সোনাগাছিতে ডিপ কিসিং অচল টাকা। ফিরিয়ে দেওয়া হয়। অন্য গভীরতা, ভিন্ন গুহাপথ অবাধ। কিন্তু গভীর চুমু, স্বামীর মতোই, সোনাগাছিতে নিষিদ্ধ। তবু সেই মধুর মেয়ে আমাকে দান করছে মদ আর তামাক আর ধোঁয়া, তার সুঘ্রাণের ত্রিবেণীসঙ্গম স্নাত আগ্রহী ঠোঁট, আমার পানযাপনে এই মুহূর্ত চিরকালের মৃগতৃষ্ণিকা! সেই মেয়ে তার চাট হিসেবে আনিয়েছে রয়েল-এর চিংড়ির কাটলেট। আমি ছুঁইনি। কেননা, আমার ইন্দ্রিয়ঘন ইচ্ছে আমার সমস্ত স্পর্শকে নিয়ে চলেছে তার খোলা বাগানে, এই সুখ আজও আমার মেদুর মনকেমনে ঘটমান বর্তমান!
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
তবলার বোল তুলতে চাই চাঁটি। হুইস্কির বুলি তুলতে চাই চাট।
চাটের নামাবলি হুইস্কির গায়ে না জড়ালে নেশায় তার বুলির খোলতাই হয় না। এই লেখার প্রধান উদ্দেশ্য আমার সেই ২৩-২৪ বছর বয়স থেকে নিরন্তর পানযাপনে চাটের নামকীর্তন। তবে একথাও ঠিক, চাটের নামাবলির কিছু নাম ঝাপসা। আর কিছু নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে একান্ত ব্যক্তিগত মনকেমন। যেসব মেয়েরা সেই সব চাট মিশিয়েছিল আমার পানযাপনে, তারা মিলিয়েছে সুদূর নীহারিকায়, যারা করে আছে ভিড় আকাশের নীড়! পৃথিবীতে এমন নারীপুরুষ হয়তো বিরল, যাদের পান মগ্নতায় মিসিং নেই। সত্যি বলতে, আমার সমস্ত পানযাপনে মনকেমন মহোত্তম চাট। বিশেষ করে আমি যখন একা মদ খাই। বাড়িতে। কিংবা শুঁড়িখানায়। বাড়িতে ঘরের মধ্যে কেবল টেবিল ল্যাম্পের দুর্বল দীপন। আর শুঁড়িখানায় আমার থাকবেই থাকবে একটি নিজস্ব বিষাদ কৌণিকতা। এবং মৃদু মিউজিক। শুঁড়িখানার মিউজিক মৃদুতার ওপর আমার তেমন কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এটাই ভালো। সে সন্ধেবেলার, কখনও কখনও দুপুরের মৃদুতাহীন অথচ শীলিত পরস্ত্রী। তার অবাধ্যতাই হয়ে ওঠে আমার ড্রিংকের চাট। বেশ লাগে। কিন্তু বাড়িতে আমার সঙ্গহীন পানের নিবিড় অঙ্গে সবসময় রবীন্দ্রনাথ বুনে দেন তাঁর কথাহীন গানের বিমূর্ত বেদনা! এর চেয়ে চর্চিত চাট আমার পানচর্চায় এ জীবনে পাইনি।
যত গহন হয় আমার পানের মগ্ন বিষাদ, তত শরীরী হয় সে আমার মনকেমনের খাঁজে খাঁজে, ভাঁজে ভাঁজে! তার কোমরের ত্রিবলি ভাসে আমার হুইস্কির বরফে। আমার রতিবাসনার ঘাম দেখা দেয় হুইস্কির স্ফটিক গ্লাসে। আমি চুমুকে পান করি সেই মেয়ের শরীর আর ভাবি, আমার পানযাপনে আজও সে সাঁতারু! হুইস্কির এই অবদানের গায়ে আজও মন রেখে যায় নতি। আজও হুইস্কি-প্রসূত বেদনার ওপর ঝরে পড়ে তার রাঙা শাড়ির দুষ্টু আঁচল। তার পানতপ্ত ফাটলে জমে ওঠে ঘাম। সব কিছু এত টাটকা কেন আমার মনকেমনে? কেন হুইস্কির গোপন লকারে স্মৃতির পুরনো গয়নাগুলো দূরের আকাশে উজ্জ্বল তারার মতো?
বহু বছর আগে আমার প্রথম যৌবনের একটি সোনাগাছি সন্ধে আমার গোপন লকারে অহংকারী অলংকার। নাম মনে নেই তার। মনে আছে তার আটপৌরে মধুরিমা। সে আর আমি এক সঙ্গে মদ খাচ্ছি। দু’-ঘণ্টার জন্যে সে আমার। তার বাংলা আমাকে প্রথম প্রথম বেদনা দিচ্ছে, স্পষ্ট মনে আছে। কিন্তু তার ব্যবহারের উত্তাপ ও মাধুর্য ক্রমশ তার মুখের ভাষা ও উচ্চারণ টপকে আমাকে স্পর্শ করছে। আমি পানে যত দ্রুত, সেই তরুণী তত বিলম্বিত, মনে আছে। তখন আমি সিগারেট খেতাম। ফিল্টারহীন বোধতপ্ত চারমিনার। সেই তরুণী, পানে তার যত বিলম্বিত লয়, ধূমপানে তার তত দ্রুতি। সে ক্যাপস্টানের চেনস্মোকার। কমা সেমিকোলন নেই কোথাও। জ্বলন্ত ডগা থেকে জ্বলন্ত ডগা থেকে জ্বলন্ত ডগায়। জেমস জয়েসের গদ্যের মতো। সোনাগাছিতে ডিপ কিসিং অচল টাকা। ফিরিয়ে দেওয়া হয়। অন্য গভীরতা, ভিন্ন গুহাপথ অবাধ। কিন্তু গভীর চুমু, স্বামীর মতোই, সোনাগাছিতে নিষিদ্ধ। তবু সেই মধুর মেয়ে আমাকে দান করছে মদ আর তামাক আর ধোঁয়া, তার সুঘ্রাণের ত্রিবেণীসঙ্গম স্নাত আগ্রহী ঠোঁট, আমার পানযাপনে এই মুহূর্ত চিরকালের মৃগতৃষ্ণিকা! সেই মেয়ে তার চাট হিসেবে আনিয়েছে রয়েল-এর চিংড়ির কাটলেট। আমি ছুঁইনি। কেননা, আমার ইন্দ্রিয়ঘন ইচ্ছে আমার সমস্ত স্পর্শকে নিয়ে চলেছে তার খোলা বাগানে, এই সুখ আজও আমার মেদুর মনকেমনে ঘটমান বর্তমান!
পাশাপাশি মনে পড়ছে পাকিস্তানের লাহোরের নিশিডাক হীরামান্ডি। রাত এগারোটায় খোলে। ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেট দেখতে গিয়ে আমি হীরামান্ডিতে কিছুটা রাত কাটাব, কিন্তু মদ খাব না। এই প্রতিশ্রুতি আমি করেছি আমাদের প্রধান সম্পাদক, প্রতিদিনের বস, টুম্পাই (সৃঞ্জয় বোস) এবং তার স্ত্রী রূপাই (নীলাঞ্জনা)-এর কাছে, কেননা পাকিস্তানে মদ নিষিদ্ধ। আমি এই প্রথম কোনও দেশে এসেছি যে দেশে মদ ভয়ংকরভাবে বারণ। সেই দেশের নিষিদ্ধপল্লিতে আমি। এই পল্লির প্রায় সমস্ত বাড়ি এক রকমের। রাত ১১টার পরে দরজা খোলে। আমার সামনে বিশ-বাইশের এক টুকটুকে আফগান সুন্দরী। তার চোখ-ফেরানো-যায়-না ঊরুর ওপরে উর্দুতে কী সব লেখা! এমন রূপবতী কম দেখেছি জীবনে। কিন্তু এইটুকু দেখতে আমার প্রায় ১৫০ ডলার খরচ হয়েছে। আরও উচ্চাকাঙ্ক্ষী হওয়ার ইচ্ছে শুকিয়ে কাঠ। এই ঊরুস্পর্শ করলাম ভয়ে ভয়ে। রূপবতী বেদনার হাসি হাসল। হয়তো কিছু বলতে চাইল। কিন্তু কেউ কারওর ভাষা বুঝি না। হোটেলে ফিরে এলাম। টুম্পাই-রূপাই– দু’জনেই আমার উৎকণ্ঠিত অপেক্ষায়।
রূপাইয়ের বিপুল প্রশ্ন, ‘কী দরকার ছিল রঞ্জনদার ওই সব জায়গায় যাওয়ার? যদি বিপদে পড়ে?’ টুম্পাই চিরকালের মাথাঠান্ডা মানুষ, রসবোধে অম্লমধুর, মুচকি মুচকি হাসছে। আমি দেখলাম তার সামনে টেবিল ভর্তি কত রকমের কাবাব আর স্টেক। কিন্তু কোথাও নেই এক ফোঁটা মদ! এত চাট যে দেশে সে দেশে মদ নিষিদ্ধ! চাটের এমন দুর্গতি দেখে চোখে জল এল। চটি জুতোর মতো দেখতে একটা কাবাব প্লেট থেকে তুলে নিলাম। ওই কাবাবের নাম: চটি কাবাব। লাহোর ছাড়া কোথাও পাওয়া যায় না ওই কাবাব। স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়। কিন্তু মদ ছাড়া এই কাবাব আমার স্বাদ-কুঁড়িতে মাথা খুঁড়ে মরতে লাগল। আর তখুনি মনে পড়ল হীরামান্ডিতে ফেলে আসা সেই গোলাপি ঊরুর উর্বর উদগ্রীব মদ। চোখ বুঝে সেই তরল ঊরু পান করতে করতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চটি-চাট চিবোতে লাগলাম। পাকিস্তানের গরিব মানুষরা চটির মধ্যে মাংস বিছিয়ে রোদে ঝলসে এক সময় তৈরি করত এই কাবাব। এখন তার সোফিসটিকেটেড সংস্করণ পাকিস্থানের উচ্চবিত্ত নিশিনিলয়ে!
এবার আমার চাটসরণি আমাকে নিয়ে যাচ্ছে লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড-এর এক পানশালায়। এই পানশালা একটি মোটেলের অংশ। সেখানে কুণাল, আমার সতীর্থ, বন্ধু ও ভ্রমণসঙ্গী কুণাল ঘোষ, এবং আমি পৌঁছেছি সকালবেলা। দশটা নাগাদ শুঁড়িখানা খুলতেই কুণাল একটি টেবিলে আমাকে বসিয়ে দিয়ে বলল, যত খুশি, শুধু বিলে সই করে দেবেন। এইরকম কেউ কখনও আমাকে বলেনি। মার্জার ভাগ্যে এমন শিকেও ছেঁড়ে?
আমি কাচের দেওয়ালের পাশে যে টেবিলে বসে, সেখান থেকে বাইরের দিকে তাকাতেই হুইস্কির তালিকা এবং চাটের মেনু চোখে পড়ে। বিশ্বাস করতে পারছি না। এমনও চাটের মেনু পৃথিবীর কোনও শুঁড়িখানায় সম্ভব? বড় বড় করে চারকোল অক্ষরে ইংরেজিতে লেখা এই দেওয়াল বাণী: আমরা এই পানশালায় মদের সঙ্গে সেই সব প্রাগৈতিহাসিক খাদ্যই শুধু আপনাদের টেবিলে নিয়ে আসব, যা মানুষ খেতে শিখল আগুন জ্বালাতে শেখার ঠিক পরে। দেখি বাইরে মাছ এবং নানা প্রকার মাংস আগুনে ঝলসানো হচ্ছে। ছুটে বাইরে এলাম দেখতে। মদ আর ঝলসানো মাছ-মাংসের এলাহি ঝাপটা লাগল বাঙালি নাকে। আর প্রাচীন আরণ্যক আনন্দে-উত্তেজনায় আপ্লুত হলাম আমি। আর তখুনি চোখ পড়ল তার অঙ্গে। সে হাসল। হাসল তার খোলা শরীরের অমল অরণ্য। যেন সে হারানো কালের গুহামানবী। তার নাম মেরিয়ান। সে পানশালার বারমেড। আমি চাইলাম ‘Cutty Sark’ হুইস্কি, লার্জ। আমার দিকে এক পলক বেশি তাকাল। আবার হাসল। সঙ্গে নিয়ে এল অনেক রকমের ঝলসানো মাছ-মাংস। আমি নিলাম ঝলসানো বিফ আর চিজ। শুরু হল আমার সকাল। মদের সঙ্গে এমন চাট এই প্রথম খেলাম। তৃতীয় কাটি সার্ক যেই চেয়েছি মেরিয়ান এসে জানতে চাইল, ‘আর ইউ আ রাইটার, স্যর?’
‘হোয়াট মেকস ইউ আস্ক দ্যাট?’ হেসে জিজ্ঞেস করি আমি। ‘ওনলি রাইটার্স ড্রিংক কাটি সার্ক, স্যর’, বলে মেরিয়ান। “উই কল ইট ‘রাইটার্স হুইস্কি’।” আমি মেরিয়ানকে বলি না– কেন আমি খাচ্ছি কাটি সার্ক। ওটাই ওদের তালিকায় সবচেয়ে সস্তার স্বর্গ। পরের দৃশ্য, কাঠমান্ডু থেকে আরও ওপরে একটা গ্রাম, মনে হয় হিমালয় থেকে এক হাত দূরে। গ্রামের নাম ধুলিখেল। যে হোটেলে জানুয়ারির প্রচণ্ড শীতের রাতে গিয়ে পৌঁছলাম গাড়িতে কাঠমান্ডু থেকে, সেটা শীতবৃষ্টির রাত। শীল পড়ছে বৃষ্টির সঙ্গে। হোটেলের নাম ‘হিমালয়ান হরাইজন’। কিরণ, হোটেলের মালিক, আমার বন্ধু। কেননা প্রতি শীতে আমি আসি। তখন ভারতীয় চোখে পড়ে না নেপালের এই গ্রামে। অতিথিরা প্রায় সবাই বিদেশি। আমি এখানে আসি অনেকগুলো কারণে। এক শীত। দুই হুইস্কি। তিন হুইস্কির সঙ্গে ধুলিখেলের চিকেন মোমো। চার, শীতের ভোরের কুয়াশা। পাঁচ, শীতের রাত্রে আগুন জ্বেলে কাঠের আগুনে পোড়া বার্বিকিউ। আর বরফের ওপর নিট স্কচ। এখানে সবাই স্কচের ওপর জল। সেই জলে বরফের নৌকো ভাসিয়ে আদিখ্যেতা করে।
নেপাল হিন্দু দেশ। পৃথিবীর একমাত্র হিন্দু দেশ। কিন্তু ধুলিখেল গ্রামের হিমালয়ান হরাইজনের বিফস্টেক অতুল। জীবনের অনেকগুলো মোক্ষম শীত কাটিয়েছি ধুলিখেলে। স্কচের সঙ্গে ধুলিখেলের মোমো আর বিফস্টেক, আমার আজীবন রেকলেস পানযাপন আর শুঁড়িখানা-চর্চার শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি।
তবে আমার পানযাপন আর হুইস্কি-সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ প্রাপন এবং চাট– এই কলকাতায়।
এক বসন্তের রাতে। খোলা হওয়ার ছাদে। পার্টি চলছে। যে যার পছন্দের মদ খাচ্ছি। এবং যে যার মনের মদ নিয়ে গেছি। তখন এমনটা ছিল। কারও গায়ে লাগত না। তার আর আমার এক পছন্দ। সস্তার হুইস্কি। আমরা বলতুম, আটপৌরে পানাতুর আমরা।
আমরা দু’জন ছাদের কিনারে। সেদিন পরনে তার কালো শাড়ি। কালো স্লিভলেস। যতদূর ‘লেস’ হতে পারে। গলায় এক ছড়া পার্ল। বাতাসে উড়ছে আঁচল। তার এই অঞ্চল উদাসীনতা বেশ লাগে আমার। হঠাৎ লোডশেডিং। তখনও কলকাতায় ছিল লোডশেডিং-এর অকৃপণ করুণা। আমরা দু’জনেই তখন সিগারেট খাই। দু’জনের আঙুলে জ্বলছে ধরণীর তীব্রতম অগ্নিবিন্দু। অন্ধকার হতেই আমরা ঠোঁটে ঠোঁট লাগালাম। মদের গন্ধ। সস্তার মদের তীব্র গন্ধ। সিগারেটের গন্ধ। ইচ্ছের গন্ধ। গভীরতম, নিবিড়তম, দীর্ঘতম সেই চুমু আমার খাওয়া এক অতুলনীয় অপরিমেয় চাট।
আজও ফুরোয়নি। ফুরোবে না কোনওদিন।
………………………………
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার.ইন
………………………………
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved