Robbar

এখনও ‘শিল্পীর দায়’ ফুরোয়নি, তাই বিশ্বমঞ্চে অনুপর্ণা সমালোচনামুখর

Published by: Robbar Digital
  • Posted:September 10, 2025 6:12 pm
  • Updated:September 10, 2025 7:14 pm  

অনুপর্ণা অনুরূপ চেয়েছেন তাঁর ছবি শেষ হোক আশার দোর খুলে, কোনও রাখঢাক নেই, সিউডো ইন্টেলেকচুয়ালিটির ধারপাশ মাড়াননি, বলেছেন, যদিও ছবিটি open-ended, তবু তিনি চাইবেন তাঁর গল্পের দুই মেয়ে যেন একসঙ্গেই থাকে। শুনেছিলাম আর্ট মানুষের মনের দরজা জানলাগুলো খুলে দেয়, আর্ট চর্চায় রাজনৈতিক মনন তৈরি হয়, আর্ট অদৃশ্য মাইক্রোস্কোপে চিনিয়ে দেয় সাদা-কালোর মাঝের ধূসরের পুঙ্খানুপুঙ্খ শেড। কিন্তু বুড়িয়ে যাওয়া সংসারে এসব আর মনে রাখিনি কেউ, তাই অনুপর্ণা যখন ভেনিসের প্ল্যাটফর্মকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন, আমরা চমকিত হই, উচ্ছ্বসিত হই, নিজেদের বেঁকে যাওয়া জং ধরা শিরদাঁড়াগুলো চিনতে পারি।

বিদিশা বিশ্বাস

It’s a responsibility to think for a moment, to stand beside Palestine.

‘যখনই আমি ঝুমাকে নিয়ে কথা বলি, আমাকে বলতেই হয়, ঝুমার পরিস্থিতি, পরিণতি আমার জীবন দেখাকে একটা নতুন দিশা দিয়েছে। ঝুমা আর আমি বন্ধু ছিলাম, ওই আমার ইশকুলের প্রথম বন্ধু। আমি আমার বাবাকে গিয়ে ঝুমার কথা বলি, বাবা আমাকে ওর সঙ্গে কথা বলতে বারণ করে, কারণ ঝুমা নাথ দলিত। আমি তখন ছোট, তাই কিচ্ছু না বুঝেই বাবার কথা মেনে ঝুমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিই। সেই যন্ত্রণা আমি বয়ে নিয়ে বেরিয়েছি কতকাল। ক্লাস এইটে আমি জানতে পারি ঝুমার বিয়ে, আমার তখন তেরো। পরে বাইশ বছর বয়সে আমি বুঝতে পারি, ঝুমার বিয়ে কোনও সাধারণ বিয়ে ছিল না, ব্যক্তিগত বোঝাপড়ার জায়গা থেকে সরে এসে আমি এর পিছনের রাজনীতিটা টের পাই। ওই সময় ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় সরকারের একটি প্রকল্প অনুযায়ী কোনও দলিত মেয়ের বিয়ের যোগাযোগ সম্পন্ন হলে সরকারই উদ্যোগ নিয়ে সেই বিয়ের অর্থের জোগান দেবে। আমি বুঝতে পারি আসল রাজনীতি এখানেই, ভেঙে পড়ি এটা ভেবে যে সরকার আসলে বিয়েকে সামনে রেখে ওই দলিত মেয়েটির, আরও শয়ে শয়ে দলিত মেয়ের শিক্ষার ভার নিতে অস্বীকার করেছে।’

Songs of Forgotten Trees (2025)

ভেনিসে একটি ছোট্ট ইন্টারভিউ দিতে দিতে কী অনায়াস ক্ষমতায় এই কথাগুলো উচ্চারণ করেন অনুপর্ণা। ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র ফেস্টিভালে ‘অরিজন্তি‌’ বিভাগে তাঁর ছবি ‘Songs of Forgotten Trees’ দেখানোর আগে সম্ভবত এই কথোপকথন। ইংরেজি খুব সাবলীল নয়, উচ্চারণ সাদামাটা, কোনও ডিজাইনার পোশাক নয়, একেবারে সাধারণ কালো একটি জিনস আর কালো টি-শার্ট। কথা বলতে শব্দের জোগান পেতে খানিক অসুবিধে হয়, তবু উচ্চারিত শব্দে কোনও দ্বিধা নেই! ছোটবেলায় তাঁর বাবা যে তাঁকে দলিতের সঙ্গে কথা বলতে বারণ করেন– অনুপর্ণা এত সহজে কী করে একথা বলে দেন? একটি উনত্রিশের মেয়ের এই সহজতা আসে কেমন করে, নির্ভীক বলে যেতে পারেন যে তাঁর দেশের সরকার আসলে দেশের মানুষের শিক্ষা শিকেয় তুলেছে। সামান্য ভয়টুকুও তো কণ্ঠে প্রকাশ পায় না! অনুপর্ণা কি তবে সত্যি সত্যি, সত্যি? 

Venice Film Festival Winner Anuparna Roy Stands By Gaza In Viral Speech

পুরুলিয়া। গ্রাম নারায়ণপুর। ইশকুলের প্রিয় বন্ধু ঝুমা। আজ যদি এই মেয়ে দু’টির বয়স ২৯ হয়, তবে ধরে নেওয়া যাক, এ আজ থেকে ১৫ বছর আগের কথা। ঝুমার পরিচয় ছিল, ও মেয়ে, তায় দলিত, ভারতবর্ষের আজন্ম ইতিহাসে কোনও দলিত ঝুমা কখনও কারও প্রিয় বন্ধু হতে পারেনি, এই চোখে ঘোর লাগা অন্ধকার সময়ে ঝুমা কোনও দিন প্রিয় বন্ধু হতে পারবে কি না, কোনও সুদূর কালে, তা আজও আর বলা যায় না।  

তবু থিতিয়ে ওঠা পলির মতো আর একটি মেয়ে, পুরুলিয়ার নারায়ণপুর নামের আদিবাসী গ্রামের এক কিশোরী ঝুমাকে প্রোথিত করেছেন তাঁর প্রিয় বন্ধুর আসনে, সেই শিকড় বুনেই পাড়ি দিয়েছেন ভেনিস। আকাশের শানুদেশে কোন মেদুর শৈশবের প্রিয় বন্ধুকে আগলেই যে রাখতে হয়, আর্ট চর্চার এই শিক্ষায় স্নাত অনুপর্ণা তাবড় পৃথিবীকে সাহস জুগিয়েছেন। তাঁর গল্পের দু’টি মেয়ে দু’টি পৃথক জায়গা থেকে দু’টি পৃথক যাপন পেরিয়ে একই শহরে আসেন পেটের তাগিদে, একই ছাদের নীচে বসতকালীন কীভাবে সম্পর্কের নিজস্বতা তৈরি হয়, কীভাবে নিজেরাই পরস্পরের ঘর হয়ে ওঠেন, গল্প ঘুরপাক খায় এরই কোনায় কোনায়। অনুপর্ণা ওঁর শিকড় ভোলেননি, তাঁরই সৃষ্ট চরিত্রের হাত ধরে বারবার স্মৃতি হাতড়ে ফিরেছেন। পুরনো ঘরবাড়ি, পুরনো বন্ধু, আজন্মের মতো হারিয়ে যাওয়া ছোটবেলার ঠিরঠির দিনমান মস্তিষ্কের গলি-ঘুপচি পেরিয়ে ফিরে ফিরে এসেছে তাঁর ছবিতে। 

অনুপর্ণার সিনেমার একটি দৃশ্য

অনুপর্ণা জিতে নিয়েছেন অরিজন্তি‌ বিভাগের সেরা পরিচালকের সম্মান। মঞ্চে স্মারক নিতে উঠেছেন একটি লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে, কণামাত্র বাহুল্যবর্জিত অনুপর্ণা উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে ধন্যবাদ জানিয়েছেন তাঁর ছবির সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেককে। আর বলেছেন সেই পৃথিবীর কথা, যেখানে মানুষকে পিঁপড়ে জ্ঞানে হত্যা করছে আর একদল মানুষ। অনুপর্ণার ঋজু শিরদাঁড়া তাঁকে দিয়ে গাইয়ে নেয় সেই দুর্ভাগ্য জর্জরিত, অথচ অনির্বচনীয় গীত, ‘I want to take a moment and talk about something which is very very bigger and very disastrous happening in Palestine. Every child deserves peace, freedom,  liberation and Palestine is no exception.’ সম্মিলিত করতালিতে বাধা দিয়ে অনুপর্ণা বলেন, “I don’t want any clap for this. It’s a responsibility to think for a moment, to stand beside Palestine.” ওহো হো, সাহসী মেয়ে তখনও থামেননি, “I might upset my country, but it doesn’t matter to me anymore.” চলুন, শেষ লাইনের শেষ অংশটি আর একবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক, “..it doesn’t matter to me anymore.” ভূগোল দিয়ে ভাগ করা এই গ্রহ আসলে নিটোল এক বিশ্ব, আর্টের এই আর এক শিক্ষায় উত্তীর্ণ অনুপর্ণা একটি আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে বলে ফেলতে পেরেছেন সেইসব শব্দ, যা চিহ্নিত করেছে তাঁর শিল্পের গভীরে থাকা নৈর্ব্যক্তিক মানবিক মনকে, আসলেই যা শিল্পের থেকে অনেক অনেক বড়, যাকে জীবন বলে জানা যায়। যে কথা উচ্চারণ করাই স্বাভাবিক ছিল, যে কথায় আমাদের দেশের আনাচ-কানাচ ভরে যাওয়ার কথা ছিল– প্যালেস্তাইনের গণহত্যা ও রাষ্ট্রদ্বারা তৈরি করা দুর্ভিক্ষের প্রতিবাদে, সে কথা আমরা বলিনি। এই নিরুপায় অবস্থায়, যখন কেবল প্যালেস্তাইনের কথাতেই ভরিয়ে দিতে হয় দিগ্বিদিক, যতদিন যতক্ষণ এই হত্যা বন্ধ না হয়, তখনই অনুপর্ণা আন্তর্জাতিক মঞ্চে একথা বলতে পেরেছেন। রাজনীতি থেকে পিছিয়ে থাকেননি, বরং ময়দানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে উদাত্ত ভঙ্গিতে শিল্পীর দায় স্বীকার করেছেন, নিজের দেশের সরকারের সমালোচনা করে প্রাপ্ত সম্মান উৎসর্গ করেছেন দেশেরই মানুষকে। 

82nd Venice Film Festival: In Conversation with Anuparna Roy, Director of “Songs of Forgotten Trees” – VIEW OF THE ARTS
অনুপর্ণা রায়

অনুপর্ণা বানাতে চেয়েছিলেন একটি তথ্যচিত্র। নিজেই কী মমতায় বলছেন, সেক্ষেত্রে হয়তো ঝুমাকেও খুঁজে পেতে পারতেন, সরকারি বিভিন্ন সংস্থায় ঘুরেছেন ফান্ডের জন্য, পাননি, নৈরাশ্যে ভর করেননি, জানেন, ‘স্বাভাবিক, সরকার কেন টাকা দেবে, আমি তো সরকারের বিরুদ্ধেই কথা বলব আমার তথ্যচিত্রে।’ তাই ফর্ম বদলে ফিকশনের আশ্রয়। আসলে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মের জগতের আনাচেকানাচে বহু অনুপর্ণা ঘুরে মরেন, মাথা কোটেন, বছরের পর বছর এই অনিশ্চয়তার জীবন পার করেও হারিয়ে যান কত কত অনুপর্ণা। কোন পথে হাঁটলে যে একটি ছবি নিজের মতো বানানো যাবে, ইন্ডি জগতে তার কোনও ইশারা নেই কোত্থাও। তৃতীয় বিশ্বের এই দেশে যেখানে নাগরিকের বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ, যেখানে আইনের দানবীয় ব্যবহারে বছর বছর জেলে নষ্ট হচ্ছেন এই সময়ের শ্রেষ্ঠ কয়েক মানবতাকর্মী, ট্রায়ালহীন যৌবন পোহাচ্ছেন গরাদে, সেদেশের বুকে একটি অনুপর্ণার ভেনিস পৌঁছনো আসলে স্বপ্নের মতো মনে হলেও এর প্রয়োজনীয়তা অসীম। অনুপর্ণা একজন মেয়ে, গ্রাম্য পরিবার থেকে উঠে আসা শিল্পের শ্রমিক একজন। কোনও ফিল্মস্কুল ব্যাকগ্রাউন্ড নেই, পারিবারিক উৎসাহও ছিল না তেমন, কীভাবে যেন সঠিক পথের সন্ধান পেয়ে একা মেয়ে পৌঁছে গেলেন ভেনিস। বাকি অনুপর্ণা সকল হয়তো নৈরাশ্যের জাল কেটে স্ক্রিপ্টের খাতাটি আতপ্ত জড়িয়ে ধরেছেন এতক্ষণ, আশ্চর্য এক ভালোবাসায় আরও একবার জ্বলে ওঠার চেষ্টা তাঁরা করবেনই। মনে পড়ে, জাফর পানাহির Offside ছবিটির কথা, ২০০৬-এ বানানো এই ছবিটি ইরানে banned। চার-পাঁচটি মেয়ের স্টেডিয়ামে ফুটবল দেখতে যাওয়ার চেষ্টা ছেলেদের ছদ্মবেশে। কারণ ইরানের ফুটবল মাঠে মেয়েদের প্রবেশাধিকার নেই। শেষে ধরা পড়া, খানিক সময় স্টেডিয়ামের ছাদে আটক থাকা। ছবির নানা ফার্সিকাল ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে জানা যায়, এদেরই মধ্যে একটি মেয়ের আসলে ফুটবল নিয়ে কোনও উৎসাহই নেই, ও এসেছে ওর মৃত বন্ধুর হয়ে খেলা দেখতে, যে মারা গেছে এরই আগের ম্যাচ-পরবর্তী হিংসায়। ছবির শেষে জানতে পারা যায়, খেলায় জয়ী হয়েছে ইরান, সেই আনন্দে নস্যাৎ হয় লিঙ্গের ব্যবধান, আতস্ বাজির স্ফুরিত আলোয় মিশে যায় সকল আনন্দের ছটা, ছেলে মেয়ে, আটকে রাখা সিকুউরিটি, আটক থাকা বন্দি, এমনকী পর্দার অভিনেতা এবং এপারের দর্শক। আপাদমস্তক রাজনৈতিক এই ছবি আর তার শেষ অংশের হুল্লোড় একটি আস্ত সূর্য হয়ে থাকে সিনেমার আকাশে। বুঝিয়ে দেয়, যা কিছু বিভেদ, যা কিছু হিংসা, তা আদতে ক্ষমতাসৃষ্ট। মস্তিষ্কের গ্রে ম্যাটারকে গুলিয়ে দিয়ে আমাদেরই মধ্যে এক দলকে লেলিয়ে দিয়েছে আর এক দলের পিছনে।

অনুপর্ণা অনুরূপ চেয়েছেন তাঁর ছবি শেষ হোক আশার দোর খুলে, কোনও রাখঢাক নেই, সিউডো ইন্টেলেকচুয়ালিটির ধারপাশ মাড়াননি, বলেছেন, যদিও ছবিটি open-ended, তবু তিনি চাইবেন তাঁর গল্পের দুই মেয়ে যেন একসঙ্গেই থাকে। শুনেছিলাম আর্ট মানুষের মনের দরজা জানলাগুলো খুলে দেয়, আর্ট চর্চায় রাজনৈতিক মনন তৈরি হয়, আর্ট অদৃশ্য মাইক্রোস্কোপে চিনিয়ে দেয় সাদা-কালোর মাঝের ধূসরের পুঙ্খানুপুঙ্খ শেড। কিন্তু বুড়িয়ে যাওয়া সংসারে এসব আর মনে রাখিনি কেউ, তাই অনুপর্ণা যখন ভেনিসের প্ল্যাটফর্মকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন, আমরা চমকিত হই, উচ্ছ্বসিত হই, নিজেদের বেঁকে যাওয়া জং ধরা শিরদাঁড়াগুলো চিনতে পারি। ছবির নামটি ‘Songs of Forgotten Trees’ নির্দেশ করে বিস্মৃতিকে, স্বাভাবিক বা suppressed memory, তাই তো স্মৃতির অবতারণা, হারিয়ে যাওয়া, ভুলে যাওয়া যা কিছু– মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার চরিত্রগুলি তাই ফিরে ফিরে যায় তাদের ফেলে আসা ঘরবাড়িতে,

‘May you never be able to forget,

May you go to your grave still remembering.’

(The Island of Missing Trees– Elif Shafak)

অভিনন্দন অনুপর্ণা। ঝুমা নাথ জানবেন, তিনিই শরতের কাশবনটির মতো অবিরাম আলো ছড়িয়েছেন আপনার রোজনামচায়। আর আপনার বেয়ে চলা পথে শত শত অনুপর্ণারা অনুপ্রাণিত হবেন, উদযাপিত হবেন। ঝুঁজকো আঁধারে এটুকু সম্বল করি মাত্র।