নারী নিরাপত্তার সূচকে কলকাতার অবস্থান নেমে যাওয়া আসলে কোনও হঠাৎ দুর্ঘটনা নয়। এটা এক দীর্ঘ ইতিহাসের ফল। সেই ইতিহাসের ভেতরে কোথাও নেই লিঙ্গ-যৌন প্রান্তিক মানুষদের অদৃশ্য ক্ষত, নেই দলিত-বহুজান-আদিবাসী শ্রমজীবী নারীদের অব্যক্ত লড়াই। অবস্থান নামছে– এ কেবল পরিসংখ্যান নয়, এক আয়না। রাষ্ট্রের নীরবতা, সমাজের দ্বিচারিতা, মিডিয়ার বাছাই করা সহমর্মিতা– সব মিলেই এই শহর প্রতিদিন জানিয়ে দেয়, এখানে নিরাপত্তা কোনও অধিকার নয়, বরং এক অলীক প্রতিশ্রুতি।
সম্প্রতি প্রকাশিত জাতীয় রিপোর্ট NARI-2025 আবারও এক অস্বস্তিকর সত্য সামনে এনেছে। দেশের ৩১টি শহরের প্রায় ১৩ হাজার নারীর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তৈরি এই সূচক বলছে– ভারতের মানচিত্রে কোথাও কোথাও নারীর চলাফেরা কিছুটা নিরাপদ হলেও, বহু শহরে তাদের প্রতিদিনের জীবন ভয়ে আচ্ছন্ন। এই সমীক্ষায় ধরা পড়েছে রাস্তাঘাটের আলো থেকে শুরু করে গণ-পরিবহণের ভিড়, কর্মক্ষেত্রে হেনস্থার সম্ভাবনা, পুলিশের প্রতি অনাস্থা কিংবা পারিপারর্শ্বিক পরিবেশ– সবকিছু মিলে নারীরা আসলে নিজেদের শহরকে কতটা নিরাপদ ভাবে? শহরভেদে এই পার্থক্য আরও তীব্র। কোহিমা, ভুবনেশ্বর, বিশাখাপত্তনম, আইজল, গ্যাংটক, ইটানগর কিংবা মুম্বই তুলনামূলকভাবে নিরাপত্তার তালিকার ওপরে। আর অন্য প্রান্তে– কলকাতা, দিল্লি, পাটনা, জয়পুর, ফরিদাবাদ, শ্রীনগর ও রাঁচি নেমে গেছে তলানিতে।
কলকাতার নারী নিরাপত্তা সূচকে পিছিয়ে পড়াটা আমাকে অবাক করে না। এই শহরে বহুদিন ধরেই নারীর শরীরকে প্রতিদিনের অবমাননার মধ্যে ডুবিয়ে রাখা হয়েছে– কুমন্তব্য, ছোঁয়া, শিস, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি– সব মিলিয়ে এক অদৃশ্য ঘেরাটোপকে আমরা ধীরে ধীরে ‘স্বাভাবিক’ বলে মানতে শিখেছি। ২০১২-র পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ মামলা দেখিয়েছিল, অপরাধী শুধু রাস্তায় নয়– রাষ্ট্র ও সমাজের ভেতরেও লুকিয়ে থাকে। তার পরের বছর, ২০১৩-র কামদুনিতে এক কলেজছাত্রী অপহরণ, ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হলেন; ২০১৪-র হাড়ুয়ায় আরেক তরুণীর ক্ষেত্রে একই নৃশংসতার পুনরাবৃত্তি শহরকে আর চমকায়নি। ২০১৫-র রানাঘাটে ৭১ বছরের এক সন্ন্যাসিনী ধর্ষিত হলেন– আন্তর্জাতিক ক্ষোভ উঠল, কিন্তু স্থানীয় বাস্তবতা তেমন বদলাল না। আর সাম্প্রতিক ২০২৪-এ, আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে এক তরুণ জুনিয়র ডাক্তারকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হল– শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো ‘নিরাপদ’ জায়গাগুলিও যে আর নিরাপদ নেই, তা নির্মমভাবে সামনে এল। এই সব ঘটনার যোগফলই সূচকের পতন; আর এটাকে কেবল পরিসংখ্যান বলে পড়া ভুল– এ এক ইতিহাসের স্তর, যেখানে প্রতিটি ধর্ষণ, প্রতিটি হত্যা বলে যায়: এই শহরে নারীর নিরাপত্তা নেই, আর রাষ্ট্র সেই সত্যকে আড়াল করতে ব্যস্ত।
যখন কোনও সূচক বা রিপোর্ট ‘নারী নিরাপত্তা’-র কথা বলে, তখন সেই ‘নারী’ আসলে কে? উত্তরটা আমরা জানি– যাদের লিঙ্গ জন্ম থেকেই সঙ্গায়িত, যারা সমাজ-স্বীকৃত লিঙ্গের আওতায়, শহুরে, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত নারী। এই ছাঁচের ভেতরে থাকলে তবেই তুমি গণনা হও, তবেই তোমার ভয়কে রাষ্ট্র স্বীকার করে। কিন্তু এই গণ্ডির বাইরে? রূপান্তরকামী নারী, সমকামী নারী, ননবাইনারি AFAB মানুষ (অর্থাৎ যাদের জন্মের সময় নারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল), AFAB রূপান্তরকামী পুরুষ— তাদের শরীরও এই শহরের রাস্তায় অপমানের শিকার হয়। রূপান্তরকামী নারীদের ওপর প্রকাশ্য হামলা বা যৌন নির্যাতন খবর হয় খুব কম; আর হলেও, তা হয়ে ওঠে কৌতূহলের খোরাক (voyeuristic )–মর্যাদার জায়গা থেকে নয়। AFAB রূপান্তরকামী পুরুষেরা আবার বহন করেন দু’ধরনের ভার– তাদের শরীরকে ‘নারী’ বলে টার্গেট করা হয়, আবার তার পরিচয়কে মানা হয় না; তাই মিসজেন্ডারিং, যৌন নির্যাতন, ট্রান্সফোবিয়া– সব একসঙ্গে কাজ করে। এবং শুধু লিঙ্গ-যৌন প্রান্তিক নয়– দলিত, বহুজন, আদিবাসী, শ্রমজীবী নারীরা? তাদের জীবনে যৌন নির্যাতন প্রায়শই ব্রাহ্মণ্যবাদ, শ্রেণি-ক্ষমতা ও পুরুষতন্ত্রের জোটবদ্ধ শাস্তি। শহর থেকে দূরে, গ্রামে বা মফসসলের যৌন হেনস্তার অসংখ্য ঘটনা শহরের স্মৃতি থেকে দ্রুত মুছে যায়– কারণ তারা গরিব, প্রান্তিক, দৃশ্যমান ক্ষমতার পরিসরে নেই।
এখানে আসল প্রশ্নটা দাঁড়ায়– কোন অপরাধগুলো ‘যোগ্য অপরাধ’ বলে ধরা হয়? কাকে সমাজ বা গণমাধ্যম বা সমাজমাধ্যম ‘বিশ্বাসযোগ্য নির্যাতিত’ বলে মানে? জাত, বর্ণ, ধর্ম, পোশাক, সময়, ঠিকানা, ভাষা, ত্বকের রং, পেশা– এসব মিলিয়ে যেন এক তালিকা তৈরি হয়: কে ‘সহানুভূতি’র যোগ্য, আর কে নয়। শহুরে ‘শালীন’ তরুণী হলে প্রতিবাদ তোলার লাইসেন্স মেলে; কিন্তু তুমি যদি দরিদ্র হও, হও ভিন্ন ধর্মের, দলিত/আদিবাসী হও, যৌনকর্মে যুক্ত হও, অথবা লিঙ্গ-যৌন প্রান্তিক হও– তবে তোমার ওপর নির্যাতন প্রকাশ্যে আসার আগেই সন্দেহের খাঁচায় বন্দি হয়ে যায়। যে নারী নিজের শরীর-কণ্ঠস্বরের মালিকানা দাবি করে, অথবা যৌনকর্মে যুক্ত– তিনি কি কখনও ‘’নির্যাতিত’ বলে গণ্য হন? রাষ্ট্রের চোখে তার শরীর অধিকার হারায়।
তাই প্রশ্নটা আরও ধারালো– কতগুলো নারী হিংসার অপরাধ আমাদের ইতিহাসে স্থান পায়, আর কতগুলো চিৎকার অন্ধকারেই ডুবে যায়? ওপরে যেক’টি ধর্ষণের ঘটনার উল্লেখ করলাম, সেগুলো শুধুমাত্র ‘খবর’ হয়েছিল বলে জানি, আরও কতগুলো যে আমরা জানি না, তার হিসেব আমাদের নেই, আন্দাজ করতেও ভয় করে। এই নীরবতাই আসল রাজনৈতিক সত্য। কারণ ‘নিরাপত্তা’ কোনও নিরপেক্ষ শব্দ নয়– এটা এক সংজ্ঞা, যা বানায় রাষ্ট্র-সমাজ-মিডিয়ার জোট। সেই সংজ্ঞা বারবার ঠিক করে দেয়– কাদের যন্ত্রণা দৃশ্যমান হবে, আর কাদের ক্ষত অদৃশ্যই থেকে যাবে।
যৌন হেনস্থা শব্দটা শুনলেই আমরা যেন একটা অভিন্ন অভিজ্ঞতা কল্পনা করি। কিন্তু সত্যি হল– এই অভিজ্ঞতা কখনও একরকম নয়। প্রতিটি নারী, প্রতিটি প্রান্তিক শরীর আলাদা আলাদা ভয়ে, আলাদা পরিবেশের আতঙ্কে থাকে। যখন আমরা ‘নিরাপত্তা’র কথা বলি, তখন শুধু অপরাধী আর ভুক্তভোগীর গল্প ভাবি। কিন্তু প্রশ্ন এটাও– শহর কি আদৌ আমাদের নিরাপত্তা দেয়?
কলকাতার রাস্তায় আলো নেই, অনেক সময় টয়লেট নেই, যাতায়াতের ভিড়ে নারীরা ঠাসাঠাসি বগিতে দাঁড়িয়ে থাকেন। সরকারি বাসে রাত বাড়লে নিরাপত্তার কোনও ব্যবস্থা থাকে না, লোকাল ট্রেনে গার্ড কামরাটুকুই শেষ আশ্রয়। এই অভাবগুলোকে আমরা অভ্যাসে পরিণত করেছি, অথচ এগুলো আসলে কাঠামোগত ব্যর্থতা। শহরের নকশা যেন শুরু থেকেই পুরুষ ও পুঁজির জন্য বানানো। রাস্তা আলোকিত হবে অফিস ফেরা কর্মীর জন্য, কিন্তু গলিগুলো অন্ধকারেই ডুবে থাকবে। মল, ক্যাফে, কর্পোরেট পার্কের ভেতর নিরাপত্তা ক্যামেরা লাগানো হবে, কিন্তু ঝুপড়িবস্তির রাস্তায় কাদাজল জমে থাকবে। আর সেই কাদাজলের ভেতর দিয়েই হাঁটেন শ্রমজীবী নারীরা, ভোরবেলা বা গভীর রাতে। এই শহর যেন এক অদৃশ্য বার্তা বারবার লিখে দেয়– তুমি উদ্বাস্তু, এই জায়গা আসলে তোমার জন্য নয়। নগর পরিকল্পনার ভেতরকার এই অদৃশ্য সহিংসতাই আসল প্রমাণ, রাষ্ট্র আর কর্পোরেট মিলে শহর বানায় পুরুষের গতিবিধির জন্য, নারীর কিংবা প্রান্তিক শরীরের নিরাপত্তার জন্য নয়।
নারী নিরাপত্তার সূচকে কলকাতার অবস্থান নেমে যাওয়া আসলে কোনও হঠাৎ দুর্ঘটনা নয়। এটা এক দীর্ঘ ইতিহাসের ফল। সেই ইতিহাসের ভেতরে কোথাও নেই লিঙ্গ-যৌন প্রান্তিক মানুষদের অদৃশ্য ক্ষত, নেই দলিত-বহুজান-আদিবাসী শ্রমজীবী নারীদের অব্যক্ত লড়াই। অবস্থান নামছে– এ কেবল পরিসংখ্যান নয়, এক আয়না। রাষ্ট্রের নীরবতা, সমাজের দ্বিচারিতা, মিডিয়ার বাছাই করা সহমর্মিতা– সব মিলেই এই শহর প্রতিদিন জানিয়ে দেয়, এখানে নিরাপত্তা কোনও অধিকার নয়, বরং এক অলীক প্রতিশ্রুতি।
আমরা যারা প্রতিদিন ভয় বয়ে বেড়াই, তারাই জানি এই ভয় চিরস্থায়ী নয়। ইতিহাসের আয়নায় শুধু আমাদের ক্ষত নয়, আমাদের প্রতিরোধও ভেসে থাকে। সংখ্যা বলে না, কিন্তু আমরা জানি– এই শহর এখনও আমাদের জন্য নয়। তবু আমরা একে বদলাব।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved