রেবা পালের জন্ম ১৯৪৭ সালে। সেদিক থেকে দেখলে এখন বয়স ৭৮ হয়ে গিয়েছে। একলা জীবন। রান্না-বান্না, বাজার-হাট সব কাজও একলাই করেন। আর প্রতিদিন সকাল থেকে নিয়ম করে রং-তুলি, পেপার নিয়ে আঁকতে বসেন। নিজের কাজ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে রেবা পাল আরও জানান, ‘এখন সারা বছরই আমাকে কাজ করতে হয়। প্রতিদিন সকালে ঘণ্টাদুয়েক করে কাজ করি। আমার মেয়েরা বলেন অতিরিক্ত কাজের প্রয়োজন নেই। কিন্তু এখানে আর কেউ চালচিত্র তৈরি করেন না। এত মানুষ দূরদূরান্ত থেকে আসেন, তাদের ভালোবাসায় এখনও এই কাজ করে যাচ্ছি। যতদিন পারব ততদিন করে যাব। আর পরবর্তী কেউ যদি শেখে, তারা এই কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবে।’
প্রচ্ছদের ছবি: প্রসূন বিশ্বাস
কেউ বলে দুর্গাচালি। কেউ বা চালচিত্র। বুঝিয়ে বলতে গেলে বলতে হয়, প্রতিমার পিছনে অর্ধচন্দ্রাকারবৃত্তে থাকা একটি চিত্র। যে চিত্রের মধ্যে শিল্পী ফুটিয়ে তোলেন পুরাণের কাহিনি বা দেবদেবীর ছবিকে। কয়েক বছর আগেও প্রবীণ শিল্পীরা এই চালচিত্রের একাধিক ভাগ বলতেন গড়গড় করে। যেমন বাংলা চালি, মঠচৌরি চালি, টানাচৌরি চালি, মার্কিনি চালি। বিভিন্ন পত্রিকা থেকে জানা যায়, নবাবি আমল থেকেই প্রতিমায় চালচিত্র ব্যবহারের কথা। পালেরাই এই শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। কখনও দুর্গা-অসুরের যুদ্ধ, কখনও হরগৌরী কখনও আবার রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা, শিব কিংবা অন্যান্য দেবদেবীর ছবি এই চালচিত্রে ফুটিয়ে তোলেন শিল্পীরা। কিন্তু এখনকার ক’জন আর এই দুর্গাচালির খোঁজ রাখেন?
থিমের ভিড়ে চালচিত্র যেন কোণঠাসা হয়ে পড়ছে ক্রমশই। এখন এই শিল্পীরই খোঁজ মেলা দায়। তবুও চালচিত্র টিকে রয়েছে কয়েকজন হাতে গোনা শিল্পীর সৌজন্যে। ভালোবেসে যাঁরা প্রতিদিন এঁকে চলেছেন শিল্পের এই ধারাকে। এই রকমই হাতেগোনা কয়েকজনের মধ্যে এই শিল্পকে আঁকড়ে জীবনযাপন করছেন কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণির বাসিন্দা বছর ৮০ ছুঁই ছুঁই রেবা পাল। একটা চালি এঁকে আর কত টাকা পান? সে কথা উল্লেখ না করাই ভালো। তবুও এই শিল্পকে ছেড়ে যাননি তিনি।
শরতের পেঁজা তুলোর মতো মেঘ আকাশে দেখেই কয়েক দিন আগে রেবা পালের বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। কলকাতা থেকে কৃষ্ণনগর লোকাল ধরে যখন পৌঁছেছি তখন বেলা পড়ে এসেছে। ঘূর্ণির রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে সুবীর পাল, তড়িৎ পালের মতো রাষ্ট্রপতি পুরস্কার-প্রাপ্ত শিল্পীর বাড়ি টপকে বিখ্যাত পুতুলপট্টিকে ডান হাতে রেখে পৌঁছে গেলাম রেবা পালের বাড়ি। এ বাড়ি যেন ছবির মতো। টালির চালের ছোট্ট একটা ঘর। সামনে দাওয়া, তারও সামনে কিছুটা অংশ উঠোন। এই দাওয়াটাই যেন অশীতিপর বৃদ্ধা শিল্পীর স্টুডিও। যে স্টুডিওর মাটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা থাকে সদ্য প্রাণ-পাওয়া চালচিত্রগুলো। কোনটার আবার কাঁচা রং। কোনও ছবিতে রং চাপেনি। রেবা পাল ‘বাবু’ হয়ে বসে চারিদিকে চালিগুলো ছড়িয়ে নিয়ে যেন সংসার পেতে বসেন রোজই।
নিয়ম করেই চালচিত্র আঁকেন তিনি। চোখে পুরু কাচের চশমা হলেও হাত এতটুকু কাঁপে না। শিবের গায়ে রং বুলোতে বুলোতে বলতে থাকেন, ‘সেই ১৬ বছর বয়সে বিয়ে করে এলাম। প্রথম প্রথম ছিলাম স্বামীর হেল্পার। রং এগিয়ে দিতাম। কখনও-বা একটু আধটু রং করতাম। তারপর ধীরে ধীরে কাজটা শিখতে শুরু করলাম। তারপর স্বামী মারা গেলেন। তাও বছর ২০ হয়ে গেল। এখন নিজেই কাজ করি। এই আঁকার সঙ্গে আমার সম্পর্কে ৬০ বছর।’
চোখের চশমা ঠিক করতে করতে হাত দেখিয়ে বলেন, ‘আমাদের বাড়ির আশপাশে আরও দশ-বারো ঘর এই কাজ করত। কিন্তু আজ আর কেউ চালচিত্র আঁকে না। পয়সা কোথায়! এখন চালচিত্র প্রয়োজন হলে মানুষ কম্পিউটার থেকে বের করে নেয়। আমাদের হাতে আঁকার আর ক’জন খোঁজ করে। তাই পরের প্রজন্মও এই কাজ করতে চায় না।’
প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হল তাহলে কীসের টানে এতগুলো বছর এই শিল্পকে আঁকড়ে আছেন? হাসতে হাসতে জবাবও দেন দ্রুত– ‘‘ওই যে স্বামী হাতে করে শিখিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর ভালোবেসে ফেললাম। আর অন্যকিছু করতে পারিনি। আর একটা কথা বলি, উনি মারা যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘এই কাজটা ছেড়ে দিও না।’ তাই আর ছাড়তে পারিনি।” রেবা পালের স্বামী ষষ্ঠী পাল ছিলেন চিত্রকর। তাঁর মৃত্যুর পর তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। এক ছেলে রয়েছে। সেও বিয়ে করে আলাদা থাকে। নিজেই জানাচ্ছেন, বৃদ্ধ বয়সেও একলা বাড়িতে থাকতে এতটুকু অসুবিধা হয় না তাঁর।
রেবা পালের জন্ম ১৯৪৭ সালে। সেদিক থেকে দেখলে এখন বয়স ৭৮ হয়ে গিয়েছে। একলা জীবন। রান্না-বান্না, বাজার-হাট সব কাজই একলা করেন। আর প্রতিদিন সকাল থেকে নিয়ম করে রং-তুলি, পেপার নিয়ে আঁকতে বসেন। নিজের কাজ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে রেবা পাল আরও জানান, ‘এখন সারা বছরই আমাকে কাজ করতে হয়। প্রতিদিন সকালে ঘণ্টাদুয়েক করে কাজ করি। আমার মেয়েরা বলেন অতিরিক্ত কাজের প্রয়োজন নেই। কিন্তু এখানে আর কেউ চালচিত্র তৈরি করেন না। এত মানুষ দূরদূরান্ত থেকে আসেন, তাদের ভালোবাসায় এখনও এই কাজ করে যাচ্ছি। যতদিন পারব ততদিন করে যাব। আর পরবর্তী কেউ যদি শেখে, তারা এই কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবে।’
আপনার চালিতে কার কার ছবি থাকে? আঁকা থামিয়ে সামনে তাকান রেবা পাল। তুলি উঁচিয়ে সামনের শিবের ছবির দেখিয়ে বলেন, ‘শিব থাকে, রাধা-কৃষ্ণ, বিভীষণ– এই রকম দেবদেবীরাই বেশি থাকে আমার ছবিতে। প্রতি বছরই কলকাতা থেকে আমার এই কাজ নিয়ে যায় কোনও না কোনও মণ্ডপ।’ একাধিক সংবর্ধনা পেয়েছেন। নিজের ওই ছোট্ট ঘরে তা রাখার জায়গা প্রায় নেই বললেই চলে। ‘এশিয়ান পেইন্টস শারদ সম্মান’ থেকেও সংবর্ধিত করা হয়েছে কয়েক বছর আগে। সেই প্রসঙ্গে বলেন, ‘এই বয়সে এসে এত মানুষের ভালোবাসা– এটাই তো বড় পাওনা।’
এই শিল্পের সঙ্গে তাঁর নাড়ির যোগ। সেটাও বছর ৬০ অতিক্রান্ত। তবুও যেন ক্লান্তি আসে না চোখেমুখে। একরাশ হাসি উপহার দিয়ে রেবা পাল বলেন, ‘কত আর দাম রাখব। খুব বেশি দাম রাখতে পারি না।’ ইদানীং বড় চালচিত্রের পাশাপাশি ছোট ছোট ছবিও আঁকছেন। শিল্পপ্রেমী মানুষরা যাতে ফ্রেমে বাঁধাই করে সেই কাজ টাঙিয়ে রাখতে পারেন ঘরের দেওয়ালে।
বছর কয়েক আগেও ট্রেনে করে কুমোরটুলিতে আসতেন চালচিত্র দিতে। কলকাতায় চালচিত্র বিক্রি করতে আসাও স্বামী ষষ্ঠী পালের হাত ধরেই। পুজোর ঠিক আগে আগে ভোরের ট্রেনে কলকাতা এসে চালচিত্র দিয়ে আবার রাতে ফিরে গিয়েছেন কৃষ্ণনগরে। স্বামীর মৃত্যু আর করোনার পর বয়সের ভারে আর আসতে পারেন না কলকাতা। তবে দুঃখ নেই, কলকাতা থেকে ইদানীং বহু শিল্পরসিক হাজির হন রেবা পালের বাড়িতে। এইরকম শরতের যে-কোনও দিনে ঘূর্ণির রেবা পালের বড়িতে গিয়ে উঁকি মারলে দেখবেন শিল্পী এক মনে দাওয়ায় বসে চালচিত্র সাজিয়ে কাজে ব্যস্ত। ভালোবাসা না থাকলে এই বয়সে এসে এভাবে একটা শিল্পকে আঁকড়ে ধরতে পারেন না কেউই।
……………………………..
রোববার.ইন-এ পড়ুন প্রসূন বিশ্বাস-এর অন্যান্য লেখা
……………………………..
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved