প্রাচীন ভারতে তিলকে প্রারব্ধের চিহ্ন মানা হত। এ ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে, পূর্বজন্মের কর্মের প্রভাবেই তিল গঠিত হয় শরীরে এবং সে তত্ত্বে লিঙ্গভিত্তিক পার্থক্যও রয়েছে। পুরুষদের কিছু তিল ডান পাশে শুভ– যেমন ডান গালের তিল মানে অনন্ত ধন। সেদিক দিয়ে ভাবতে গেলে মুকেশ আম্বানির ডান গালের তিল যে এ হেন বিশ্বাসের সবচেয়ে ন্যায্য ‘ডেটা’, এটা পরিষ্কার।
১৮.
‘তিল থেকে তাল’– প্রবাদটার জন্ম কী থেকে, তা বলা মুশকিল! তালভক্ত গোপালের গালে তিল ছিল কি না, জানা যায় না। কিন্তু একটা ছোট্ট কালো ফোঁটা, যা মেলানিনের সঙ্গবদ্ধতায় আমাদের ত্বকে দেখা দেয় জন্ম ইস্তক বা হঠাৎ করে, তা কিন্তু শুধু সৌন্দর্যের চিহ্ন নয়। বিশ্বের বিভিন্ন সভ্যতায় এবং ধর্মে ভাগ্যের আয়না বলেও মানা হয়েছে তাকে।
কোথাও তিল মাত্রই পয়া, মানে ধন-সম্পদ-সুখের খবর এনে দেওয়ার দাবি করে। কোথাও আবার অপয়া হয়ে দুর্ভাগ্যের শঙ্কা ছড়ায়। আর আমরা মা-ঠাকুমার গালগল্পে ডুবে যেতে যেতে ভাবি যদি কপালে তিল থাকে তাহলে কি রাজা হব? নাকি নাকের ডগায় তিল গজালে জীবনভর নাকাল? যুক্তিবোধ রেগেমেগে বলে, ‘বাঁদর, নাম দিনু তোর মাকাল!’
প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় তিলকে দিব্যদর্শনের অংশ মানা হত। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ থেকে ৫০০ অবধি, ব্যাবিলনীয়রা তিলকে শরীরের অন্যান্য চিহ্নের সঙ্গে মিলিয়ে ভাগ্য পড়তেন। ডান হাতের তিল মানে প্রতিবেশীর সম্পদ জয়! রাজার হাতে থাকলে রাজ্য জয়, অতঃপর যুদ্ধের দামামা, সুতরাং পরশি রাজ্যের জন্য তা অপয়া। কিন্তু বাঁ-পায়ের তিল মানেই অযাত্রার বার্তা। অর্থাৎ, কোথাও যাওয়ার আগে সহযাত্রীর বাঁ-পায়ে তিল আছে কি না, তা কাপড় তুলে চেক করে নেওয়াই হয়তো ছিল দস্তুর! যাত্রা শুভ হওয়ার জন্য এইটুকু সাবধানতা ব্যাবিলনীয়রা অবলম্বন করতেন কি না, তার প্রমাণ অবশ্য পাওয়া যায় না! বুকের তিল মানে ছিল কঠোর পরিশ্রমের পর সাফল্যের প্রমিস্। অর্থাৎ, জেনিফার লরেন্স, নিজের বুকের যে তিলগুলোর নাম দিয়েছেন ‘সেক্সি স্কার’, মেসোপটেমিয়ান ঐতিহ্যে হলে সেগুলোকেই বলা হত ‘ঘাম ঝরাও, অস্কার নাও’-এর টিমটিমে নক্ষত্র-বার্তা।
প্রাচীন ভারতে তিলকে প্রারব্ধের চিহ্ন মানা হত। এ ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে, পূর্বজন্মের কর্মের প্রভাবেই তিল গঠিত হয় শরীরে এবং সে তত্ত্বে লিঙ্গভিত্তিক পার্থক্যও রয়েছে। পুরুষদের কিছু তিল ডান পাশে শুভ– যেমন ডান গালের তিল মানে অনন্ত ধন। সেদিক দিয়ে ভাবতে গেলে মুকেশ আম্বানির ডান গালের তিল যে এ হেন বিশ্বাসের সবচেয়ে ন্যায্য ‘ডেটা’, এটা পরিষ্কার।
মহিলাদের কিছু তিল বাঁ-পাশে শুভ, যেমন ঠোঁটের উপর থাকলে সহানুভূতিশীল স্বামী বা প্রেমিকের উপস্থিতির সম্ভাবনা দেখায়। কিন্তু বিখ্যাত অভিনেত্রী রেখার ঠোঁটের বাম কোনায় আবেদনময়ী বিখ্যাত তিলটি এই ‘সিলসিলা’য় কতটা সাকসেসফুল, তা অবশ্য উনি নিজেই বলতে পারবেন। গোপন অঙ্গে তিল মানে আবার রোমান্টিক চ্যালেঞ্জ! এটি কার কার রয়েছে, এখানে বলা মুশকিল কিন্তু যার যারই রয়েছে তারা বিবেককে (অগ্নিহোত্রী নয়) প্রশ্ন করে দেখতে পারেন!
মেয়েদের ডান কপালে তিল মানে আবার সৌভাগ্যের প্রতীক। তাই আলিয়া ভাটের সাফল্যর জন্য বেচারা করণ জোহরকে ‘ফ্ল্যাগ বেয়ারার অফ নেপোটিজম’ না বলে অভিনেত্রীর ডান কপালের মার্জিনে জেগে থাকা তিলটাকে দোষারোপ করা যায় কি না, এটা একবার কঙ্গনার ভেবে দেখা উচিত ছিল।
প্রাচীন চিনে ঝৌ রাজবংশে (১০৪৬-২৫৬ খ্রিস্টপূর্ব) মিয়ান জিয়াং বা ফেস রিডিংয়ে তিলকে ভাগ্যের শিল্প মানা হত। লুকনো তিল ছিল গোপন আশীর্বাদ, যেমন ভুরুর মধ্যে তিল মানে ধন ও দীর্ঘায়ুর সিগন্যাল। দৃশ্যমান তিল প্রায়ই অশুভ, কিন্তু লাল-চকচকে হলে আবার শুভ। কপালের মাঝের তিল দেয় শান্ত জীবন, নিচের চোখের পাতায় তিল থাকলে সম্পর্কের সমস্যা বাড়ে। নাকের ডগায় হলে সম্পদ, পাশে হলে অপচয়। গালের তিল ছিল স্বার্থপরতার চিহ্ন। চিবুকে থাকলে জেদ আর ক্ষমতার প্রতীক। এখানে বলে রাখা ভাল চিবুকের তিল নিয়ে চিন দেশে যে লোকটি সবচেয়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন তার নাম মাও জে দং। চিবুকের তিলের মতোই চৈনিকদের কাছে যিনি সততই ক্ষমতা আর জেদের পরাকাষ্ঠা। যদিও তিব্বতিদের কাছে আসলে তিনি কী, তা নিয়ে কথা না বাড়ানোই ভালো।
প্রাচীন গ্রিসে (অষ্টম শতাব্দী খ্রিস্টপূর্বে ) নাকের তিল মানে ছিল অতৃপ্ত প্রেম, ঠোঁটের তিল গ্লুটনি, গলার পিছনে হলে মৃত্যু। লাল তিল মানে দৈব, যেমন সেলুকাসের ঊরুর তিল তাঁর রাজত্বের চিহ্ন। মেরিলিন মনরোর বিখ্যাত গালের তিল গ্রিক ঐতিহ্য অনুযায়ী কিন্তু অশুভ ও স্বার্থপরতার প্রতীক। তাই তাঁর গ্ল্যামার জীবনে যে জিনিস ছিল সেক্স সিম্বল, সেটাই তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখের সঙ্গে কোথাও যেন ওতপ্রোত ভাবে মিলে যায়।
রোমান যুগে (৫০৯ খ্রিস্টপূর্ব-৪৭৬ খ্রিস্টাব্দ) গ্রিক প্রভাবের কারণেই তিল ছিল সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সম্রাটদের ক্ষেত্রে মুখের তিল ছিল ঐশ্বরিক নিদান। মজার কথা হল রোমানরা তিলের কনসেপ্টটা অনেকটা ফ্যাশন কপি করার মতো প্রায় পুরোটাই গ্রিকদের থেকে কপি করেছে! মধ্যযুগীয় ইউরোপে (পঞ্চম-পঞ্চদশ শতাব্দী) খ্রিস্টধর্মে তিলকে ‘ডাইনির চিহ্ন’ মানা হত, ‘অস্বাভাবিক’ তিলকে ভাবা হত শয়তানের সঙ্গে যুক্ত। পস্থমাসের স্ত্রী ইমোজেনের বুকের ওই তিলটার জন্যই তাঁকে বেকার বদনাম নিয়ে, বেঘোরে প্রাণ দিতে হয়েছিল কি না, তা স্বয়ং শেক্সপিয়রই বলতে পারবেন। রেনেসাঁর পর প্রারম্ভিক আধুনিক যুগে তিল নেগেটিভিটির ছায়া থেকে বেড়িয়ে, ‘বিউটি স্পট’ নামে বিখ্যাত হয়ে উঠল। সিন্ডি ক্রুফোর্ড, স্কারলেট জনসনরা হয়ে উঠলেন সে ধারণা ও বাণিজ্যিকীকরণের জোরালো মুখ।
জাপানি ইডো যুগে আবার মুখের তিল ছিল ক্ষুধামুক্তির আশ্বাস, কানের তিলে ধনবান হয়ে ওঠার ভাগ্য। নেটিভ আমেরিকান উপজাতিতে নতুন গজিয়ে ওঠা তিল হল মৃত্যুর সতর্কতা, কিন্তু জন্মগত তিল– পৃথিবীর পবিত্র দান। আফ্রিকান ঐতিহ্যে তিল চিরকালই পূর্বপুরুষের আত্মাদের কারসাজি, তা সে পয়া হোক বা অপয়া। যেমন আফ্রিকান ঐতিহ্যে নাকের বাঁ-দিকে তিল থাকাকে ঘোরতর অপয়া মনে করা হয়, কারণ, তা ডেকে আনে অনন্ত জীবন সংগ্রাম আর দুঃখ।
……………………
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার.ইন
……………………
কাকতালীয় বিষয় হল, এই ধারণা কিন্তু নেলসন ম্যান্ডেলা জন্মানোর কয়েক হাজার বছর আগে থেকেই প্রচলিত। ম্যান্ডেলার নাকের বাঁ-দিকের তিলটা সাক্ষ্য বহন করে তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামের। কিন্তু তারপরের বিজয়রথের তোড়ে হয়তো কোথাও ফিকে হয়ে গিয়েছে কয়েক হাজার বছরের এই আফ্রিকান সংস্কার। ম্যান্ডেলার লড়াইয়ের ফসল আসলে এমন সুদিন হয়ে এসেছে সকল সংগ্রামী আফ্রিকানকে জীবনে যেখানে অন্ধকারকে দু’-টুকরো করে ওরা সূর্য ছিঁড়ে আনতে শিখেছে। সেখানে পুরুষাকারই শেষ কথা। পয়া-অপয়ার ধারণারও সেখানে, তিল ধারণের জায়গা নেই।
……………..অপয়ার ছন্দ অন্যান্য পর্ব……………..
পর্ব ১৭। অন্ধবিশ্বাস মাথাচাড়া দিলে ‘অপয়া’ হয় মাথায় হাত
পর্ব ১৬। চুল তার কবেকার অন্ধকার অপয়ার নিশান
পর্ব ১৫। যে আত্মীয়তার ডাককে অপয়া বলে বিকৃত করেছে মানুষ
পর্ব ১৪। অকারণে খোলা ছাতায় ভেঙে পড়েছে পাবলিক প্লেসে চুমু না-খাওয়ার অলিখিত আইন
পর্ব ১৩। দলবদলু নেতার মতো ধূমকেতু ছুটে চলে অনবরত
পর্ব ১২। কখনও ভয়ংকর, কখনও পবিত্র: দাঁড়কাক নিয়ে দোদুল্যমান চিন্তা!
পর্ব ১১। শুধু একটা হ্যাঁচ্চো– বলে দেবে কীভাবে বাঁচছ
পর্ব ১০। অপয়ার ছেলে কাঁচকলা পেলে
পর্ব ৯। চোখের নাচন– কখনও কমেডি, কখনও ট্র্যাজেডি!
পর্ব ৮। জুতো উল্টো অবস্থায় আবিষ্কার হলে অনেক বাড়িতেই রক্ষে নেই!
পর্ব ৭। জগৎ-সংসার অন্ধ করা ভালোবাসার ম্যাজিক অপয়া কেন হবে!
পর্ব ৬। প্রেম সেই ম্যাজিক, যেখানে পিছুডাক অপয়া নয়
পর্ব ৫। ডানা ভাঙা একটি শালিখ হৃদয়ের দাবি রাখো
পর্ব ৪। জন্মগত দুর্দশা যাদের নিত্যসঙ্গী, ভাঙা আয়নায় ভাগ্যবদল তাদের কাছে বিলাসিতা
পর্ব ৩। পশ্চিম যা বলে বলুক, আমাদের দেশে ১৩ কিন্তু মৃত্যু নয়, বরং জীবনের কথা বলে
পর্ব ২। শনি ঠাকুর কি মেহনতি জনতার দেবতা?
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved