কত বাড়ির গল্প রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে। কর্ণাটকের কারোয়ার বা লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড হিথের বাড়ির কথা কি কম গুরুত্বপূর্ণ? আর কলকাতা শান্তিনিকেতন বা অন্যান্য মফস্সলের বাইরে এখনকার বাংলাদেশের বাড়িগুলি? শিলাইদহ, পতিসর, সাজাদপুর বা পদ্মাবোটে বসবাস যে এক অন্য দিগন্ত খুলে দিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের মনে এবং সৃষ্টিতে তা আমরা জানি।
১.
‘নীড়’ বললেই শিক্ষিত বাঙালির অমোঘভাবে মনে পড়ে, জীবননানন্দের একটি পঙ্ক্তি: ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।’ পদ্ম বা পলাশ নিদেনপক্ষে চেরা পটলের সঙ্গেও নায়িকার চোখের তুলনা করে সাহিত্যিকরা অভ্যস্ত। কিন্তু পাখির বাসা! নায়িকার চোখ তেমন দেখতে হলে কেমন হবে? বোঝাই যায় নীড়ের আকৃতি নয়, নীড়ের মধ্যে আশ্রয়ের যে ব্যঞ্জনা, তাই কবি এখানে ধরতে চেয়েছেন।
‘পান্থপাখির রিক্ত কুলায় বনের গোপন ডালে’-র মতো প্রেমের গানে বা ‘প্রান্তিক’-এর কবিতায় ‘কুলায়’ শব্দটি বারেবারেই ঘুরে ঘুরে আসে। ‘কল্পনা’-র ‘স্বপ্ন’ কবিতায় শুধু বাসা অর্থে নয় সম্পূর্ণ মনটিই যেন কুলায়প্রত্যাশী পাখি হয়ে ওঠে। মিলনের মুহূর্তটি ঘন হয়ে আসে–
নাহি জানি কখন কি ছলে
সুকোমল হাতখানি লুকাইল আসি
আমার দক্ষিণ করে কুলায়প্রত্যাশী
সন্ধ্যার পাখির মতো, মুখখানি তার
নতবৃন্তপদ্মসম এ বক্ষে আমার
নমিয়া পড়িল ধীরে, ব্যাকুল উদাস
নিঃশব্দে মিলিল আসি নিশ্বাসে নিশ্বাস।
তাঁর কাছে নীড়, বাসা, কুলায়– আশ্রয়ব্যঞ্জক সব শব্দের ক্ষেত্রেই তিনি ছোট বাড়ির কথা বলেছেন। আশ্রয়ের ব্যঞ্জনা সেখানে স্পষ্ট।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ভাগ্য তাঁর জন্ম, মৃত্যু ও জীবনের অনেকখানি অতিবাহিত হয়েছে এক বিরাট বাড়িতে। এখন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি বললে যে বাড়ির চেহারা আমাদের চোখে ভাসে, তা আসলে মূল বাড়ির অর্ধেকটা। দ্বারকানাথের বৈঠকখানা বাড়ি বা পাঁচ নম্বর দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনের বাড়ি এখন নেই। সে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে রবীন্দ্রভারতীর নতুন বাড়ি। রবীন্দ্রনাথের জন্য দেবেন্দ্রনাথ মূল বাড়ির সংলগ্ন জায়গায় ‘বিচিত্রা’ বাড়ি তৈরি করিয়েছেন। সে বাড়ি অপেক্ষাকৃত নতুন। রবীন্দ্রনাথের ছোটবেলায় জোড়াসাঁকো বলতে যা বোঝাত তাতে ‘বিচিত্রা’র অংশটি ছিল না কিন্তু পাঁচ আর ছয় নম্বর মিলিয়ে যে বিরাট আয়োজন তার কথা রবীন্দ্রনাথের ছোটবেলা-সংক্রান্ত লেখাগুলিতে অনেকখানি ধরা পড়েছে। কেমন করে তাঁর ছোটবেলায় শহর পুরোপুরি গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি, জোড়াসাঁকোর গোলাঘর আর চণ্ডীমণ্ডপ ইত্যাদি নামের মধ্যে কেমন গ্রামের রেশ রয়ে গিয়েছে, তা নিয়ে কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ ‘জীবনস্মৃতি’ আর ‘ছেলেবেলা’ বইয়ে।
জোড়াসাঁকো বাড়ির নাটক গান বা সাহিত্যের আয়োজনের কথা ফলাও করে বললেও জোড়াসাঁকো বাড়ি যে বালক রবির কাছে শুধুই আনন্দের উৎস ছিল না, তা ‘জীবনস্মৃতি’ বা ‘ছেলেবেলা’ পড়লে বোঝা যায়। ভৃত্য তাঁকে গণ্ডি কেটে এক জায়গায় বসিয়ে রাখত, তা আমরা জানি। আসলে জোড়াসাঁকোর শৈশব রবীন্দ্রনাথের পক্ষে একরকম বন্দিদশাই বটে। জানলা দিয়ে পুকুর পাড়ে মানুষের আনাগোনা, জলে ডুব দেওয়া বা ডালপালা ছড়ানো বটগাছ তাঁকে বাইরের জগতের খবর দিত। অসুস্থ অমল যেমন নিজে এক জায়গায় চুপটি করে থেকে বাইরের আঁচ পেত, এই উপেক্ষিত বালকটির ছোটবেলাও যেন সেইরকম অনেকটা আটকে ছিল জানালার ফ্রেমে। সেইজন্যেই পেনেটি বা চন্দননগরে গঙ্গার ধারের দিনগুলি তাঁর কাছে, তাঁর লেখায় এতখানি উজ্জ্বল।
সারা জীবন বহু ঘুরেছেন রবীন্দ্রনাথ। থেকেছেন বহু বাড়িতে। দুই বাংলায়, তার বাইরে এবং বিদেশে। কিন্তু কোনটি ঠিক তাঁর বাড়ি? যে জোড়াসাঁকোয় তাঁর জীবনের এতখানি কাটল সেখানেও আর প্রৌঢ় অবস্থায় থাকতে ভালোবাসতেন না তিনি। এমনকী, এ বাড়ির কর্তা দেবেন্দ্রনাথও শেষ জীবনে কলকাতা শহরে অন্য বাড়িতে থেকেছেন। কলকাতায় গিয়েছেন অথচ জোড়াসাঁকোয় থাকেননি– এমন ঘটনা রবীন্দ্রজীবনে উত্তরকালে বহুবার ঘটেছে। অনেক সময়ই থেকেছেন প্রশান্তচন্দ্র-নির্মলকুমারী মহলানবীশের আলিপুরের মিটিওরলজিক্যাল অফিসের বাসভবনে বা বরানগরের শশিভূষণ ভিলা বাড়িতে। তাঁদের নতুন বাড়ির নাম ‘আম্রপালি’ দিলেও রবীন্দ্রনাথের আর সে বাড়িতে থাকা হয়নি। যৌথ পরিবারে বহু মানুষের বাস এবং বহু রকমের জীবনযাত্রা তাঁকে স্বস্তি দিত না বলেই, দেবেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর জোড়াসাঁকোর বাড়ির মায়া তাঁর কেটে গিয়েছিল। রথীন্দ্রনাথ বলেছেন যে, মহর্ষি তাঁর প্রতিভাবান ছোট পুত্রের প্রতি একটু বিশেষ পক্ষপাতিত্ব ছিল বলে বাড়ির সবচেয়ে ‘ভালো ভালো ঘর’ রবীন্দ্রনাথের জন্য বরাদ্দ হত।
অনেকের মতো রথীন্দ্রনাথও লিখেছেন, ‘বাবা কিন্তু এক বাড়িতে বেশি দিন থাকা একেবারে পছন্দ করতেন না, ঘন ঘন বাসা বদলাতেন। শান্তিনিকেতনে এমন দশ-বিশটা বাড়ি আছে যেখানে কোনো-না-কোনো সময়ে বাবা থেকেছেন।’ আক্ষরিক অর্থে, শান্তিনিকেতনে ২০টি বাড়িতে না থাকলেও রবীন্দ্রনাথ থেকেছেন এমন খানদশেক বাড়ির হদিশ পাওয়া কঠিন নয়। এই বাড়িবদলের অভ্যাস শুধু বাড়ির ভালোমন্দর বিচারে নয় অবশ্যই। যে অতৃপ্তি আর অস্থিরতা নিয়ে তিনি সাহিত্য-শিল্পের বিভিন্ন প্রকরণ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, যেমন অতৃপ্তি তাঁর কবিতা বা নাটকের বহু বহু পাঠ তৈরি করার ক্ষেত্রে কাজ করেছে; তাই চালনা করেছে বাসাবদল করতে। বহুদিন তিনি থেকেছেন পূর্বপুরুষদের তৈরি করা বাড়িতে, কখনও অতিথি হয়েছেন আত্মীয়-বন্ধু বা ছাত্র-ভক্তদের। অন্যত্র তো বটেই, শান্তিনিকেতনেও। কিন্তু ক্রমশ তিনি বাস করতে শুরু করেছেন তাঁর নিজের পরিকল্পনা, নিজের স্বপ্ন দিয়ে তৈরি বাড়িতে। কিছুটা পুরনো হয়ে গেলে আবার ঠাঁইবদল করেছেন। নতুনের এই আকাঙ্ক্ষা রবীন্দ্রনাথের কোনও শৌখিনতা মাত্র নয়, এ তাঁর স্বভাবের এক তাগিদ। ‘অন্য কোথা, অন্য কোনখানে’– শুধু কাব্যকথা নয়; এ এক তাড়নাও বটে।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে রবীন্দ্রনাথ প্রথম মুক্তি পেয়েছিলেন পেনেটিতে। ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ থেকে বাঁচতে ১৮৭২ সালে পেনেটির বাগানবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন ঠাকুরবাড়ির সকলে। গঙ্গার ধারে বসবাসের দিনগুলিকে ‘সোনালি পাড় দেওয়া’ চিঠির মতো মনে হত, বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু সেখানে গঙ্গার তীর আর বাড়ির উঠোন ছিল গুরুত্বপূর্ণ। আগে ছিলেন খাঁচায়, এখন যেন বসেছেন দাঁড়ে, ‘পায়ের শিকল কাটিল না।’ সেই হাওয়া-বদলের চেয়ে অনেক গুরুত্ব দিয়ে বর্ণনা দিয়েছেন উপনয়নের পরের ভ্রমণকে।
প্রথমে কলকাতা থেকে ট্রেনে প্রথমে বোলপুরে বসবাস। বোলপুরের শান্তিনিকেতন বাড়ি তখন একতলা। ব্রাহ্মমন্দিরও নির্মাণ হয়নি। তারপর অমৃতসর। আর তারপর হিমালয়। এই ভ্রমণের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ডালহৌসি পাহাড়ের বক্রোটা বাসের দিনগুলি। দেবেন্দ্রনাথের সংস্পর্শ এতটা নিবিড় করে রবীন্দ্রনাথ বোধহয় এমনটা কখনও পাননি। এই বাড়িটি এখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সম্পত্তি। দেবেন্দ্রনাথের কোনও কাগজপত্রে এ বাড়িটির হদিশ নেই। বাড়িটি ভাড়াবাড়ি ছিল বলেই মনে হয়। দেবেন্দ্রনাথ ১৩ বছরের বালকটিকে পাহাড়ে জঙ্গলে একা ঘুরে বেড়াতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। এখনও সে বাড়ির আশপাশে পাইন গাছের জঙ্গল। পাকদণ্ডী বেয়ে উঠতে হয়। ডালহৌসি শহরের বাইরে লোকালয় থেকে দূরে এই আস্তানা, আমরা যখন গিয়েছি সেই ২০০৭ সালেও। ১৮৭৩-এ যে এ অঞ্চল আরও নিবিড় অরণ্যে ঘোরা, জনমানবশূন্য ছিল, তা বোঝাই যায়। রবীন্দ্রনাথের হাতের লাঠিটি (পূর্ণবয়স্ক মানুষের চেয়ে মাপে একটু ছোট) এখনও যত্ন করে রাখা আছে সেই বাড়িতে। হয়তো ইতিহাসের পাথুরে প্রমাণ নয়, হয়তো এই লাঠিটির পিছনে গল্পগাছাই সত্যি, তবু লাঠিটি দেখে রোমাঞ্চ হয়। কেলুবনে ঘেরা এ বাড়িটির যে বর্ণনা রবীন্দ্রনাথ ‘জীবনস্মৃতি’তে দিয়েছেন, তা এখনও একইরকম। ঘরের পাশে রয়েছে সেইরকম কাচের জানালা। রবীন্দ্রনাথ একটেরে সেই ঘরটির থেকে ‘নক্ষত্রলোকের অস্পষ্টতায়’ পর্বতচূড়ার পাণ্ডুরবর্ণ তুষারদীপ্তি দেখতেন। দেখতেন গায়ে লাল শাল দিয়ে রাতে দেবেন্দ্রনাথ হাতে বাতি নিয়ে উপাসনায় চলেছেন। এখানেই রবীন্দ্রনাথকে আকাশ আর গ্রহ তারা জ্যোতিষ্কর প্রাথমিক পাঠ দিয়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথ।
এই বাড়িটি ঘিরে যেমন অপার্থিব এক জগৎ রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ, তেমনই, রাজকীয় পরিবেশ রচনা করেছেন আহমেদাবাদের শাহিবাগের বাড়ি ঘিরে। প্রথমবার বিলেত যাওয়ার আগে থাকা সত্যেন্দ্রনাথের শাহিবাগের বাড়িটিকে অমর করে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ‘জীবনস্মৃতি’ আর ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পে। শাহজাহানের আমলের মুঘল প্রাসাদ, যার আর এক নাম মোতি শাহ মহল শাহজাহানের তৈরি। শাহজাহান রাজা হওয়ার আগে যখন তিনি খুররম, তখনকার প্রাসাদ এটি। প্রাসাদটি এখন আর নির্জন এলাকায় নেই। সামনে দিয়ে সবরমতীর ধারা যদিও বহমান। রবীন্দ্রনাথের নামে একটি ঘর এখনও রক্ষা করা হয়েছে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল মিউজিয়ামে। এ বাড়ির লাইব্রেরিতে রবীন্দ্রনাথের নানা বইয়ের পাঠ আর একা রাত্রে ছাদে পদচারণ করতে করতে গান রচনার কথা কে ভুলতে পারে!
এমন কত বাড়ির গল্প রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে। কর্ণাটকের কারোয়ার বা লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড হিথের বাড়ির কথাও কি কম গুরুত্বপূর্ণ? আর কলকাতা শান্তিনিকেতন বা অন্যান্য মফস্সলের বাইরে এখনকার বাংলাদেশের বাড়িগুলি? শিলাইদহ, পতিসর, সাজাদপুর বা পদ্মাবোটে বসবাস যে এক অন্য দিগন্ত খুলে দিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের মনে এবং সৃষ্টিতে তা আমরা জানি। শান্তিনিকেতনের বাড়িগুলির আগে আমরা পরের কিস্তিতে সেই বাড়িগুলির কথা একবার শুনে নেব।
আলোকচিত্র: অধ্যাপক অভ্র বসু
বিশেষ কৃতজ্ঞতা: ডা. অরূপরতন বসু
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved