Robbar

দেশভাগের পরও কলকাতা থেকে পুজোর ছুটিতে বানারীপাড়া এসেছিলেন শঙ্খ ঘোষ

Published by: Robbar Digital
  • Posted:September 5, 2025 8:05 pm
  • Updated:September 5, 2025 8:19 pm  

মানবজীবনের যে বয়সটা সবারই পক্ষে সবচেয়ে গ্রহণের, সবচেয়ে সঞ্চয়ের, সবচেয়ে সংলগ্নতার সময়– ঠিক সেই সময়কালটা কাটিয়েছেন পাকশীতে। তাই কখনও পাকশীকে ভুলতে পারেননি শঙ্খ ঘোষ। পাকশী এসেছে তার গদ্যে, ছড়ায়, কবিতায়। বানারীপাড়া ও পাকশী ছিল তাঁর মনপ্রাণ জুড়ে। শঙ্খ ঘোষের শৈশব-কৈশোরের প্রতিচ্ছবি পাই তাঁর লেখা আত্মজীবনীমূলক ত্রয়ী উপন্যাস ‘সকালবেলার আলো’, ‘সুপুরিবনের সারি’ এবং ‘শহরপথের ধুলো’ বইতে।

কামরুল হাসান মিথুন

১৬.

কবির শৈশবের শয্যা বাংলার নদীবক্ষে। মেঘনা নদীর কূলের চাঁদপুর শঙ্খ ঘোষের জন্মভূমি। সন্ধ্যা নদীর কূলে বানারীপাড়ায় পিতৃপিতামহের ভিটে। কীর্তনখোলা নদীর ধারে বরিশাল শহরে লালিত হয়েছেন জীবনের প্রথম সাড়ে তিন বছর বয়স পর্যন্ত। আর গোটা স্কুলজীবন কেটেছে পদ্মানদীর পারে হার্ডিং ব্রিজ সংলগ্ন পাকশী নামের এক আশ্চর্য রেলকলোনিতে। ১৫ বছর বয়সের পর থেকে জীবনের বাকি সময় কেটেছে গঙ্গার কূলে কলকাতা শহরে। বাংলার নদীকে ঘিরে শঙ্খ ঘোষের জীবন-যাপন অথবা কবিকে ঘিরে ছিল বাংলার নদ-নদী, খাল-বিল, জল, জঙ্গল ও জীবন।

শঙ্খ ঘোষের প্রথম শহর— পাকশী

পদ্মাপাড়ের রেল শহর পাকশী। রাজশাহী বিভাগের পাবনা জেলার অন্তর্গত ঈশ্বরদী উপজেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিয়ন পাকশী। এই পাকশী বিখ্যাত হার্ডিং ব্রিজের জন্য। লোকমুখে নাম বদলে হয়েছে ‘হার্ডিঞ্জ ব্রিজ’। অবিভক্ত বাংলার পাবনা ও নদীয়া জেলার মধ্যে বিস্তৃত পদ্মা নদীবক্ষে সংযুক্ত এই রেল সেতু। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে এই সেতু উদ্বোধন করা হয়। বর্তমানে সেতুর একদিকে ঈশ্বরদীর পাকশী অপরদিকে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলা। এটি বাংলাদেশের বৃহত্তম রেল সেতু।

পাকশীর হার্ডিং ব্রিজ। নীচে পদ্মা নদী

পাকশীর শতবর্ষী স্কুলের নাম ‘চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ’। এই স্কুল থেকে কবি শঙ্খ ঘোষ ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন ১৯৪৭ সালে। সাত থেকে পনেরো বছর বয়স পর্যন্ত পদ্মাপারের এই ছোট্ট মফসসলেই কেটেছে কবি শঙ্খ ঘোষের জীবন। পাকশীর বাসাবাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব ছিল ২ মিনিটের পথ। তবুও ক্লাস সিক্সের আগে স্কুলে ভর্তি করানো হয়নি শঙ্খ ঘোষকে। পাকশী রেলওয়ে কর্মকর্তা সমাজসেবক ও শিক্ষানুরাগী জগীন্দ্রচন্দ্র দাশগুপ্ত তাঁর মা চন্দ্রপ্রভা দেবীর নামে ১৯২৪ সালে ‘চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ’ প্রতিষ্ঠা করেন। আর এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন শঙ্খ ঘোষের পিতা মণীন্দ্রকুমার ঘোষ। এবং বড় ভাই সত্যপ্রিয় ঘোষ সংসারের কথা ভেবে পাকশী রেলওয়ে কোম্পানিতে ‘কনিষ্ঠ কেরানি’র কাজ নিয়েছিলেন।

শঙ্খ ঘোষের প্রথম স্কুল— চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ

মানবজীবনের যে বয়সটা সবারই পক্ষে সবচেয়ে গ্রহণের, সবচেয়ে সঞ্চয়ের, সবচেয়ে সংলগ্নতার সময়– ঠিক সেই সময়কালটা কাটিয়েছেন পাকশীতে। তাই কখনও পাকশীকে ভুলতে পারেননি শঙ্খ ঘোষ। পাকশী এসেছে তার গদ্যে, ছড়ায়, কবিতায়। বানারীপাড়া ও পাকশী ছিল তাঁর মনপ্রাণ জুড়ে। শঙ্খ ঘোষের শৈশব-কৈশোরের প্রতিচ্ছবি পাই তাঁর লেখা আত্মজীবনীমূলক ত্রয়ী উপন্যাস ‘সকালবেলার আলো’, ‘সুপুরিবনের সারি’ এবং ‘শহরপথের ধুলো’ বইতে।

শঙ্খ ঘোষের দেশের বাড়ি— সন্ধ্যা নদীর কূলে বানারীপাড়া

শঙ্খ ঘোষের ‘সবার দেশই সবার ভালো’ নামক ছড়ায় পাকশী এসেছে সেরা শহর হিসেবে–

‘যতই হাসো, যে যাই বলো, লিখে তো রাখছি:
দুনিয়ার যে সেরা শহর– সেই হলো পাকশি।
অবশ্য ঠিক শহরও নয়, একটু একটু গ্রাম
গ্রাম-শহরের সেই দোটানায় প্রণতি রাখলাম।’

শঙ্খ ঘোষের জন্ম ১৯৩২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মাতুলালয়, চাঁদপুর জেলা। মা অমলাবালা। মাতামহ কুলচন্দ্র বসু।

মণীন্দ্রকুমার-অমলাবালার সন্তান যথাক্রমে অপর্ণা গুহ রায় (অশ্রু), সত্যপ্রিয় ঘোষ (কল্যাণ), স্বস্তি দত্ত, চিত্তপ্রিয় ঘোষ (শঙ্খ), নিত্যপ্রিয় ঘোষ (অসীম), শাশ্বতী বসু (দীপ্তি), ভারতী রায় (খুকু) ও কৃত্যপ্রিয় ঘোষ (অভ্র)। এই পরিবারের প্রায় সকলেরই জন্মস্থান চাঁদপুর এবং বরিশাল। বৃহৎ এই পরিবারের তিনজন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ লেখক। ভাষা-বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষক মণীন্দ্রকুমার ঘোষ। কথা-সাহিত্যিক সত্যপ্রিয় ঘোষ। বাংলা গদ্য-পদ্যে যিনি তুলনারহিত, তিনি কবি শঙ্খ ঘোষ।

বানারীপাড়া পাবলিক লাইব্রেরি। পুজোর ছুটিতে বাড়িতে এসে এই লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে পড়তেন শঙ্খ ঘোষ
লাইব্রেরির পাশেই কুমুদ বিহারী গুহ ঠাকুরতার স্মৃতি স্তম্ভ

মণীন্দ্রকুমার ঘোষ (১৮৯৮-’৮৯) ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন কি না, জানা নেই। তবে ঈশ্বরের জায়গায় বসিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অশ্বিনীকুমার দত্তকে। সমগ্র জীবন কাটিয়েছেন শিক্ষক হিসেবে। শিক্ষক জীবন বেছে নিয়েছিলেন স্বপ্নের স্বদেশ গড়ার ব্রত হিসেবে। পিতা সূর্যকুমার ঘোষ ছিলেন পুলিশের দারোগা। দেশভাগের আগে পরে এপার-ওপার– দুই বাংলার বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। আঠাশ বছর বয়সে চব্বিশ পরগনা জেলার মহেশতলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর বরিশালের গৌরনদী উপজেলার ‘চন্দ্রহার কৈলাশ চন্দ্র রমেশ চন্দ্র’ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এই স্কুলের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত অবস্থায় সরকার আইন অমান্য করে, সমাজের প্রথা ভেঙে নারী শিক্ষার জন্য দ্বার উন্মোচন করেন। তৎকালীন সময়ে ১২ বছর বয়স পর্যন্ত মেয়েদের সহ-শিক্ষা (কো-এডুকেশন) সরকার স্বীকৃত ছিল কিন্তু মণীন্দ্রকুমার ঘোষ সতেরো-আঠারো বয়সের মেয়েদের জন্য বিদ্যালয়ের দরজা খুলে দেন। ১৯৩৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে মণীন্দ্রকুমার ঘোষ পাকশীর রেল-কলোনির চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালের শেষের দিকে কলকাতার বেনেপুকুর বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষকের পদ গ্রহণ করেন।

শঙ্খ ঘোষের পৈতৃক ভিটা। আগের বাড়িটি বিলীন হয়েছে বাংলাদেশ হওয়ার পর। নতুন এই বাড়ির মালিক গোলাম সারোয়ার

শঙ্খ ঘোষ ও তাঁদের বিশাল পরিবার– প্রতি বছর গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে যেতেন মামাবাড়ি চাঁদপুর। শঙ্খ ঘোষের বড় মামা পেশায় ছিলেন ডাক্তার। শরৎকালীন ছুটিতে যেতেন দেশের বাড়ি। দেশভাগের পর কলকাতা থেকেও পুজোর ছুটিতে এসেছিলেন দেশের বাড়ি বানারীপাড়ায়।

শঙ্খ ঘোষের পিতা মণীন্দ্রকুমার ঘোষ এই স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। ছবির ভাঙা ভবনটি স্কুল শুরুর সময়ের। বর্তমানে পাশে নতুন ভবন উঠেছে

বরিশালের ইতিহাসে বানরীপাড়া– একটি অবিস্মরণীয় নাম। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এই গ্রামের বেলতলা মাঠে একবার জনসভা করেছিলেন। বর্তমানে বেলতলা মাঠে একুশের ভাষা শহিদদের স্মরণে শহিদ মিনার নির্মিত হয়েছে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ইংরেজি ১৯৩৪ সালে দার্জিলিং-এ লেবং নামক স্থানে তদানীন্তন গভর্নর অ্যান্ডারসনকে হত্যা করতে গিয়ে ১৬ বছর বয়সের যে যুবক ফাঁসির মঞ্চে জীবন বিসর্জন দেয় সে, এই গাঁয়েরই ছেলে বিপ্লবী ভবানীপ্রসাদ ভট্টাচার্য। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী শহিদ হন তিনি এই বানারীপাড়ার সন্তান জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা।

শঙ্খ ঘোষের বাড়ির দুর্গা মন্দির। দেশভাগের পর কয়েক বছর এই মন্দিরে ঘণ্টা বেজেছে। ঘটা করে পুজো হয়েছে। এরপর গত কয়েক দশক ধরে প্রকৃতি ও উদ্বাস্তু মানুষের আশ্রয় হয়েছে এই মন্দির। মন্দিরের গায়ে লেখা আছে— ঘোষের বাড়ির দূর্গা মন্দির, স্থাপিত ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দ

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বানারীপাড়ার প্রায় ৯৬ জন বিপ্লবী রাজনৈতিক নেতা কারাবরণ করেছেন। বানারীপাড়া ‘বিপ্লবী অনুশীলন সমিতি’, ‘বিপ্লবী যুগান্তর পার্টি’, ‘বিপ্লবী স্বদেশী কর্মী (কংগ্রেস)’ ও ‘কমিউনিস্ট পার্টি’-সহ অন্যান্য দলের কর্মী সংখ্যা আরও প্রায় ৮০ জনের মতো। এটা বাংলার একটা গ্রামের রাজনৈতিক সচেতনার সচিত্র দলিল। যাদের ত্যাগে ইংরেজের বিদায় ঘণ্টা বাজে, ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। এদের প্রত্যেকেরই পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা ইতিহাস লিপিবদ্ধ রয়েছে ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে বরিশাল’ গ্রন্থে। এত কিছুর পর যখন স্বাধীনতা এল তখন নিজেদের গ্রাম, নিজের দেশ ছেড়ে চলে যেতে হলো বীভৎস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যারা জয়ী হলেন তাঁরা হেরে গেলেন ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পর কাছে। সঙ্গে হারাতে হল চোদ্দোপুরুষের ভিটামাটি, আত্মার আত্মীয়, বন্ধু, স্বজন।

বানারীপাড়ার দ্বিতীয় সহমরণ সমাধি মঠ। ঘোষ বাড়ির পথের পাশে, দুর্গা মন্দিরের পিছনে অবস্থিত এই মঠ। স্থাপিত হয় ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে। শঙ্খ ঘোষের বাড়ির আদি পুরুষ ধর্মনারায়াণ ঘোষের মৃত্যু হলে তাঁর স্ত্রী হেমলতা ঘোষ মৃত স্বামীর অগ্নিতে আত্মাহুতি দেন। তাঁদের স্মৃতিতে এই মঠ

বানারীপাড়া যদি মধ্যমণি হয় তবে তার উত্তরে– চাখার ও গৌরনদী। পশ্চিম– বাইশরি, ইলুহার ও নাজিরপুর। দক্ষিণে– আলতা, আটঘর ও স্বরূপকাঠি। পূর্বে– কাঁচাবালিয়া, উজিরপুর ও ঝালকাঠি। খাল–বিশারকান্দি। বন্দর– হুলার হাট। প্রধান নদী– সন্ধ্যা ও স্বরূপকাঠি।

বিরাট গুহ বংশের অনেক কৃতি লোক জন্মেছেন এই বানারীপাড়ায়। এই গ্রামে গুহ ঠাকুরতা, গুহ বিশ্বাস, এবং গুহ রায়– এই তিন উপাধিধারী গুহ বংশীয়দের বাস ছিল। বানারীপাড়ার তিনভাগ গুহদের বসবাস। আর একভাগে বাকিরা। বানারীপাড়া, নরোত্তমপুর এবং পাশের গাভা গ্রামজুড়ে বসবাস ছিল ঘোষ ও ঘোষ দস্তিদার বংশের। আলতা গ্রামে ছিল শিক্ষিত ব্রাহ্মণদের বসবাস। বাইশারি, মাছরং, খলিসাকোটায় ছিল হাট-বাজার ও গণ্যমান্য লোকের বাসস্থান। দত্তপাড়ায় ছিল সাহা জমিদারগণের বাসস্থান। শিক্ষার জন্য ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে বানারীপাড়া ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশন স্থাপিত হয় এবং একটি লাইব্রেরি।

একসময় বানারীপাড়াকে কেন্দ্র করে চারটি বন্দর ছিল– চাউলাকাট, বসুরহাট, নন্দারায়ের হাট ও বানারীপাড়া। দেশভাগের ফলে আজ এই গ্রামের ‘আদি বাসিন্দা’ বলতে তেমন কেউই নেই। সবাই চলে গিয়েছেন বা চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন নিজ ভূমি ছেড়ে। কিন্তু অল্প কয়েক পরিবার মাটি আঁকড়ে রয়ে গিয়েছেন। সেইসব পরিবারের প্রবীণ সদস্যরা আগের বানারীপাড়াকে চোখের মণিতে রেখেছেন। কেউ গিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলে পুরনো কথা বলতে গেলে চোখের জল গড়িয়ে সন্ধ্যা নদীতে মিলায়।

একদিন দ্যাশের বাড়ির খোঁজে কবি শঙ্খ ঘোষের বাড়ি খুঁজতে গেলাম বানারীপাড়া। ঢাকা শহর থেকে সড়কপথে চার ঘণ্টার দূরত্ব। বাইন্যাবাড়ির পবিত্র দত্ত, গুহ বাড়ির অনুপ গুহঠাকুরতা এবং ইলুহার স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেন মানিক– তাঁদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় খুঁজে পেলাম শঙ্খ ঘোষের বাড়ির ভিটা। বানারীপাড়ার মানুষ শঙ্খ ঘোষের বাড়ি অথবা ‘দারোগো বাড়ি’ হিসেবেই চেনেন। শঙ্খ ঘোষের পিতামহ পুলিশের দারাগো ছিলেন, পিতা মণীন্দ্রকুমার ঘোষ নামকরা শিক্ষক ছিলেন আর শঙ্খ ঘোষ– এই তিনজনের জন্য সকলের দৃষ্টিসীমায় রয়েছে কবির বাড়ির ভিটা। আগের দোতলা বাড়িটি এখন নেই। বাড়িটি বেদখলে বিলীন হয়েছে। সেখানে নতুন মালিকের একতলা ভবন হয়েছে। কিন্তু পাশে রয়েছে ঘোষ বাড়ির দুর্গা মন্দির ও সহমরণ সমাধি মঠ।

কবি শঙ্খ ঘোষ ১৯৪৬ সালের দুর্গাপুজোর ছুটিতে এসেছিলেন বানারীপাড়া। সেই সময় পাকশী থেকে বানারীপাড়া আসতে সময় লাগত দু’দিনের মতো। প্রথমে ট্রেন, স্টিমার এরপর নৌকায় দেশের বাড়ি। পুজোর পর ফিরে গেলেন পাকশী তার পরের বছর ছেড়ে গেলেন পদ্মাপাড়। শেষবারের পুজোর পর দেশের বাড়ি থেকে ফিরে যাওয়ার বর্ণনা পাই শঙ্খ ঘোষের লেখা ‘বাড়ি যাওয়ার দিন’ নামক একটি স্মৃতিচারণমূলক রচনায়– ‘‘…নৌকো এসে ঘাটে লাগে একদিন। গুছোনো হতে থাকে বাক্সবিছানা। অনেক অগ্রিম কাঁদতে শুরু করেন দাদু। সময় হয়ে এলে ঠাকুমা বলেন: ‘বইস্যা পড়, বইস্যা পড়, লগ্ন হৈয়া গেল যাত্রার।’ বসে পড়ি আমরা একজন একজন করে পিঁড়ির ওপর, সামনে একটা কলসভরা জল আর আমের পল্লব। মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে নিয়ে সেই জলে নিজের মুখ দেখে মনে মনে বলতে হবে ‘আবার আসব’, উঠে আসতে হবে আসন ছেড়ে, তারপর বেরিয়ে আসতে হবে দালান থেকে সিঁড়িতে, খালের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখার নিয়ম নেই আর, ডাইনে শুধু দেখে নেওয়া যায় আধফাঁকা মণ্ডপের কাঠামো। ডাইনে বাঁয়ে মাথা হেলিয়ে বসে আছে লক্ষ্মী সরস্বতী, আরও সামনে পুকুরের ধারে এসে ভাসছে বিসর্জিত প্রতিমার খড়পুঞ্জের অবশেষ, খালপাড়ে ধুতির খুঁট গায়ে জড়িয়ে বসে আছেন দাদু, কাদা বাঁচিয়ে তক্তার ওপর দিয়ে নৌকোয় উঠে আসছি আমরা, শেষ মুহূর্তে ঠাকুমা তুলে দিচ্ছেন তেঁতুল সুপুরি নারকোলের পুঁটুলি কয়েকটা, লগি বার করছে মাঝি, বদর বদর ডাক দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে নৌকো, একটু একটু দূরে সরে যাচ্ছে পাড়, সরে যাচ্ছে বাড়ি, সরে যাচ্ছে পুজোর দিনগুলি, ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছেন দাদু, ছইয়ের গায়ে ঠেসান দিয়ে আরা কজন দাঁড়িয়ে আছি নিথর, খাল ছেড়ে নদীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে নৌকো, আর আমরা শুনতে শুরু করেছি সামনের বছরে বাড়ি আসার আর কতদিন আছে বাকি।’’

ছবি: কামরুল হাসান মিথুন

দ্যাশের বাড়ি-র অন্যান্য পর্ব …

পর্ব ১৪পাবনার হলে জীবনের প্রথম সিনেমা দেখেছিলেন সুচিত্রা সেন

পর্ব ১৩নদীমাতৃক দেশকে শরীরে বহন করেছিলেন বলেই নীরদচন্দ্র চৌধুরী আমৃত্যু সজীব ছিলেন

পর্ব ১২: শচীন দেববর্মনের সংগীত শিক্ষার শুরু হয়েছিল কুমিল্লার বাড়ি থেকেই

পর্ব ১১বাহান্ন বছর পর ফিরে তপন রায়চৌধুরী খুঁজেছিলেন শৈশবের কীর্তনখোলাকে

পর্ব ১০: মৃণাল সেনের ফরিদপুরের বাড়িতে নেতাজির নিয়মিত যাতায়াত থেকেই তাঁর রাজনৈতিক চিন্তার জীবন শুরু

পর্ব ৯: শেষবার বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার আগে জানলায় নিজের আঁকা দুটো ছবি সেঁটে দিয়েছিলেন গণেশ হালুই

পর্ব ৮: শীর্ষেন্দুর শৈশবের ভিটেবাড়ি ‘দূরবীন’ ছাড়াও দেখা যায়

পর্ব ৭: হাতে লেখা বা ছাপা ‘প্রগতি’র ঠিকানাই ছিল বুদ্ধদেব বসুর পুরানা পল্টনের বাড়ি

পর্ব ৬ : জীবনের কালি-কলম-তুলিতে জিন্দাবাহারের পোর্ট্রেট এঁকেছিলেন পরিতোষ সেন

পর্ব ৫ : কলাতিয়ার প্রবীণরা এখনও নবেন্দু ঘোষকে ‘উকিল বাড়ির মুকুল’ হিসেবেই চেনেন

পর্ব ৪ : পুকুর আর বাঁধানো ঘাটই প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের দেশের বাড়ির একমাত্র অবশিষ্ট স্মৃতিচিহ্ন

পর্ব ৩ : ‘আরতি দাস’কে দেশভাগ নাম দিয়েছিল ‘মিস শেফালি’

পর্ব ২: সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় শৈশবের স্মৃতির নন্দা দিঘি চিরতরে হারিয়ে গেছে হাজীগঞ্জ থেকে

পর্ব ১: যোগেন চৌধুরীর প্রথম দিকের ছবিতে যে মাছ-গাছ-মুখ– তা বাংলাদেশের ভিটেমাটির