আজকের দিনে আমরা জানি, প্রতিমা ভাঙা মানে সর্বনাশ নেমে আসবে না। কিন্তু কোনও প্রতীক ভাঙা মানে যে সমাজের গল্প ভাঙা, সেটাও সত্যি। তাই মানুষ হয় বিসর্জন দেয়, নয়তো ভাঙা অংশ মেরামত করে তাকে আবার গড়ে তোলে সৌন্দর্যে। ভাঙনের ভয় থেকে সুন্দরের পূজারী ওঠা– এটাই হল মানুষের নতুন শিক্ষা। তাই আফগানিস্তানের বুদ্ধমূর্তি হোক বা ঢাকার লক্ষীনারায়ণ বিগ্রহ, ধস্ত হওয়া প্রতিমা বারবার জানান দেয়, সৌন্দর্যের শত্রুরা আজও বর্তমান। নাস্তিক মনও সায় দেয় না সেসব ইতিহাস বিকৃতিতে। কারণ, প্রকৃতি সৃষ্টির থেকেও আদিম, সুন্দরের আসল স্রষ্টা।
২১.
ঈশ্বরের ভাঙা মূর্তি নিয়ে মানুষের একটা প্রাচীন ভয় আছে। কারণ পাথর, মাটি বা কাঠ দিয়ে গড়া দেবদেবীর মূর্তিকে মানুষ কোনওদিনই নিছক শিল্পকর্ম বলে মনে করেনি। ইষ্টের ঘর বা আত্মার আধার হিসেবে ধরে নিয়ে তাকে প্রতিমা বলে ডেকেছে। শ্রীরামকৃষ্ণ তাই আরও এক ধাপ এগিয়ে বারবার আমাদের দৃষ্টি, মৃন্ময়ী মূর্তির চিন্ময়ী হয়ে ওঠার দিকে আকর্ষণ করেছেন। কিন্তু যখন সে মূর্তি ভেঙে যায় বা চির ধরে তার কলেবরে, তখন মানুষ গন্ধ পায় অমঙ্গলের। এবং এই বিশ্বাসের শিকড় এত গভীর যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম, সংস্কৃতি বা সমাজ বদলালেও ভাঙা প্রতিমায় বিকৃত সৌন্দর্যের চাইতেও বড় হয়ে ওঠে অশুভের ইঙ্গিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রথম পূজা’ কবিতায় এর ইতিহাস জীবন্ত।
প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় দেবতার প্রতিমা শুধু প্রতীক ছিল না। ভারতবর্ষের প্রাণ প্রতিষ্ঠার মতোই সেখানেও মূর্তিকে জীবন্ত করে তোলার জন্য বিশেষ অনুষ্ঠান হত। বিশ্বাস করা হত দেবতা নিজের উপস্থিতি প্রতিমায় স্থাপন করেন। একবার এই উপস্থিতি এলে মূর্তি আর কেবল জড়বস্তু থাকে না, হয়ে ওঠে দেবতার শরীর, দৈবসত্তার আধার। তাই প্রতিমা ভেঙে গেলে পুরো সমাজ আতঙ্কিত হয়ে পড়ত। পুরোহিতরা নানা মন্ত্রপাঠ আর শুদ্ধিকরণে ব্যস্ত হয়ে যেতেন, কারণ মূর্তি ভেঙে যাওয়া মানে দেবতার মহাপ্রস্থান। আর দেবতা চলে যাওয়া মানে সুসময়ের চলে যাওয়াও, যা আমন্ত্রণ জানায় শত্রু, খরা কিংবা মহামারিকে।
মিশরেও কাজ করত একই ভয়। যদিও সেখানে দেবতার সঙ্গে যুক্ত ছিল ‘কা’ নামের এক অদৃশ্য শক্তি। প্রতিমা বা ফারাও-এর মূর্তিতে এই ‘কা’ অবস্থান করত বলে ধরে নেওয়া হত। যদি কোনও কারণে মূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হত, তাহলে মনে করা হত ‘কা’-এর ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। এমনকী ‘মাৎ’ নামের এক সূক্ষ্ম নিয়ম, যা ধরে রেখেছিল মিশরীয় মহাবিশ্বকে, অকস্মাৎ মূর্তি ভাঙা জানান দিত সেই নিয়মের ভেঙে পড়ারও। তাদের বিশ্বাস ছিল, ভাঙা অংশ বের করে আনতে পারে অশুভ শক্তিকে। অনেক মিশরীয় গল্পে দেখা যায়, প্রতিমা ক্ষতিগ্রস্ত হলে নেমে আসে বিপদ, প্লেগ বা যুদ্ধে হারের মতো ঘটনা। মানুষের বিশ্বাস ছিল সে বিপদ আদতে নেমে আসেনি আকাশ চিরে। বরং চুঁয়ে চুঁয়ে বেরিয়ে এসেছে প্রতিমার ফাটল থেকে। তাই তারা আবার সারিয়ে তুলত মূর্তিকে, সাজাত রঙ দিয়ে, মন্ত্রপাঠে করত শুদ্ধ।
ভারতীয় সমাজে প্রতিমার মর্যাদা চিরকালই অটুট। প্রাণ প্রতিষ্ঠার পর প্রতিমা জীবিত হয়ে ওঠে বলে তারও প্রয়োজন পড়ে ভোগ আর শয়নের। কিন্তু যদি কোনওভাবে মূর্তিতে আসে ফাটল বা হানি হয় তার কোনও অঙ্গ, তখন সে মূর্তিকে বলা হয় ‘খণ্ডিত’। খণ্ডিত মূর্তি ঘরে বা মন্দিরে রাখা ভয়ানক অশুভ বলে মানা হয়। শাস্ত্রে বলা আছে, এতে বৃদ্ধি পায় দারিদ্র্য, অশান্তি ও রোগ। সেই কারণে আজও ভাঙা মূর্তিকে বাতিল না করে বিসর্জন দেওয়ার প্রথাই চালু আছে। অভাগীর স্বর্গের মতো তাকেও কোন আলোক রথ নিতে আসে কি না, কে জানে!
ভাঙা মূর্তির এই ভয়কে কিন্তু সুচারুভাবে কাজে লাগাত বিদেশি আক্রমণকারীরাও। ভারতবর্ষের ইতিহাসে তাই ইসলামিক আর ইউরোপীও আগ্রাসনের হাতে মন্দির ভেঙে মূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করার নিদর্শন বহুবার দেখা গেছে। এই কাজটি আক্রমণকারীরা সবসময় যে ভারতের ধর্মকে খর্ব করার জন্য করেছে এমনটা নয়, বরং ভাঙা মূর্তির কুসংস্কারকে উল্টে কাজে লাগাত স্থানীয় মানুষের মনোবল ভাঙার জন্য। প্রাচীন অবিভক্ত ভারতবর্ষ, যা আজকের আফগানিস্তান থেকে কম্বোডিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল সে সমস্ত অঞ্চলে পুরাতত্ত্ববিদরা খুঁজে পেয়েছেন এমন অনেক প্রতিমা যেগুলোর চোখ ইচ্ছাকৃতভাবে খোঁচানো বা নাক কেটে দেওয়া হয়েছে। এগুলো কেবল ভাঙচুর নয়, প্রতিপক্ষের বিশ্বাস নষ্ট করার কৌশল মাত্র। কারণ কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনে মূর্তি ভাঙা আর মনোবল ভাঙা ছিল সমার্থক।
গ্রিক-সমাজে দেবতার প্রতিমা ভাঙা মানে দেবতার অসন্তোষ। তারা মনে করত, মানুষ যদি অহংকারে ভোগে তবে দেবতা তাকে কোনও না কোনও চিহ্ন দিয়ে সতর্ক করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৪১৫-এ হার্মিসের মূর্তির মুখ যখন বিকৃত অবস্থায় পাওয়া গেল, পুরো এথেন্স অশান্ত হয়ে উঠল। অনেকেই ধরে নিলেন, স্পার্টানদের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধযাত্রা সফল হবে না। প্রকৃতপক্ষে সেই যুদ্ধে এথেন্স ভয়াবহ ভাবে পরাজিতই হয়েছিল। সেই থেকে মূর্তি ভাঙাকে কোনও কাকতালীয় দুর্ঘটনা বলে মনে করেনি গ্রিকরা, বরং দেবতার স্পষ্ট বার্তা হিসেবেই গ্রহণ করেছিল।
রোমানদের কাছে এমন ঘটনা ছিল রাষ্ট্রীয় সংকেত। তারা যাকে বলত ‘prodigium’– অস্বাভাবিক ঘটনা, যা দেবতার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার লক্ষণ। কোনও মূর্তি ভেঙে গেলে সেনেট বসত, পূজার আয়োজন হত, আবার নতুন মূর্তি স্থাপন করা হত। এর উদ্দেশ্য একটাই– দেবতাদের শান্ত করা। রোমানরা বিশ্বাস করত, দেবতারা যদি রুষ্ট হন তবে সম্রাজ্যের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে।
মধ্যযুগে খ্রিস্টধর্মে মূর্তিপূজা গ্রহণযোগ্য না হলেও, গির্জার ক্রুশ বা সন্তদের প্রতিমা যদি হঠাৎ ভেঙে যেত, তখনও মানুষ একইরকম আতঙ্কিত হত। তারা মনে করত এটি কোনও পাপের ফল। ইসলামে মূর্তি নিষিদ্ধ হলেও, আরবের পুরনো প্রথায় পাথরের প্রতীক বা তাবিজ ভাঙা হলে অমঙ্গল আসবে বলে ভাবা হত।
আধুনিক যুগেও এই বিশ্বাস পুরোপুরি মুছে যায়নি। ভাঙা আয়না নিয়ে যে সাত বছর অমঙ্গলের কুসংস্কার, তার সূত্র প্রাচীন রোম থেকেই আগত। বাংলার গ্রামাঞ্চলেও কথিত আছে, বাড়ির পূজার মূর্তি যদি ভেঙে যায়, তবে সেটা ঘরে রাখা উচিত নয়। অনেকে মনে করেন ভাঙা দেবতা অশুভ শক্তি টেনে আনেন। জাপানে আবার একেবারে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠল। সেখানে ভাঙা জিনিস সোনার গুঁড়ো দিয়ে জোড়া লাগানো হয়, যাকে বলা হয় ‘কিন্ৎসুগি’।
আদিবাসী সমাজগুলোতে আজও দেখা যায়, পূর্বপুরুষের মূর্তি বা টোটেম ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটিকে গোপনে মাটিচাপা দেওয়া হয় বা বনেই ফেলে আসা হয়। তাদের বিশ্বাস, এতে আত্মারা শান্ত হয়। আর শহুরে মানুষ হয়তো চক্ষুলজ্জার খাতিরে মুখে কিছু না বললেও ভাঙা ক্রুশ, ভাঙা শিবলিঙ্গ বা ভাঙা পারিবারিক প্রতিকৃতি দেখে অস্বস্তি বোধ করে মনে মনে। এটা আসলে মানুষের অচেতন মনে গেঁথে থাকা প্রাচীন ভয়।
প্রতিমা ভাঙা নিয়ে এই বিশ্বাস এক অর্থে আমাদের মানবিক দুশ্চিন্তার প্রতিচ্ছবি। জীবন ভঙ্গুর, নিশ্চয়তা কম। তাই মানুষ ভরসার জায়গা খুঁজেছে দেবতার মূর্তিতে। যখন সেই ভরসার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভেঙে যায়, তখন মনে হয় বিশ্বাসের ভারসাম্য নষ্ট হল। এই অনুভূতি শুধু ধর্মের নয়, মানুষের মানসিক নিরাপত্তাহীনতারও প্রতিবিম্ব।
আজকের দিনে আমরা জানি, প্রতিমা ভাঙা মানে সর্বনাশ নেমে আসবে না। কিন্তু কোনও প্রতীক ভাঙা মানে যে সমাজের গল্প ভাঙা, সেটাও সত্যি। তাই মানুষ হয় বিসর্জন দেয়, নয়তো ভাঙা অংশ মেরামত করে তাকে আবার গড়ে তোলে সৌন্দর্যে। ভাঙনের ভয় থেকে সুন্দরের পূজারী ওঠা– এটাই হল মানুষের নতুন শিক্ষা। তাই আফগানিস্তানের বুদ্ধমূর্তি হোক বা ঢাকার লক্ষীনারায়ণ বিগ্রহ, ধস্ত হওয়া প্রতিমা বারবার জানান দেয়, সৌন্দর্যের শত্রুরা আজও বর্তমান। নাস্তিক মনও সায় দেয় না সেসব ইতিহাস বিকৃতিতে। কেবল প্রকৃতি ছাড়া কারও লাইসেন্স নেই এ সব কাজের। কারণ, প্রকৃতি সৃষ্টির থেকেও আদিম, সুন্দরের আসল স্রষ্টা।
মনে পড়ে গেল, সিকিমের পথের ধারে পাথরের ওপর খোদাই করা একটা বুদ্ধমূর্তি দেখেছিলাম একবার। শ্যাওলায় জীর্ণ, ফাটল ধরেছে গায়ে, কিন্তু সেই একরত্তি ফাটলের মধ্যে থেকেও মাথা তুলে ফুটে রয়েছে লাল টুকটুকে উদ্ধত একটি গোলাপ। ভাঙা বিগ্রহের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ওই ছিল প্রকৃতির জীবন্ত প্রতিবাদ।
……………..অপয়ার ছন্দ অন্যান্য পর্ব……………..
পর্ব ২০। পেঁচা মনে করিয়ে দেয় প্রকৃতি আর অলৌকিকের মাঝের সীমানা খুব সূক্ষ্ম
পর্ব ১৯। রাতে, ঝাঁটা নিয়ো না হাতে
পর্ব ১৮। তিল থেকে তাল
পর্ব ১৭। অন্ধবিশ্বাস মাথাচাড়া দিলে ‘অপয়া’ হয় মাথায় হাত
পর্ব ১৬। চুল তার কবেকার অন্ধকার অপয়ার নিশান
পর্ব ১৫। যে আত্মীয়তার ডাককে অপয়া বলে বিকৃত করেছে মানুষ
পর্ব ১৪। অকারণে খোলা ছাতায় ভেঙে পড়েছে পাবলিক প্লেসে চুমু না-খাওয়ার অলিখিত আইন
পর্ব ১৩। দলবদলু নেতার মতো ধূমকেতু ছুটে চলে অনবরত
পর্ব ১২। কখনও ভয়ংকর, কখনও পবিত্র: দাঁড়কাক নিয়ে দোদুল্যমান চিন্তা!
পর্ব ১১। শুধু একটা হ্যাঁচ্চো– বলে দেবে কীভাবে বাঁচছ
পর্ব ১০। অপয়ার ছেলে কাঁচকলা পেলে
পর্ব ৯। চোখের নাচন– কখনও কমেডি, কখনও ট্র্যাজেডি!
পর্ব ৮। জুতো উল্টো অবস্থায় আবিষ্কার হলে অনেক বাড়িতেই রক্ষে নেই!
পর্ব ৭। জগৎ-সংসার অন্ধ করা ভালোবাসার ম্যাজিক অপয়া কেন হবে!
পর্ব ৬। প্রেম সেই ম্যাজিক, যেখানে পিছুডাক অপয়া নয়
পর্ব ৫। ডানা ভাঙা একটি শালিখ হৃদয়ের দাবি রাখো
পর্ব ৪। জন্মগত দুর্দশা যাদের নিত্যসঙ্গী, ভাঙা আয়নায় ভাগ্যবদল তাদের কাছে বিলাসিতা
পর্ব ৩। পশ্চিম যা বলে বলুক, আমাদের দেশে ১৩ কিন্তু মৃত্যু নয়, বরং জীবনের কথা বলে
পর্ব ২। শনি ঠাকুর কি মেহনতি জনতার দেবতা?
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved