল নেহি দিমাক, আঁখ নেহি এহেশাস।’ আগেরবারের আফসোস প্রতিমুহূর্তে তাড়া করে বেড়ায় রাহুলকে। এখন এই নতুন দায়িত্ব যেন মনের জোর বাড়াচ্ছে। সুযোগ আবার যখন এসেছে, কাজে লাগাতেই হবে।
৮.
রাহুলের একটু অস্বস্তি লাগছিল।
ত্রিপাঠীসাহেব সেটা বুঝেছেন। বললেন, ‘ফিল ফ্রি। কাজের ক্ষেত্রে নানারকম হয়। আর তোমার যদি ইউটিলিটি না থাকবে, তাহলে তোমাকে ডিপার্টমেন্ট আবার ডাকবে কেন?’
এবার অবশ্য বৈঠকে রঞ্জন সেন, লিপিকা ধরও আছেন।
ত্রিপাঠি পরিষ্কার বলে দিলেন, ‘আমাদের টার্গেট কুসুমডিহা। ওখানে কিছু মাওবাদী মুভমেন্টের খবর আসছে। শুরুতেই থামাতে হবে। বাড়তে দেওয়া যাবে না। ওখানে সিভিল সোসাইটির কিছু লোকও সমস্যা করছে। সেই খবরও আসছে। তবে সেটা পুলিশ দেখবে। আমরা দেখব টেররিস্ট পার্টটা।’
একটু থেমে ত্রিপাঠী বললেন, ‘‘সোর্স বলছে কাঞ্চনা মানে সুনেত্রা আর বিষ্ণু কুসুমডিহার দিকে অপারেট করছে। খেতমজুর পরিবার, জঙ্গলের পাতাকুড়ানি পরিবারের কোনওটায় আত্মীয় সেজে ঢুকে আছে। রাহুল ওখানে ইউনিফর্মেই থাকবে। কারণ রাহুলের চেহারা লুকিয়ে কোনও লাভ নেই। কিন্তু রাহুল থাকার সুবিধে হবে যে বিষ্ণু সামনে এসে কোনও কাজ করতে পারবে না। রাহুল চিনে ফেলবে। সুনেত্রা আর আরও দু’-একজনকেও একটু চেপে খেলতে হবে। বেপরোয়া হতে পারবে না। সেই সময়টা রঞ্জন, লিপিকারা ব্যবহার করুক। ওরা অন্য পরিচয়ে এলাকায় যাক।’’
তিনজনকে তিনটে ফাইল ধরিয়ে দিয়ে ত্রিপাঠী বললেন, ‘বেসিক পয়েন্টস আর প্ল্যান অফ অ্যাকশন এতে আছে। বাকিটা তোমরা কথা বলে নাও। তবে এর বাইরেও একটা কথা বলি। ওড়িশা, অন্ধ্র, ঝাড়খণ্ড, তিন জায়গা থেকেই খবর আসছে ওই স্পটে ওদের আরেকজন কোনও নেতা অপারেট করছে। এর খুব একটা ডিটেল পাওয়া যায়নি। এদিকটাও সতর্ক থাকা দরকার। তোমরা একবার নিজেরা বসে নাও।’
পড়ুন পর্ব ৭: কুসুমডিহাতেই দেখিয়ে দেব আমরা মরে যাইনি
রাহুল জানে এইসব অপারেশনের মূলমন্ত্র সেই প্রথম অ্যাসাইনমেন্টের আগে শেখা গোড়ার কথা, ‘দিল নেহি দিমাক, আঁখ নেহি এহেশাস।’ আগেরবারের আফসোস প্রতি মুহূর্তে তাড়া করে বেড়ায় রাহুলকে। এখন এই নতুন দায়িত্ব যেন মনের জোর বাড়াচ্ছে। সুযোগ আবার যখন এসেছে, কাজে লাগাতেই হবে।
রঞ্জন বলল, ‘‘আপনার কৃষ্ণনগরের ঘটনাটা শুনেছিলাম। জোর বেঁচে গিয়েছিলেন। টার্গেটকে ধরেও ফেলেছিলেন প্রায়। ডিটেল হোমওয়ার্কের জন্য তা নিয়ে দু’চারটে প্রশ্ন আছে। একটু এক্সপেরিয়েন্সটা শেয়ার করবেন?’’
রাহুল বলল, ‘নিশ্চয়ই।’
বেশ কিছুক্ষণ কথার পর রাহুল বলল, ‘ওরা লোকাল সাপোর্ট পায়। এটা সবচেয়ে বড় কথা। জঙ্গলমহলের বাইরে, কৃষ্ণনগরের নিবারণ কুড়ি লেনেই যেভাবে শিকড় গেড়ে বসেছিল, এখন একেবারে ওদের ডেরা কুসুমডিহাতে যে আরও খানিকটা সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে, সেটা বলাই বাহুল্য। তোমরা তোমাদের মতো এলাকায় ঢুকে যাও। আমি তো এবার অফিশিয়াল ডিউটিতেই যাব। ত্রিপাঠী স্যরের নোটটা পড়ে দেখি, তোমাদের জন্য কী প্ল্যান আছে। সেইমতো ওখানে নতুন নামে নতুন করে আলাপ হবে।’
গোয়েন্দা-পুলিশের এই প্রস্তুতিপর্বের মধ্যেই পরপর চারটি ঘটনা ঘটে গেল কুসুমডিহাতে।
এক, জমি ছাড়তে নারাজ খেতমজুতদের সমাবেশ একটু গরম হয়ে যাওয়ায় লাঠি চালাল পুলিশ। বড়সড় গোলমালের খবর আর ছবি হল মিডিয়ায়।
দুই, মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করে দিলেন মানুষের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনও কৃষিজমি শিল্পের জন্য নেওয়া যাবে না। কুসুমডিহার ওই প্রকল্প নিয়ে বেসরকারি শিল্পগোষ্ঠী যেন না এগোয়।
তিন, জমি দখল আর শিল্পের নামে কোম্পানির কাছ থেকে টাকা খেয়ে ফুলে থাকা স্বার্থান্বেষী মহল ক্ষিপ্ত হয়ে গেল। বাঁশরিলাল, বিদ্যুৎ, পঞ্চায়েতবাবুদের গুন্ডাদের হাতে রাতে মার খেল মাধাই। খেতমজুরপল্লিতে হামলা হল। আগুন লাগল। একজনের মৃত্যু হল। কুসুমডিহাতে পুলিশ, প্রশাসন, মিডিয়ার যাতায়াত বাড়ল।
এবং চার, চাঞ্চল্যকর পোস্টার পড়ল, কাগজে লাল কালিতে হাতে লেখা পোস্টার, ‘সময় এসেছে, এবার জবাব দেবে কুসুমডিহা– কমরেড ব্রহ্মা।’
জঙ্গলমহলের এই তল্লাট থেকে উত্তাপ ছড়াল কলকাতার মিডিয়াগুলির স্টুডিওতেও। কে এই ব্রহ্মা?
কুসুমডিহা যাওয়ার পথে রাহুল মিত্র মাথা খেলাতে শুরু করল। কে ব্রহ্মা? সত্যিই কোনও নতুন মাওবাদী নেতা সামনে আসছে, নাকি কোনও মহল কায়দা করে নাম ভাসিয়ে দিচ্ছে? এলাকায় কড়া অভিযান করবে বলে রাষ্ট্রশক্তিও এইসব কাণ্ড করতে পারে। এই খেলায় সব হয়।
( চলবে)
স্কুল গড়ার কাজে উমাদির সঙ্গে নিরঞ্জনবাবু ছিলেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। স্কুল নিয়ে দু’জনের মধ্যে তর্ক-বিতর্কও হত খুব। যাঁরা দেখেছেন তাঁরা বুঝতেন স্কুল নিয়ে কতখানি প্যাশন ছিল দু’জনের মধ্যে সেসব তর্কে। স্কুলের কাজে চিনুদা প্রত্যক্ষভাবে জড়াননি, কিন্তু তাঁর পূর্ণ সমর্থন ছিল।