Robbar

জ্যোতিবাবুকে প্রধানমন্ত্রীর পদে দেখতে চেয়েছিলেন মনমোহন সিং

Published by: Robbar Digital
  • Posted:September 20, 2025 7:47 pm
  • Updated:September 20, 2025 7:47 pm  

২০০৪ সালের আগে সোনিয়া গান্ধী আমাকে ১০ নম্বর জনপথে একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। তখন প্রশ্ন করেছিলাম, যদি কংগ্রেস নির্বাচনে জেতে তাহলে আপনি প্রধানমন্ত্রী? জবাব ছিল, বিজেপিকে হারানো আমাদের লক্ষ্য। দলে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অনেক যোগ্য ব্যক্তি আছে। যেমন ধরুন, মনমোহন। শুনেও বিশ্বাস করিনি। সকলের মতো আমার ধারণা ছিল সোনিয়া গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হবেন। ১৯৯৬ সালে জ্যোতিবাসুকে প্রধানমন্ত্রী চেয়েছিলেন সুরজিত। সকলেই জানেন। কিন্তু অনেকেই জানেন না– মনমোহনও প্রস্তাব দিয়েছিলেন, জ্যোতিবাবুকে প্রধানমন্ত্রী করা হোক। জ্যোতি বসু হননি। হতে পারেননি। সুরজিত প্রতিদান হিসাবে মনমোহনের নাম সুপারিশ করেন। সম্ভবত। এর জবাব একমাত্র সোনিয়াই দিতে পারেন।

গৌতম লাহিড়ী

সালটা ২০০৮। বিদেশমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সফরসঙ্গী। গিয়েছিলাম ইসলামাবাদ। প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে পশ্চিম পাকিস্তানের অখ্যাত গ্রাম গাহ্‌। ঝিলাম জেলার অন্তর্গত। এখানেই ১৯৩২ সালে ফলবিক্রেতার পরিবারে জন্ম মনমোহনের। ছেলেবেলায় মা মারা যায়। মানুষ ঠাকুমার কাছে। গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। লম্ফর আলোয় পড়াশোনা। উর্দুতে। ‘মোহনা’ বলেই ডাকত সবাই। বিকেলে প্রণববাবুর সৌজন্যে সাক্ষাৎ ‘পাকিস্তান পিপল্‌স পার্টি’র চেয়ারম্যান আসিফ আলী জারদারির সঙ্গে। বেনজির ভুট্টো বোমা বিস্ফোরণে নিহত হওয়ার পর তিনি দলের দায়িত্বে। বলেছিলেন, পাকিস্তানের মানুষ মনমোহন সিংকে এখনও মনে রেখেছে। দেশভাগের সময় মনমোহনের পরিবার ভারতে চলে আসে। দাঙ্গায় পিতামহের মৃত্যু হয়। সেই শোক ভোলেননি। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেও তিনি নিজের জন্মভূমি দেখতে যাননি। পাকিস্তান সরকারের সন্ত্রাসবাদীদের প্রশ্রয় দেওয়ার নীতির জন্যই যেতে চাননি।

আসিফ আলী জারদারি এবং মনমোহন সিং

আসিফ আলী বলছিলেন, মনমোহন সিং নিজের গ্রামের কথা ভোলেননি। প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশারফকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেছিলেন গ্রামের উন্নয়নের জন্য। মনমোহনের এই দুর্বলতা বুঝে মোশারফ পাঞ্জাব সরকারকে বলে সড়ক তৈরি করেন। স্কুল ভবনের সংস্কার হয়। তৈরি হয় কলেজ। স্কুলের নাম হয় মনমোহন সিং বিদ্যালয়।

মোশারফের পরে আসিফ আলী জারদারি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর মনমোহন গ্রামে বিদ্যুৎ লাইন প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগ নেন। প্রেসিডেন্ট মোশারফ এবং আসিফ আলী জারদারি– দু’জনেই তাঁকে আমন্ত্রণ জানান। ভারতের পাকিস্তানের প্রতি কঠোর নীতির কারণেই নিজের গ্রামে যাওয়ার বেদনা লুকিয়ে রেখেছিলেন।

স্কুলের বন্ধু রাজা মুহাম্মদ আলী একবার দিল্লি এসে প্রধানমন্ত্রী মনমোহনের সিং সঙ্গে দেখা করেছিল। তাঁর মৃত্যুর পর গাহ্ গ্রাম শোকপালন করেছিল। পরে গ্রাম অন্তর্ভুক্ত হয় নতুন জেলা চক্বালায়। চপ্পল বানানোর জন্য বিখ্যাত। গ্রাম থেকে চপ্পল উপহার পাওয়ার পর আবেগপ্রবণ হয়েছিলেন।

মনমোহন সিংকে বিপাকে পড়তে হল পাকিস্তান নিয়েই। ২০০৯ সালের জুলাই মাসে মিশরের রিসোর্ট-শহর শর্ম এল সেইখ-এ পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। ২০০৮ সালের মুম্বই জঙ্গিহানার পরেই প্রথম বৈঠক। বৈঠকের যৌথ বিবৃতি নিয়ে তুলকালাম। পাকিস্তান রটিয়ে দিল– ভারত মেনে নিয়েছে বেলুচিস্তানের সন্ত্রাস নিয়ে আলোচনা করবে। পাকিস্তান বলত, বেলুচিস্তানে ভারতের গোয়েন্দারা বিদ্রোহ করাচ্ছে। ভারত কোনও দিন বেলুচিস্তান প্রসঙ্গ তুলত না। এই প্রথম উল্লেখ হওয়ায় শোরগোল। বিজেপি মনমোহনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের কাছে আত্মসমর্পণ করার অভিযোগ তুলল।

ইউসুফ রাজা গিলানি এবং মনমোহন সিং, ২০০৯-এর দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে

কংগ্রেস দলের মধ্যেও বিভ্রান্তি। শীর্ষ বৈঠকে মনমোহন সিং দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘আমি কোনও সমঝোতা করিনি। আমি পাকিস্তানে রাষ্ট্রের মদতে সন্ত্রাস দেওয়ার কারণে নিজের জন্মভিটেতে যাইনি। আমি সমঝোতা করব?’ পার্লামেন্টে বলেন, ‘বৈঠকের আগে, পাকিস্তানের কাছে মুম্বাই জঙ্গি হামলা নিয়ে জবাব চেয়েছিলাম। পাকিস্তান জবাব-সহ যে ডোসিয়ার পাঠিয়েছিল ওতে স্বীকার করেছে জঙ্গিরা পাক নাগরিক। এটা ভারতের কূটনৈতিক সাফল্য নয়?’

পাকিস্তানের ‘ফ্রাইডে টাইম্‌স’ সম্পাদক নাজাম শেঠি লিখেছিলেন মুম্বই জঙ্গিহানার অন্যতম ভিলেন আজমলের বাড়ি ফরিদকটের গ্রামে। তার বাবাকে ১ লক্ষ টাকা দিয়েছিল ‘জয়েস এ মহম্মদ’ সংগঠন, আজমলকে ‘আল্লার’ কাছে পাঠানোর জন্য। ইসলামিক জঙ্গি সংগঠনগুলো প্রচার করে জিহাদে ‘শহিদ’ হলে আল্লার প্রিয়পাত্র হওয়া যায়। জন্নতে স্থান হয়। স্বল্পশিক্ষিত আজমল তাই বিশ্বাস করেছিল।

মনমোহনের বিরুদ্ধে সমঝোতা করা, দৃঢ়তা না দেখানোর অভিযোগ সত্ত্বেও, মুম্বই জঙ্গিহানার প্রতিবাদে পাকিস্তানের বিরূদ্ধে একটা বুলেটও না ছুড়ে ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে জিতলেন। বামপন্থীরাও সমর্থন তুলে নিয়েছিল। তবু। কূটনৈতিক দিক থেকে পাকিস্তানকে কোণঠাসা করে দিয়েছিলেন।

২০০৪ সালের কংগ্রেস নেতৃত্বে ইউপিএ সরকার গঠনের কৃতিত্ব যদি সোনিয়া গান্ধীর হয়, তাহলে ২০০৯ মনমোহন সিংয়ের। ২০০৪ সালে কংগ্রেসের আসন ছিল ১৪৫। ২০০৯ সালে বেড়ে হল ২০৬।

সোনিয়া গান্ধি এবং সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে

অক্সফোর্ড-কেমব্রিজের অর্থনীতিবিদ মনমোহনকে সকলেই জানতেন ‘পণ্ডিত’ হিসাবে। তার যে রাজনীতিতেও ক্ষুরধার বুৎপত্তি ছিল অনেকে বুঝতেন না। অন্তত বামপন্থীরা বুঝত না। অথচ জীবনের শুরুতে রাজনীতিতে আসবেন ভাবেননি। বিবিসির সাংবাদিক মার্ক টালিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “নরসীমা রাও ১৯৯১ সালে মন্ত্রিসভা গঠন করছেন। হঠাৎ প্রধান সচিব ফোন করে জানাল– ‘প্রধানমন্ত্রী চাইছেন, আপনি অর্থমন্ত্রী হবেন।’ আমি গুরুত্ব দিইনি। পরদিন সকালে রাও সাহেব ক্ষুব্ধ হয়েই বলেন, ‘আপনাকে তৈরি হতে বললাম। এখনও হননি!’ তারপর রাষ্ট্রপতি ভবনে এলাম। মন্ত্রী হলাম।”

যখন দায়িত্ব নিলেন তখন দেশের অর্থনীতি ভয়াবহ। বিকাশ দর ৩ শতাংশে। বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় মাত্র এক বিলিয়ন ডলার। পণ্য আমদানি করলে দাম দেওয়ার টাকা প্রায় নেই। সেই মনমোহন ২০০৯ সালে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় করেছিলেন ৬০০ বিলিয়ন ডলার।

অর্থমন্ত্রী হয়ে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিলেন। লাইসেন্স রাজ তুললেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানে বেসরকারি লগ্নির পথ প্রশস্ত করলেন। প্রবল সমালোচনা হল। তিনি দক্ষিণপন্থী উদার আর্থিক নীতি প্রবর্তন করছেন। কোনও সমালোচনাকে গ্রাহ্যই করলেন না।

চিনের আর্থিক নীতির প্রবর্তক ছিলেন ডেঙ সিয়াও পিং। পি চিদাম্বরম বলেন, মনমোহন সিং ভারতের ডেং সিয়াও পিং। তাঁকে বলা হত ‘আমেরিকার নিউ কনজারভেটিভ’। আর্থিক উদারনীতির নেতিবাচক দিক হল, অপব্যবহার হলে দুর্নীতি মাথা চারা দেয়। হর্ষদ মেহতার শেয়ার কেলেঙ্কারি নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড়। প্রধানমন্ত্রী রাওয়ের কাছে পদত্যাগ করতে চাইলেন। প্রধানমন্ত্রী বিশ্বাস করতেন না মনমোহন দুর্নীতি করেছেন।

মুশারফের সঙ্গে

পরে ইউপিএ দ্বিতীয় সরকারের সময় একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ। টু-জি স্পেকট্রাম, কয়লা খনি বরাতের কেলেঙ্কারি, কমনওয়েলথ গেমস কেলেঙ্কারি। মন্ত্রীসভার বৈঠকে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, হয় আমি পদত্যাগ করব, নতুবা মন্ত্রী করবে। ডিএমকে-র এ রাজাকে জেলে পাঠিয়েছেন। সুরেশ কালমাডিও। সাদা শার্ট মাথার আকাশনীল পাগড়ির মতোই অমলিন থেকে গিয়েছে। কলঙ্কের কোনও ছাপ পড়েনি। উপরন্তু তাঁকে শিরোপা দেওয়া হল ভারতের আর্থিক নীতির জনক। যে নীতি আজও অনুসৃত হয়ে চলেছে।

ভারতের আর্থিক নীতির সংস্কারক হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর তিনি প্রথম উদ্যোগ নিলেন উচ্চ প্রযুক্তির উপর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের। আমেরিকার সঙ্গে অসামরিক পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরের।

বামপন্থীদের অভিযোগ মনমোহন দেশকে আমেরিকার কাছে বন্ধক দিচ্ছেন। সমর্থন তুলে নেবে বলে হুমকি দিচ্ছে। সোনিয়া গান্ধী চিন্তিত। মনমোহনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন যোজনা কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান মনটেক সিং আলুয়ালিয়া। সোনিয়াকে বললেন, পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষর করতে না দিলে তিনি পদত্যাগ করবেন। বামেরা সমর্থন তুলে নিলে সরকারের পতন হবে। মনটেকের জবাব ছিল, ‘আগে কংগ্রেস দলকে রাজি করান। উনি বাকিটা দেখবেন। কীভাবে দেখবেন সেটা জানি না।’

প্রকাশ কারাত নিশ্চিত কংগ্রেস সরকারের পতন হবে। বিজেপির সঙ্গে আঁতাঁত হয়ে গিয়েছে গোপনে। বহুজন সমাজ পার্টির মায়াবতীকে প্রধানমন্ত্রী করে বিকল্প সরকার হবে। যেমন ১৯৭৭ সালে হয়েছিল। মনমোহন একমাত্র আলোচনা করতেন প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। সকলেই জানে, পরমাণু চুক্তি স্থগিত হয়ে গিয়েছে।

কূটনৈতিকভাবে সহযোগিতা করছিলেন সিঙ্গাপুরের তখনকার হাইকমিশনার সুব্রহ্মণ্যন জয়শঙ্কর। এখন যিনি বিদেশমন্ত্রী। তিনি আমেরিকার প্রশাসনের সঙ্গে গোপন দূত হয়ে কাজ করছিলেন। মনমোহন, প্রণব এবং সোনিয়া গান্ধীর বিশ্বস্ত আহমেদ প্যাটেল নেপথ্যে সমর্থন জোগাড়ের চেষ্টায়।

প্রকাশ কারাতদের ধারণা ছিল স্পিকার সোমনাথ চ্যাটার্জী তাদের সঙ্গে সহমত হয়ে সরকার হারিয়ে দেবেন। জানতেন না, মনমোহনের সঙ্গে সোমনাথের কথা হয়ে গিয়েছিল। পরে মনমোহন, সোমনাথকে ‘রাজ্যপাল’ বা ‘রাষ্ট্রদূত’ পদ দিতে চেয়েছিলেন। সোমনাথ নেননি। তিনি ‘রাষ্ট্রপতি’ হতে চেয়েছিলেন।

মনমোহন সম্পর্কে অনেকের ধারণা তিনি মার্কিন ঘেঁষা। সব বিষয়ে আমেরিকার নীতি সমর্থন করতেন না। অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন সিপিএম সাধারণ সম্পাদক হরকিষেন সিং সুরজিতের। সুরজিতের স্মরণসভায় মনমোহন এসে চমকে দিয়েছিলেন। বামেরা সমর্থন তোলার পর এক মঞ্চে কারাত এবং মনমোহন। মনমোহন খোঁচা দিয়েছিলেন। বললেন, সুরজিৎ কেবল এক দলের নয়। দেশের নেতা। নিজের দলীয় আদর্শে অটল থাকলেও অন্যের মত শুনতে আগ্রহী ছিলেন।

সেই প্রথম মনমোহন প্রকাশ্যে বলেছিলেন– বিশ্বে মার্কিন আধিপত্য হ্রাস করতে সুরজিৎ প্রথম পরামর্শ দিয়েছিলেন ব্রাজিল, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা-সহ ব্রিক গোষ্ঠী গড়ে তুলতে। ভারত সরকার এরপর থেকে উদ্যোগ নেয় বহুদেশীয় বা মাল্টিপোলার বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলতে। মনমোহন বলেছিলেন, ছেলেবেলায় পাকিস্তান থেকে আসার পর শুনেছিলাম সুরজিৎ সাব জলন্ধর আদালতে ব্রিটিশদের ইউনিয়ন জ্যাক পতাকা নামিয়ে তেরঙ্গা তুলেছিলেন। তারপর থেকে ওঁর ঘনিষ্ঠ হই।

হরকিষেন সিং সুরজিতের (ডান) সঙ্গে মনমোহন সিং

দিল্লির কনস্টিটিউশন ক্লাবে স্মরণসভায় ঐতিহাসিক তথ্য বলে সেদিন চমকে দিয়েছিলেন মনমোহন। তিনি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক গভর্নর হওয়ার সময়ই নিয়মিত সুরজিতের সঙ্গে বৈঠক করতেন একান্তে।

মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তার ব্যক্তিগত সচিব সঞ্জয় বারু মনমোহনকে ‘অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। সোনিয়া গান্ধী প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে সরে যাওয়ার পর অনেকের ধারণা ছিল প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী হবেন। কিন্তু সোনিয়া গান্ধী বেছে নিয়েছিলেন মনমোহনকে।

আমার বিশ্বাস হরকিষেন সিং সুরজিত সোনিয়াকে একান্তে মনমোহনের নাম সুপারিশ করেছিলেন। সোনিয়া গান্ধী এখনও এই তথ্য প্রকাশ করেননি। দু’টি কারণে হতে পারে। এক, মনমোহনকে সৎ বলে সুরজিৎ পছন্দ করতেন। দুই, প্রণব প্রধানমন্ত্রী হলে বাংলায় কংগ্রেস চাঙ্গা হয়ে যেত। বামেদের পতন নিশ্চিত হত অনেক আগেই। প্রণবকে রুখতে সুরজিৎ-মনমোহন তাস খেলেছিলেন?

২০০৪ সালের আগে সোনিয়া গান্ধী আমাকে ১০ নম্বর জনপথে একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। কিয়দংশ ‘সংবাদ প্রতিদিন’ প্রকাশ করেছিল। তখন প্রশ্ন করেছিলাম, যদি কংগ্রেস নির্বাচনে জেতে তাহলে আপনি প্রধানমন্ত্রী? জবাব ছিল, বিজেপিকে হারানো আমাদের লক্ষ্য। দলে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অনেক যোগ্য ব্যক্তি আছে। যেমন ধরুন মনমোহন। শুনেও বিশ্বাস করিনি। সকলের মতো আমার ধারণা ছিল সোনিয়া গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হবেন।

১৯৯৬ সালে জ্যোতিবাসুকে প্রধানমন্ত্রী চেয়েছিলেন সুরজিৎ। সকলেই জানেন। কিন্তু অনেকেই জানেন না– মনমোহনও প্রস্তাব দিয়েছিলেন, জ্যোতিবাবুকে প্রধানমন্ত্রী করা হোক। জ্যোতি বসু হননি। হতে পারেননি। সুরজিৎ প্রতিদান হিসাবে মনমোহনের নাম সুপারিশ করেন। সম্ভবত। এর জবাব একমাত্র সোনিয়া দিতে পারেন।

বারাক ওবামার সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে

২০০৯ সালের নভেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী মনমোহনের সিংয়ের সঙ্গে ওয়াশিংটন গিয়েছিলাম। প্রেসিডেন্ট বরাক ওবামা প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে স্টেট ডিনারে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ওবামা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর প্রথম যে বিদেশি অতিথিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, তিনি মনমোহন। ওবামা তাঁকে আর্থিক গুরু মানতেন। আমেরিকার অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য তিনি মনমোহনকে পরামর্শ দিতে বললেন। হোয়াইট হাউসের সাংবাদিক বৈঠকে ঘোষণা হল মনমোহন-ওবামা শিক্ষা বৃত্তি, মেধাবী বিদ্যার্থীদের জন্য। অন্য কোনও প্রধানমন্ত্রীর নামে এমন কোনও শিক্ষাবৃত্তি বোধহয় নেই। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনও মনমোহনের নামে উচ্চশিক্ষা বৃত্তি রয়েছে।

কোনও দিন নিজের প্রচার করেননি। সরকারি দপ্তরকে করতে দেননি। ইদানীং তো প্রধানমন্ত্রী রেল থেকে পয়ঃপ্রণালী উদ্বোধন করেন নিজে। ওয়াশিংটন থেকে ফেরার পথে এক সাংবাদিক বললেন– ‘স্যর, আপনাকে ওবামা ভীষণ সম্মান দিল।’ মনমোহনের সংক্ষিপ্ত জবাব ছিল: ‘আমাকে নয়। আমাদের দেশকে দিয়েছেন।’

মনমোহন সিং শত সমালোচনার মুখেও মিডিয়ার মুখোমুখি হতে দ্বিধা করেননি। বিদেশ যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতেন। বাৎসরিক সাংবাদিক বৈঠক করতেন। একবার বিমানে বিদেশ থেকে ফেরার সময় সাংবাদিক প্রশ্ন করে বসলেন, ‘আপনি রাহুল গান্ধীকে দায়িত্ব সমর্পণ করে সরে যাচ্ছেন না কেন?’ সহাস্য জবাব ছিল– ‘আমি রাহুল গান্ধীর জন্য পদ ছেড়ে দিতে পারি।’ তিনি অনেকবার রাহুলকে মন্ত্রী করতে চেয়েছিলেন।

প্রিয় সহকর্মী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে

ইউপিএ টু-র মেয়াদ শেষের আগে সাংবাদিক বৈঠকে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন তৃতীয়বার তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন না। রাহুল গান্ধী প্রধানমন্ত্রী পদের যোগ্যতম প্রার্থী।
–আপনার কি মনে হয় নরেন্দ্র মোদি বনাম রাহুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা সমানে সমানে?
–মোদি প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের বিপর্যয়।
–আপনাকে ‘দুর্বল’ প্রধানমন্ত্রী বলা হয়।
–ইতিহাসবিদরা বিশ্লেষণ করবেন। মনে হয়, মিডিয়ার থেকে ইতিহাস আমার প্রতি দয়ালু হবে। ‘শক্তিশালী’ প্রধানমন্ত্রীর অর্থ যদি হয় গণহত্যার পৌরহিত্য করা– তেমন আমি হতে চাই না।

২০২৪ সালে মনমোহন সিংয়ের প্রয়াণের পর যে ধরনের স্মৃতিচারণ দেশ দেখেছে, তাতে মনে হয়, তাঁর নিজের মূল্যায়ণ সম্পর্কে সঠিক ভবিষ্যৎবাণী করে গিয়েছিলেন তিনি।