বিদায় পুজারা। যে সময় বলা হচ্ছিল টেস্ট ক্রিকেটকে গিলে নেবে টি-টোয়েন্টি, যে সময় আইপিএলে কোটি কোটি টাকার নিলাম, সে সময়– সেই দুরন্ত ঘূর্ণির হু হু সময়ে, শুধুমাত্র টেস্ট ক্রিকেটে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন চেতেশ্বর পুজারা। নিজেরই মুদ্রাদোষে আলাদা হয়েছিলেন। দ্রাবিড়ের সময়ে, দ্রাবিড় শুধু একক ছিলেন না। কিন্তু পুজারার সময়ে, টেস্ট ক্রিকেট দু’দণ্ড শান্তি পেতে তাঁরই মুখোমুখি বসেছিল নিশ্চিত।
লাইমলাইটের ঝাকানাকা আলো নেই! প্রচারের আলো থেকে প্রায় মাইলখানেক দূরে বসবাস করতেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের এক ক্রিকেটার। ওহ হো, এখন কি ‘ক্রিকেটার’ বলা যাবে বিধিমতো? তিনি ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন ক্রিকেটার।
আদতে তিনি যেন মধ্যবিত্ত পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান। কেউ খোঁজখবর রাখে না। পারিবারিক আলোচনা বা সমালোচনা– কোনও ক্ষেত্রেই নাম ওঠে না ওঁর। কিন্তু দিনের শেষে ক্রিজে ওঁর টিকে থাকার ভরসাতেই সংসারটা চলছে। কিন্তু দরকার ফুরলে ওঁকে আমরা প্রত্যেকে ভুলতে শিখেছি। ওঁর থাকাটা আমরা টের পাইনি, আদতে উপলব্ধিই করতে পারিনি। ওঁর থেকে যেটা শেখার ছিল, সেটা শিখে উঠতে উঠতেই ও চলে গেল। মা কেন ওকে বেশি ভালোবাসত, আজ যেন ওঁর চলে যাওয়াতে আমি ঠারেঠোরে টের পাচ্ছি। মা কেন আমাকে বারবার ওঁর মতো হতে বলত, সেটা যেন চোখের সামনে স্ক্রিন-প্লে হচ্ছে! বহুবার বহু বড় ম্যাচ জেতার পরেও একেবারে আবেগহীন, চোয়াল শক্ত। যেন আগুনে আবহাওয়ায় বরফের মতো শীতল। আসলে ক্রিকেটার পুজারা যেন আমরা প্রত্যেকে। পরিবারের সমস্ত খরচ চালানো একমাত্র সন্তান! একের পর এক চোট সহ্য করে ক্রিজে পড়ে থেকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে রান নেওয়া। পারছি না, কিন্তু পারতেই হবে এই বিশ্বাসে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখা। চোয়াল চেপে সব যন্ত্রণা সহ্য করা! ঠিক যেন মাসের শেষ সপ্তাহে আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবার। মাসমাইনে হয়নি, খরচে কুলোচ্ছে না। তবু রান নিতেই হবে। ক্রিজ ছাড়লেই যে আমাদের পরিবার থেকে শুরু ভারতীয় দল একেবারে ধরাশায়ী। ক্রিজ ছাড়লেই নিমেষে শেষ সব!
নীরবে টেস্ট ক্রিকেট থেকে সরে গেলেন পুজারা। গুটিকয়েক ক্রিকেটপ্রেমী জানলেন! নীরবে চলে গেলেন। কিন্তু এরকম তো একেবারেই হওয়ার কথা ছিল না। বেশ ঢাক-ঢোল পিটিয়ে, মানুষ জানিয়ে যাওয়ার কথা ছিল তো এর’ম বড় মানের ক্রিকেটারের। কিন্তু ওই যে বললাম, প্রচারের আলো থেকে মাইলখানে দূরে বাস এই ক্রিকেটারের,আমাদের মধ্যবিত্ত ঘরের ওই ছোট ছেলেটার। যেভাবে টেস্ট ক্রিকেট খেলে এসেছিলেন, ঠিক সেইভাবেই অবসর নিলেন চেতেশ্বর। নীরবে কিন্তু কোথাও একটা শূন্যতা গ্রাসের অনুভূতি তৈরি করে। পুজারার চলে যাওয়ায় যেন কোনও এক দলা পাকিয়ে যাওয়া কান্না গলার কাছে ভিড় করে আসে ক্রিকেটপ্রেমীদের। না সেটা গেলা সম্ভব, না সেটা বের করা সম্ভব।
রাহুল দ্রাবিড়ের পরে যাঁকে ‘দ্য ওয়াল’ বলা হচ্ছিল ভারতীয় ক্রিকেটে, তিনি রবিবার সবরকম ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। ক্রিকেট মাঠে নেমে বরাবর নিজের সেরাটা দিয়েছেন এই ক্রিকেটার। ৩৭ বছর বয়সি পুজারা ১০৩ টেস্টে ১৯টি শতরান ও ৩৫টি অর্ধশতরান-সহ করেছেন ৭১৯৫ রান। গড় ৪৩.৬০। সর্বোচ্চ অপরাজিত ২০৬। অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে পাঁচটি করে টেস্ট শতরান আছে পুজারার। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে, অস্ট্রেলিয়ার মাঠে পুজারার লড়াই ভারতকে টেস্ট সিরিজ জিততে সাহায্য করেছিলেন।
পুজারার কথা উঠলে আমাদের মনে পড়ে যায়, ২০২১ সালের গাবার মাঠে সেই ইনিংস! সেই ইনিংসে ধুলো, মাটি মাখা পুজারার শুধু ক্রিজে পড়ে থাকা ছিল। যেখানে একের পর ভারতীয় ক্রিকেটার বলের আঘাতে, ক্রিজ ছাড়তে রীতিমতো বাধ্য। সেখানে প্রতিপক্ষের বাঘা বাঘা বোলারের ক্রমাগত বাউন্সারের আঘাত সহ্য করে দলকে জয় এনে দিতে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন পুজারা। সেদিন পুজারা যেন সাহস, অনড় মনোভাব ও নিষ্ঠা প্রচ্ছন্ন উদাহরণ। গাবা টেস্টে ক্রিজে পড়ে থেকে পুজারা যে-রকম বলের আঘাত খেয়েছিলেন শরীরে, এই লড়াই ক্রিকেট মাঠে আর হয়তো চোখে পড়বে না। যেন এক যোদ্ধা তলোয়ারের একাধিক আঘাত সহ্য করে যুদ্ধক্ষেত্রে বুক চিতিয়ে নিজের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। সেদিন, ২১১ বল খেলে ৫৬ রান করেছিলেন পুজারা। তবে গল্পটা রান আর বলের পরিসংখ্যানের নয়। আসলে গল্পটা ক্রিকেটেরই নয়। গল্পটা হল এক যোদ্ধার হার-না-মানা মানসিকতার!
ক্রিকেট মানে যে শুধুই ছক্কা-চারের ঝলক নয়। ক্রিকেট মানে ধৈর্য, বিশ্বাস আর অবিচল লড়াই। সেই পাঠই পড়াতেন পুজারা। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সেদিন প্রতিটা বলকে যেন বুক দিয়ে আগলে রেখেছিল।বলের আঘাতে হওয়া এক-একটা জখম যেন সযত্নে এখনও নিজের কাছে তুলে রেখেছেন। পুজারা মানে ধৈর্য। পুজারা মানে বিশ্বাস। পুজারা মানে প্রাণপাত লড়াই!
পুজারার অবসরে বঞ্চনার গল্পও বারবার উঠে আসছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তরফ থেকেই বলা হচ্ছিল, দল থেকে বাদ পড়ার ফলে ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ ধীরে ধীরে হারাচ্ছেন পুজারা! সংবাদমাধ্যম মারফত আরও জানা গিয়েছিল, সৌরাষ্ট্রের হয়ে আগামী মরশুমে রঞ্জি খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন পুজারা। কিন্তু তার মধ্যেই আসন্ন দলীপ ট্রফির দল থেকে খানিকটা গায়ের জোরেই বাদ দিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। সেখান থেকেই কি নিজের ভবিষ্যৎ ক্রিকেট অধ্যায়ের অবসানের সংকেত পেয়েছিলেন পুজারা? বুঝে গিয়েছিলেন, তাঁকে আর চাইছে না জাতীয় দল? ভালো পারফর্ম করলেও দিনের শেষে তিনি ব্রাত্যই থেকে যাবেন জাতীয় দলের স্কোয়াড থেকে? প্রশ্নগুলো থেকেই যাবে। কারণ, উত্তরের ঝুলি নিয়ে ২২ গজ থেকে প্রস্থান ঘটালেন পুজারা।
‘পুজ্জি’ ক্রিকেট থেকে বিদায় নিলেও, হয়ে থাকবেন হিমশীতল মানসিকতার এক অনন্য প্রতীক। টি-টোয়েন্টির এই যুগে তাঁর শান্ত, পরিমিত ব্যাটিং এবং অবিচল হয়ে থাকা, প্রত্যেক ক্রিকেটপ্রেমীর হৃদয়ে গেঁথে থাকবে আজীবন।
………………….
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার.ইন
………………….
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved