অ্যাংরি ইয়ংম্যান আসলে কী? অ্যাংরি ইয়ংম্যান সমাজের বিশ্বাসঘাতকতায় ক্ষুব্ধ। ‘দিওয়ার’-এ বিজয় দেখেছে তার বাবা সৎ মানুষ ছিল। কিন্তু যাদের জন্য তার বাবা লড়ছিল, তারাই তাকে ধরে হাতে ‘মেরা বাপ চোর হ্যায়’র ট্যাটু করে দিল। ‘আমার সঙ্গে সমাজ অন্যায় করেছে তাই আমি এই গোটা সিস্টেমটাকেই ওলটপালট করে দেব’, অ্যাংরি ইয়ংম্যান এই ‘এক্সিস্টেনশিয়াল অ্যাংস্ট’ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ‘এক্সিস্টেনশিয়াল’ কারণ তার বিশ্বাস সে তার বুদ্ধি, মনের জোর আর অবশ্যই হাতের জোর দিয়ে পৃথিবীটাকে ভেঙেচুরে নিজের মতো গড়ে নেবে।
রেগে আছি। রেগে থাকার কারণ কম নেই। কসবা ল’ কলেজ থেকে আর. জি. কর, এসএসসি স্ক্যাম থেকে টলিউডে ফেডারেশনের দাদাগিরি। কুম্ভে শয়ে শয়ে মৃত্যুর খবর পুরনো হতে না হতেই এয়ার ইন্ডিয়া বোয়িং ৭৮৭ দুর্ঘটনা। যেখানে সরকারি ইনভেস্টিগেশন অনুযায়ী, ২৬০ জনের মৃত্যুর কারণ পাইলট। ওই মডেলের যান্ত্রিক ত্রুটি নিয়ে বোয়িংয়ের কোয়ালিটি কন্ট্রোল অফিসার জন বার্নেট ২০১৯ সালে জনসমক্ষে প্রশ্ন তুলেছিলেন। বোয়িং তাঁকে মামলার ওপর মামলা দিয়ে চেপে দেয়। সেই চাপে জন সুইসাইড করেন গত বছর। বোয়িং এবং জেনারেল ইলেকট্রিক বলে যে কোম্পানি এই প্লেনের ইঞ্জিন সাপ্লাই করেছে– তাদের বিরুদ্ধে কোনও অ্যাকশন নেওয়ার প্রয়োজন নেই বলে লেখা রয়েছে ভারত সরকারের ইনভেস্টিগেশনে।
যদি কনজেকচারের কথা ছেড়ে পরিসংখ্যানের দিকে যাই… ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ভারত ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫১তম স্থানে। অর্থাৎ, যে খবরের কাগজ বা মিডিয়া চ্যানেল থেকে আপনারা ‘কসবা কাণ্ড’-এর লেটেস্ট আপডেট গিলছেন, ধরে নিন তারা কম্প্রোমাইস্ড। এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্সে ভারত ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৭৬-এ রয়েছে। গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে ১২৭টি দেশের মধ্যে ১০৫-এ রয়েছে ভারত। এবং যে দেশের সরকার সবচেয়ে বেশিবার ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেয়, সেটি হল ভারত। ২০১৬ থেকে ২০২৩-এর মধ্যে ৭৭১ বার ইন্টারনেট শাটডাউন হয়েছে ভারতে।
অর্থাৎ, আমরা খেতে পাচ্ছি না, পরিষ্কার জল-বাতাস পাচ্ছি না, সেগুলোর খবর দেওয়ার মতো ইন্ডিপেন্ডেন্ট মিডিয়া নেই এবং যদিও বা থাকে, সেই খবর আমাদের কাছে পৌঁছনোর উপায় নেই, কারণ ইন্টারনেট অফ করে দেওয়া হয়। রেগে থাকার কারণ তো কম নেই। এই রকম সময়ে মনে পড়ল ঠিক ৫০ বছর আগে ‘দিওয়ার’ মুক্তি পেয়েছিল!
‘অ্যাংরি ইয়ংম্যান’ কথাটা অল্প বয়সে বাবার মুখে শুনেছিলাম। সেলিম-জাভেদ নামটাও। ‘জঞ্জির’, ‘দিওয়ার’, ‘ত্রিশূল’, ‘শক্তি’ দেখানো হলে টিভির দিকে পয়েন্ট করে বাবা বলতেন, ‘অমিতাভ বচ্চন… অ্যাংরি ইয়ংম্যান বলতাম আমরা…’। স্কুলে পড়ি তখন। অ্যাংগার বলতে ছিল ওই দিন বিকেলবেলায় ব্যাটে বল না লাগতেও কট আউট হয়ে যাওয়ার রাগ, ফাঁকা ক্লাসে চুপ থাকা সত্ত্বেও মনিটরের আমার নামে নালিশ করার রাগ, মা-কে দেখিয়ে টিউশন মাস্টারের আমার কান মুলে দেওয়ার রাগ। অ্যাংগার বলতে এই বুঝতাম তখন। অমিতাভ কেন রেগে থাকতেন বুঝতাম না। বুঝতাম না কেন সেলিম খান এবং জাভেদ আখতার এই প্রোটোটাইপটিকে তৈরি করেছিলেন।
আমার সঙ্গে অন্যায় হয়েছে এবং অন্যায় প্রতিনিয়ত সবার সঙ্গে সব সময় হচ্ছে– এই বোধটা কলেজ শেষ করে কর্মজীবনে ঢোকার পরে ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম। আমি যখন জার্নালিজম কলেজে ঢুকি, ঠিক তার আগের বছর নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হন। ১১ বছরে দেশ কীভাবে পাল্টেছে আমরা সবাই জানি। এখন রাস্তায় রাস্তায় অ্যাংরি ইয়ংম্যান! সেলিম-জাভেদের ‘অ্যাংরি ইয়ংম্যান’ অমিতাভের সঙ্গে এদের তফাত হল– এরা ‘এস্ট্যাব্লিশমেন্ট’-এর বিরুদ্ধে ‘অ্যাংরি’ নয়, এরা ‘এস্ট্যাব্লিশমেন্ট’-এর হয়ে ‘অ্যাংরি’।
অমিতাভের অ্যাংরি ইয়ংম্যান ‘দিওয়ার’-এ সমাজের আন্ডারক্লাস থেকে উঠে এসেছে, তাঁর রাগ ওয়ার্কিং-ক্লাস অ্যাংগার। ‘অ্যানিমাল’-এ রণবীর কোটিপতি শিল্পপতির ছেলে। তাঁর রাগ উচ্চবর্ণের দম্ভ। ‘দিওয়ার’-এ বিজয় (অমিতাভ) সেই সমাজের প্রতি রেগে, যে সমাজ তার ইউনিয়ন লিডার বাবাকে শ্রমিকদের হয়ে সরব হওয়ার জন্য চোর অপবাদ দিয়ে ফাঁসায়। ‘অ্যানিমাল’-এ রণবিজয়ের (রণবীর) কোম্পানির ইউনিয়ন তো নেই-ই, বরং কোম্পানির মালিক রণবিজয় শ্রমিকের ইউনিফর্মে নিজের ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার লড়াইকে শ্রমিকদের লড়াই হিসাবে তুলে ধরে। ‘দিওয়ার’-এ বিজয় রেগে রয়েছে একটি অন্যায্য, দুর্নীতিগ্রস্ত দুনিয়ার প্রতি। ‘পুষ্পা’ বা ‘কেজিএফ’-এর রকিভাই রেগে কারণ রাগ দেখানোই কুল। চুল-দাড়ি রেখে, মুখে সিগারেট নিয়ে, স্লো মোশনে হাঁটা এখন একটা কমার্শিয়াল ফিল্ম হিরোর মার্কেটে টিকে থাকার এস্থেটিক রিক্যুয়ারমেন্ট– যার সঙ্গে সেলিম-জাভেদের সমাজবাদী পলিটিক্সের কোনও যোগ নেই।
অ্যাংরি ইয়ংম্যান আসলে কী? অ্যাংরি ইয়ংম্যান সমাজের বিশ্বাসঘাতকতায় ক্ষুব্ধ। ‘দিওয়ার’-এ বিজয় দেখেছে তার বাবা সৎ মানুষ ছিল। কিন্তু যাদের জন্য তার বাবা লড়ছিল, তারাই তাকে ধরে হাতে ‘মেরা বাপ চোর হ্যায়’র ট্যাটু করে দিল। ‘আমার সঙ্গে সমাজ অন্যায় করেছে তাই আমি এই গোটা সিস্টেমটাকেই ওলটপালট করে দেব’, অ্যাংরি ইয়ংম্যান এই ‘এক্সিস্টেনশিয়াল অ্যাংস্ট’ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ‘এক্সিস্টেনশিয়াল’ কারণ তার বিশ্বাস সে তার বুদ্ধি, মনের জোর আর অবশ্যই হাতের জোর দিয়ে পৃথিবীটাকে ভেঙেচুরে নিজের মতো গড়ে নেবে। সেই সর্বেসর্বা, সেই নিৎশের উবেরমেনশ।
এখানেই লুকিয়ে আছে সেলিম-জাভেদের সোশ্যালিস্ট ‘অ্যাংরি ইয়ংম্যান’-এর ভিতরের ফ্যাসিস্ট। অমিতাভের অ্যাংরি ইয়ংম্যান সিস্টেমের প্রতি রেগে থাকত কারণ যে গণতন্ত্রের সকলকে সমান অধিকার এবং সুযোগ দেওয়ার কথা ছিল, সেই ডেমোক্রেসিকে খুব সহজেই কিছু ক্ষমতাশীল লোক নিজের স্বার্থে দুমড়েমুচড়ে নিয়েছে।
একটা ফ্যাসিস্ট স্ট্রংম্যানেরও একই মত। তফাত হল, তার বিশ্বাস, গণতন্ত্র রয়েছে সংখ্যালঘুদের দখলে, তাদের হয়ে যারা কথা বলছে সেই সব বুদ্ধিজীবীর দখলে এবং তাদের হয়ে যারা রাজনৈতিক লড়াই লড়ছে সেই সব কমিউনিস্ট, সোশ্যালিস্ট, ফেমিনিস্ট, আরবান নকশালদের দখলে।
‘অ্যানিমাল’-এ রণবীরের কোম্পানির প্রতীক স্বস্তিক চিহ্ন ছিল একটা কারণে। ঠিক যেমন হিটলার ১৯২০-র ইউরোপীয় শ্রমিক শ্রেণির ক্ষোভকে হাতিয়ার করে নিজের নাৎসি পার্টির নামের ভিতর ‘সোশ্যালিস্ট’ লুকিয়ে রেখেছিলেন (ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি), সে রকমই রণবিজয় নিজের ভায়রাভাইদের সঙ্গে লড়াইটাকে ওয়ার্কারদের দেওয়া বক্তৃতাতে শ্রেণিযুদ্ধ হিসাবে চালিয়ে দেয়।
ফ্যাসিস্ট রাজনীতির যেরকম লৌহমানব প্রয়োজন, যে সমস্ত রাজনৈতিক ইনস্টিটিউশনের খোলনলচে বদলে নতুনভাবে সোসাইটি সাজাবে, অমিতাভ বচ্চন এবং সেলিম জাভেদের ত্রয়ী অজান্তে সেই মডেলটাই ভারতীয় সিনেমায় নিয়ে আসে। ভারতীয় বললাম, হিন্দি নয়, কারণ অমিতাভ এই রোলগুলো না করলে, রজনীকান্তের এইসব ছবি রিমেক করে সুপারস্টার হওয়া হত না, তাঁর দেখানো পথে দক্ষিণের বিজয়, অজিত, আল্লু, প্রভাস তারকা হতেন না এবং তাঁদের দেখাদেখি রণবীর কাপুর-রণবীর সিং চুল-দাড়ি কাটা বন্ধ করে দিত না!
দোষ অমিতাভ, সেলিম, জাভেদের নয়। ’৯০-এর নিও-লিবারালাইজেশন বা নব্য উদারীকরণের পরে নির্বাচনী রাজনীতি মানুষের দৈনন্দিন সমস্যা এবং যাপন থেকে সরে গিয়ে এস্থেটিক-এর পলিটিক্সে পরিণত হয়ে গিয়েছে। এখন আর কোনও মেজর পার্টিরই অবস্থান নিও লিবেরালিজমের প্রতিরোধ নয়। বরং প্রাইভেট ক্যাপিটালের কোলে বসে লুটেপুটে খাওয়া হল ‘রুলস অফ দ্য গেম’।
এই রকম সময়ে রাগ তো সিস্টেমের প্রতিই হওয়ার কথা। কিন্তু সেই রাগের গল্প আমাদের সিনেমা-সাহিত্যে কোথায় দেখছি? যেসব রাগী হিরোদের পর্দায় দেখছি, তারা হয় নিজেদের ব্যক্তিগত শত্রুদের দমন করা নিয়ে রেগে অথবা মুসলমান ও পাকিস্তানিদের যথাসম্ভব মার দেওয়া হচ্ছে না বলে রেগে। ওয়ার্কিং ক্লাস অ্যাংগার কই? যারা রাগী হনুমানের স্টিকার লাগিয়ে গাড়ি-বাইকে চড়ে ঘুরছে, তারা কী নিয়ে রেগে? ‘দিওয়ার’-এর ৫০ বছর পূর্তিতে আমরা আবার যেন ঠিক জায়গায়, ঠিক দিকে নিজেদের রাগ টার্গেট করতে পারি।
ভারত সরকারের প্রো-কর্পোরেট লেবার কোড নিয়ে দেশজুড়ে যে স্ট্রাইক ডাকা হচ্ছে, তার মধ্যে ‘দিওয়ার’-এর বিজয়কে খোঁজার চেষ্টা করছি। আমার বাবার জেনারেশন যেমন তাঁদের ‘অ্যাংরি ইয়ংম্যান’-কে খুঁজে পেয়েছিল, আমরা তো পাইনি, তাই।
………………………………………
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
………………………………………