Robbar

আমার মূর্তির অনতিদূরে যদি রমার একটা মূর্তি করা যায়

Published by: Robbar Digital
  • Posted:September 3, 2025 2:47 pm
  • Updated:September 3, 2025 2:47 pm  

সেদিন মধ্যরাত। টালিগঞ্জ পেরচ্ছি গাড়ি চড়ে। বাদল দিন। রাস্তার বাঁ-দিকে দেখি একখানা লোক লিফট চাইছে। ইদানীংকালে লিফট-টিফট কাউকেই চাইতে দেখি না। সকলেই অ্যাপক্যাব করে, তার ওপর মেট্রো এখন কলকাতা জুড়ে দিয়েছে। এদিকে লোকখানার জামাকাপড়ও আদ্যিকালের– ধুতি-পাঞ্জাবি। ‘ড্রাইভার দাঁড়াও, দেখি ভদ্রলোক কোথায় যান।’ গেট খুলতেই, মাস্ক পরা সেই ভদ্রলোক– ‘অধমের নাম খানিক পরে বলছি, আপনার সঙ্গে খানিক সওয়ার করা যায়?’ গলাটা চেনা, মানে ‘ডাহা চেনা’। পিছনে তাকিয়ে দেখলাম টালিগঞ্জ মোড়ের ওপর উত্তমকুমারের মূর্তিখানা হাপিস! ফলে আপত্তির প্রশ্নও ওঠে না।

অরিঞ্জয় বোস

২৬.

–চিনতে যখন পেরেই গেছেন, মাস্কটা খুলেই ফেলি।
–অবশ্যই! কী সৌভাগ্য আমার! কিন্তু একটা কথা বলুন, রোজ এইরকম নিশিরাত বাঁকাচাঁদ আকাশে দেখতে বেরোন? নাকি জন্মদিন স্পেশাল, তাই ‘পৃথিবী আমারে চায়’ বলে বেরলেন?
–এসব টপ সিক্রেট ভাই, ওপেন সিক্রেট না যে বলে দেব! তারপর কোন রাতে মৃত্যুর পরও উত্তমকুমার কার বাড়ি যাচ্ছে, সেসব নিয়ে খবর করবে মিডিয়া! আজকাল যা হয়েছে।

মহানায়ক

–আজকাল হয়েছে মানে! আগে ছিল না? আপনাদের ‘উল্টোরথ’, ‘প্রসাদ’ আরও কী কী সব পত্রিকা সমস্ত সিনেমারই খবরাখবর ছাপত? ফিল্মের লোকজনের ব্যক্তিগত জিনিসও তো লোকে জানতে চায়। আর আপনি তো মহানায়ক! আপনার প্রতি ইন্টারেস্ট বেশি থাকবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।
–সে তো মশাই, অনেকেই অনেক কিছু জানতে চায়। জানার কি কোনও শেষ আছে! শুনুন, উল্টোরথ-প্রসাদ– এরা ক্লিকবেট করত না। এই ‘গভীর রাতে সুপ্রিয়া দেবীকে কী বলেছিলেন উত্তমকুমার, জানলে বিস্মিত হবেন’– এইরকম হেডলাইন হত না। লিংক খুলে দেখা যাবে, হয়তো একগ্লাস জল চেয়েছিলাম।
–আপনি তো দেখছি বেশ টেক-ফ্রেন্ডলি। কিন্তু ফোন-টোন নেই নিশ্চয়ই। নইলে অ্যাপ-ক্যাব না করে সরাসরি লিফট?
–না না, ওই ফোনে মাথা গুঁজে থাকার মানে হয় না। এই ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম কোভিডের সময় চষে ফেলেছি। কলকাতায় যা অবাঙালি ড্রাইভার, তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কলকাতা ঘুরতে ভালো লাগে না, তাই লিফট!
–তাহলে আপনিও বলছেন, কলকাতায় বাংলা বলা চাপ?
–চাপ-ফাপ কিস্যু না, বাঙালি বড় মিনমিনে। একটু গলা তুলে কথা বললে দেখবেন, গড়গড়িয়ে বাংলা বলছে সবাই।
–তা ঠিকই। কিন্তু ফেসবুক-ইন্সটাগ্রাম জানলেন কীভাবে?
–সাইবার ক্যাফে কালচারের কথা ভুলে গেছেন বোধহয়। তখনও ক্যাফে কালচার শুরু হয়নি এমন। তখনও বাড়িতে বাড়িতে ইন্টারনেট থাকত না। এখনও খুঁজলে দু’-চারটে সাইবার ক্যাফে মেলে। ফাঁকা থাকে। কোভিডের সময় আরও ফাঁকা ছিল। হাফ শাটার দেওয়া।

মহানায়কোচিত

–কিন্তু আপনি দিনের বেলায় বেরতেন? ভাবমূর্তি ছেড়ে?
–তখন কে দেখতে যাচ্ছিল? রাস্তাঘাটই তো ফাঁকা।
–বুঝেছি। আর আপনার তো মৃত্যুভয়, রোগজ্বালার প্রশ্নই নেই। এমনিই অমর!
–তা নেই। তবে মাঝেসাঝে ভিজলে জ্বরজ্বর লাগে।
–তা আজকের কলকাতা কেমন লাগছে?
–বদলেছে। সক্কলে খুব ব্যস্ত। সময়-টময় নেই কারও। আমার সিনেমা-টিনেমা কেউ দেখে আজকাল?
–বলেন কী! এখনও সকলে ‘গুরু, গুরু’ করে চেঁচিয়ে ওঠে।
–সকলে আর কই! আমি কি জানি না ভেবেছেন, মোটের ওপর সবাই এখন ওই ছোট্ট ফোনে সিনেমা দেখে। একসঙ্গে সিনেমা দ্যাখা ব্যাপারটা বোধহয় নেই!
–একেবারে যে গিয়েছে, কিছুই নেই বাকি, এরকম না কিন্তু। আপনি স্পেশাল। এখনও মা-কাকিমা-জেঠিমারা উত্তমকুমার বলতে অজ্ঞান।
–অ। আর আজকের ছেলেমেয়েরা? জেন-জি না কি হয়েছে একটা?
–আপনি এসবও জানেন গুরু?
–পায়ের তলায় বসে একটা লোক রোজ কাগজ পড়ে। তারপর ফেলে রেখে চলে যায়। আমার তো প্রিন্ট পড়া অভ্যাস।
–এই না হলে উত্তমকুমার! আচ্ছা, সিনেমা দেখতে গিয়েছেন ছদ্মবেশে?
–গিয়েছি বইকি। যে ইন্ডাস্ট্রি আমাকে বানাল, তার কাজ দেখব না?
–তা কীরকম দেখলেন?
–বড় বেশি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।
–মানে?
–মানে সিনেমা করলে সিনেমা করো, এত শ্রদ্ধার কী আছে? পরিচালক, নায়ক, অভিনেত্রী– তাঁদের সিনেমা বানানো থেকে ওঁদের জীবন, বারবার দেখানো। আসলে এ-ও ওই ক্লিকবেটই। বিখ্যাত লোকজনদের ধরো, তাঁদের শ্রদ্ধার নামে লোক টানো। এসবে কিস্যু হয় না। এই ছবিগুলো তৈরি না হলে কি লোকে শ্রদ্ধা করবে না? নাকি মনে রাখবে না?
–কিন্তু দেখতে তো ভালোই লাগে।
–সে তো রিল দেখতেও আপনার ভালো লাগে। যা ভালো লাগে দেখতে, তাই কি সিনেমা?
–আচ্ছা, আচ্ছা, বুঝেছি। তা সিনেমা দেখলেন কোথায়?
–একখানা ঝাঁ-চকচকে মলে। আরেকখানা সিঙ্গল স্ক্রিনে।
–ইয়ে, একটা প্রশ্ন করব? মনে করবেন না তো কিছু?
–মনে করার থাকলে আলবাত করব। কিন্তু তা সত্ত্বেও, এই ঝড়বাদলায় তো নেমে যেতে পারব না, ফলে করেই ফেলুন।
–মানে, টিকিট কাটলেন কী করে?
–এ প্রশ্নটা তো সাইবার ক্যাফের ব্যবহারের সময় করলেন না।
–হ্যাঁ, মানে তখনও আসলে বিস্ময় কাটেনি!
–শুনুন মশাই, আমার নামে কলকাতায় এখনও বেশ কিছু দোকানপাট আছে। সে সেলুন বলুন, জামাকাপড়ের দোকান বলুন বা মুদির দোকান। কপিরাইট বলে তো একটা বস্তু আছে। মাঝেসাঝে ইচ্ছে হলে আমি ঠিক কায়দা করে…
–ওরেব্বাস! আচ্ছা, আপনি আজকের অভিনেতা হলে ‘রাজনীতি’ করতেন?
–না। নেভার। আমি তো সৌমিত্রকে বলেছিলাম জনসমক্ষে বেশি আসতে না। পর্দার লোকের মধ্যে একটা ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ব্যাপার আছে। আমি যাই হই, জনপ্রতিনিধি হতাম না।


–কলকাতায় রাস্তা এখনও চেনেন?
–খুব চিনি না, তবে ভুলে যাইনি। রাস্তাগুলো এত বদলেছে, যে, বুঝেই উঠতে পারি না। তবে আগের মতো ঝাঁকুনি নেই অত, এ ভালো ব্যাপার। কিন্তু জল জমলে কলকাতায় এখনও সাঁতার প্রতিযোগিতা হতে পারে!
–আর এবারে যা হচ্ছে! বৃষ্টি, বৃষ্টি আর বৃষ্টি!
–পরের হপ্তায় একজোড়া রুমাল রেখে যাবেন তো। সর্দি-টর্দি লাগলে। নায়কের নাক দিয়ে সর্দি গড়াচ্ছে, এসব লোকে দেখুক একেবারে চাই না।
–অবশ্যই অবশ্যই। আপনি আমার কাছে চেয়েছেন, এটাই তো পুরস্কার। কোন ব্র্যান্ড দিই?
–ব্র্যান্ড না। পারলে পাড়ার খাদির দোকান থেকে কিনবেন।
–তা বেশ। আচ্ছা, এই যে লোকে মেট্রোতে একটা উত্তমকুমার দিন বলে, আপনার কেমন লাগে?
–খারাপ লাগে না। নামটা তো রোজ লোকে শুনছে। কিন্তু রমার নামে কলকাতায় কোনও মেট্রো স্টেশন নেই। এমনকী, কোনও মহিলার নামেই নেই, ভেবে দেখেছ?


–তাই তো!
–সুচিত্রার কথা মনে পড়ে আপনার খুব?
–তা পড়ে। ওরকম সব ছবি। সংলাপ। তাকানো। মনে না পড়ে উপায় আছে? শুনুন, এইবার আমি নামব।
–সে কী! নেমে যাবেন! এত জলদি!
–হ্যাঁ, তাড়া আছে।
–ওহ, কিন্তু কীসের, মানে যদি বলতে আপত্তি না থাকে…
–বার্থডে পার্টি মশাই। ঠিক কোথায় তা তো বলা যাবে না।


–ওহ! বেশ বেশ। সে ঠিক আছে, কিন্তু জন্মশতবর্ষে, কী গিফট চান মানুষের কাছে, বলে যাবেন না?
–গিফট? আমার মূর্তির অনতিদূরে যদি রমার একটা মূর্তি করা যায়, দেখুন।
–এসব যদি লিখি, সাক্ষাৎকার আকারে? আপত্তি আছে আপনার?
–তা আপত্তি নেই। কিন্তু ভুলে যাবেন না তো?
–মনে, রেখে দেব।

………………………

ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার.ইন

………………………