একেবারে ফেলে দেওয়ার আগে একটু থাক। ওইটুকুই রয়ে যাওয়া, শিকড়ের সংরক্ষণ। চাইলে, ছিঁড়ে যাওয়া শাড়ি কেমন কাঁথা হয়ে থাকে আরামের। পুরনো দিনের সেলাই মেশিন হঠাৎ আলোকিত এক ল্যাম্পশেড। ছিল রুমাল, হয়ে গেল এমব্রয়ডারির অচিন নাম। বাড়ির বাগানের ঠাকুরদার পোঁতা গাছ, ছায়াটুকুই দেবস্থান, আন্তরিক এক মায়ানগর। এই ছায়ায় বাস করুক আমার সন্ততি। ছেলে যখন আমার জামা গায়ে দেয়, তাকিয়ে থাকি, আহা, আমার বেঁচে থাকার এমন আলগা সুখ।
ঝিমধরা দুপুরবেলাগুলোর তন্দ্রা ভেঙে যেত খানখান করা স্বরে– ‘অ্যাই পুরানা শিশিবোতলকাপড়কাগজ বিক্রি আছে-এ-এ’। বাতিল জড়দগব সব উটকো জিনিসপত্রের ফিরি। কলকাতা জুড়ে পুরনো প্রদর্শনীর বস্তামহল। কারা কেনে এইসব? কারা ফিরে ফিরে দেখে শৈশব? ফুটপাতের একপাশে ডাঁই করা উচ্ছিষ্টউচ্ছ্বাস। তারই পাশে বসে কাগজকুড়ুনি একমনে বেছে যাচ্ছে গুপ্তধন। লোকটির চারপাশে পাড়ার পাহাড়াদার নেড়ির দল। তারাও খুঁজছে বাড়তি কোনও সেকেন্ডহ্যান্ড সুখাদ্য। বাতিল হয়ে গিয়েও সবকিছু বাতিল হয় না। হাতফেরতা অলীকধন কোনওমতে রয়ে যায় এ শহরের এককোণে।
আমি ভালবাসি পার্ক স্ট্রিটের নিলামঘর। মুছতে মুছতে তা কয়েকটিতে এসে ঠেকেছে। পুরনো দিনের চেয়ার-টেবিল, আলোর শেড, কলম, ঘড়ি– কতশত আশ্চর্য। একবার ঢুকে পড়তে পারলে একলহমায় অন্যশতক নেমে আসে। কার বাড়ি ভাঙা হচ্ছে এবার? কোন খড়খড়ি কোন বারান্দার লোহার ফুলকারি গ্রিল নেতিয়ে পড়ে থাকে ধুলোর জামা পরে? পুরনো যত্ন আর আভিজাত্যের ছাপ আসবাবের সর্বাঙ্গে। একরকমের বেঁচে থাকা, বর্ণাঢ্য মহানগর ফেলে দিয়েছি আমরা। অভাবে পড়ে বেচে দিয়েছি যেন। পেন্ডুলাম ঘড়িটার সময় আটকে গিয়েছে গলার কাছটায়। ওই সময়টায় কী ঘটেছিল? পম্পেই শহরের মতো লাভাস্রোতে স্থির হয়ে গিয়েছিল সব? দম পায়নি বেদম কোনও হারিয়ে যাওয়া। হাতবদল হয়ে যায় সম্পর্কের কলম, যে চিঠি লেখা বাকি রয়ে গেল, জল পেলে তা আবার লিখবে কোনও নতুন মন। অকশন হাউজের ভেতরটায় ইতিহাসের সোঁদা গন্ধ, এক একটা জিনিসের ভেতর ফেলে আসা সময়ের দিনলিপি। পার্ক স্ট্রিট শুধু নয়, দক্ষিণের গোপালনগর এমন এক ম্যাজিক এলাকা! ফুটপাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে দুঃখী আলমারি, শূন্য চারপায়ার দল। কে কুড়িয়ে নেবে কে জানে? কত দামে বিক্রি হয়ে যাবে পুরনো গল্পেরা? ভাঙা জানলার ফাঁক দিয়ে কীভাবে গলে এল দু’-এক টুকরো রোদ, স্টেইন গ্লাসের বরফি কারুকাজে সে রোদ্দুরের গোলাপবাহারই বা অক্ষত রইল কেমনে? জিমশরীরের মতোই বেঁচে থাকার সিক্স প্যাক বের করে ফেলছি সবাই। জেনে গিয়েছি মেদ বাহুল্য, পরিতাজ্য। শুধু ভুলে গিয়েছি নিরবচ্ছিন্ন মায়ামুকুরের নরম আলো… রিক্তের যাত্রায় ভুলে যাওয়া অতিরিক্তখানি। চেয়ে থাকায় ভুল ছিল কোনও? চশমার পাওয়ারে?
প্যারিসে পৌঁছেছি এক বসন্তের সকালে… দু’চোখ ভরা ঘুম নিয়ে। ঘুমব না টলমল করতে করতে হাঁটব? দেখি, ফুটপাত জুড়ে বসেছে শনিবারের খোলা হাট। নিজের বাড়ির ব্যবহৃত সব টুকিটাকি বিক্রি হচ্ছে দুপুর বিছিয়ে। কতকালের পুরনো এক গোল চশমার পুরনো ফ্রেম আমার দিকে চেয়ে মুচকি হাসছে। সোনাই কারুকাজ তার গায়ে, বোনাই ঐশ্বর্য তার বিস্ময়ে। সবটা মাপসই হলই না না-হয়, একটু লগবগ করছে সে নাকের ব্রিজে… কিন্তু একচিলতে গ্যাসবাতি জ্বলে ওঠে চশমাটা দু’-চোখে বসালে, নতুন নয়, কিন্তু বড্ড প্রিয়মতো এক অজানা প্রাচীন। শুধু প্যারিস নয়, ইউরোপের বহু শহরে আছে ব্যবহার করা জামাকাপড়ের দোকান। ওই হাড়কাঁপা শীতে কতশত হোমলেস ওম নিয়েছে গোগোলের ওভারকোট-এ। নানা মাপের মানবিক সেকেন্ড হ্যান্ড, গায়ে লেগে আছে জীবনের গন্ধ। কলেজে পরার সময় মহা আনন্দ, আর ইউনিফর্ম পরতে হবে না কোনও দিন, কিন্তু রোজকে রোজ পরার মতো অত জামাও নেই। আছে কাঠের আলমারিতে রাখা বাবার জামাকাপড়। বাবার জামা পরে যাওয়ার আলাদা একটা ভালো লাগা। আমার বড় হয়ে যাওয়াকে বাবাও চেয়ে দেখে সস্নেহ প্রশ্রয়ে, আর আমিও বাবার গন্ধ গায়ে মেখে খুব নিশ্চিন্ত এক যৌবন কাটাই।
‘হারমোনিয়াম’ ছবির মতো। এক গল্প থেকে আরেক গল্পে ঘুরেফেরে ছেলেবেলার হারমোনিয়াম। নৌকোয় শোনা কবেকার গানের সুর টেনে নিয়ে যায় সাদা কালো রিডে। ওপার থেকে লুকিয়ে আনা, আঁকাবাঁকা নাম লেখা সাবেকি কাঁসার বাসনের ওপরে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে জড়ো হয় প্রসাদি ফলের স্তূপ। পুজোর থালা যেমন, বাড়ির খাট যেমন, একহাত থেকে আর একহাতে যায়। পুরনোরই সেখানে কদর, নতুন সেখানে নব্যনাদান। যে কোনও সংরক্ষণের মধ্যে একটা হাতবদল আছে। নিজের সংস্কৃতির ভ্যালু বুঝতে পারার মধ্যে একটা অব্যর্থ ব্যাটন বদলাবদলি রয়ে যায়। গোটা প্যারিস শহরটা যেমন। কোনও কিছুর বদল ঘটেনি কিছু, শুধু এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে বয়ে এসেছে। সব নতুন অত সহজে করতে দেয় না প্যারিস। একটা ১৭ শতকের দ্বিতীয়হাত শহর হয়ে সে সবার থেকে আলাদা। বা যেমন কিউবা। নতুন আমেরিকান গাড়ি ঢুকতে না দেওয়ার জন্য সেখানে চলে আদ্যিকালের বুইক, ক্যাডিলাক। পথঘাট জুড়ে ইচ্ছেগাড়ির মিছিল, ব্র্যান্ড নিউকে কাঁচকলা দেখাচ্ছে। সিগারেটের কাউন্টারের মতো, হাত ঘুরে ঘুরে ধোঁয়ার কুণ্ডলী বন্ধুত্ব জুড়ছে অনায়াসে।
একেবারে ফেলে দেওয়ার আগে একটু থাক। ওইটুকুই রয়ে যাওয়া, শিকড়ের সংরক্ষণ। চাইলে, ছিঁড়ে যাওয়া শাড়ি কেমন কাঁথা হয়ে থাকে আরামের। পুরনো দিনের সেলাই মেশিন হঠাৎ আলোকিত এক ল্যাম্পশেড। ছিল রুমাল, হয়ে গেল এমব্রয়ডারির অচিন নাম। বাড়ির বাগানের ঠাকুরদার পোঁতা গাছ, ছায়াটুকুই দেবস্থান, আন্তরিক এক মায়ানগর। এই ছায়ায় বাস করুক আমার সন্ততি। ছেলে যখন আমার জামা গায়ে দেয়, তাকিয়ে থাকি, আহা, আমার বেঁচে থাকার এমন আলগা সুখ। জামা বদলাবদলির এই খেলায় চুপ করে অপেক্ষা করি আমি পরের দানের, আর একটু বড় হলে নিশ্চয়ই ওর জামাটাও আমায় পরতে দেবে একদিন।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved