Robbar

প্রণব রায় না থাকলে ‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’ ইতিহাস হত না

Published by: Robbar Digital
  • Posted:September 22, 2025 9:22 pm
  • Updated:September 22, 2025 9:22 pm  

অধীর বাগচী আর গৌরীদার চোখে দেখলাম এক তীর্যক, রহস্যময় হাসির বিনিময়। সেখানেই গৌরীদা শুরু করলেন সেই গল্প– কীভাবে এক অদ্ভুত অবস্থায় তাঁর গানকে রক্ষা করেছিলেন প্রণব রায়। গৌরীদার মতে, প্রণব রায় ছিলেন গানের ভগীরথ। গল্পটা শোনার সময় বোঝা যাচ্ছিল, এই অভিজ্ঞতা তাঁর কাছে শুধুই অতীত নয়, বরং এক কৃতজ্ঞ স্মৃতি। কারণ প্রণব রায় না থাকলে, সেই গান হয়তো হতই না। কিংবা সেটা আর পাঁচটা গানের মতো হত; ইতিহাস হত না।

দেবজ্যোতি মিশ্র

১.

দুপুরের আলোয় এক গান

সময়টা আটের দশকের শুরু। সময়টা অনেক সম্ভাবনার। তখন বিস্ময়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হত প্রায় প্রতিদিন। তেমনই এক দিনের ঘটনা। রাসবিহারীর পাশে এইচএমভি-র রিহার্সাল রুম। সেখানে চাঁদের হাট বসেছে। ঘর আলো করে বসে আছেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। তাঁর সঙ্গে অধীর বাগচী, সুরকার অনিল বাগচীর ছেলে। তাঁরা অপেক্ষা করছিলেন সলিল চৌধুরীর জন্য। সলিলদার আসতে তখনও দেরি। ঘরে ঢুকে গৌরীদাকে প্রণাম করলাম। আমার চোখে তখন ঘোর-লাগা বিস্ময়। হঠাৎ মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, ‘আমি যামিনী তুমি শশী হে…’ গানটির লাইন। এ-গান নিয়ে আমার মুগ্ধতা জানানো মাত্রই ঘর ভরে উঠল তাঁর গম্ভীর অথচ গৌড়ীয় হাসিতে।

গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার

অধীর বাগচী আর গৌরীদার চোখে দেখলাম এক তীর্যক, রহস্যময় হাসির বিনিময়। সেখানেই গৌরীদা শুরু করলেন সেই গল্প– কীভাবে এক অদ্ভুত অবস্থায় তাঁর গানকে রক্ষা করেছিলেন প্রণব রায়। গৌরীদার মতে, প্রণব রায় ছিলেন গানের ভগীরথ। গল্পটা শোনার সময় বোঝা যাচ্ছিল, এই অভিজ্ঞতা তাঁর কাছে শুধুই অতীত নয়, বরং এক কৃতজ্ঞ স্মৃতি। কারণ প্রণব রায় না থাকলে, সেই গান হয়তো হতই না। কিংবা সেটা আর পাঁচটা গানের মতো হত; ইতিহাস হত না।

স্টুডিওর ফ্লোরটা যেন বড় সংসার। গানের গেরস্থালি। টেবিলে সাজানো নোটেশন পেপার, কন্ডাক্টর স্ট্যান্ডের পাশে ধোঁয়া ওঠা চা, আর পিছনে ঘড়ঘড় শব্দে ঘোরা টেপ মেশিন। স্টুডিওর ভরা সংসার। সেখানে জন্ম নেবে গানের ইতিহাস।

অনিল বাগচী

সুরকার অনিল বাগচী গুনগুন করছেন, পাশে অলকনাথ দে নোটেশন বিলিয়ে দিচ্ছেন; কারও ভুল রয়ে গেল কি না, খুঁটিয়ে দেখছেন। ব্যস্ততা তুঙ্গে। শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। আজ যে স্টুডিওতে আসছেন মান্না দে! তাঁর গলায় সেজে উঠবে এই গান।

দরজা ঠেলে ঢুকলেন তিনি। চোখে ভারি চশমা, মুখে গাম্ভীর্য। তবু ভেতরে শিশুসুলভ উচ্ছ্বাস লুকিয়ে আছে। মান্না দে গাইলেন– ‘আমি যামিনী… তুমি শশী হে…’

গাওয়া থামিয়েই বললেন, ‘‘আমি’ শব্দটা সোমে পড়ুক বা না পড়ুক, গাওয়া যায়। কিন্তু গেয়ে সেই আয়েশ নেই। মেজাজটা ঠিই আসছে না।”

সবার মুখ নিস্তব্ধ। কারণ সবাই জানে, মান্না দে খুঁতখুঁতে। আর সেই খুঁতের ভেতর থেকে খুঁড়ে আনেন সোনার ঠিকানা।

গৌরীপ্রসন্ন কোণে বসে আছেন, শান্ত অথচ দৃপ্ত। তিনি কিছু বললেন না, শুধু শুনলেন। সামান্য হতাশও হলেন হয়তো।

এন্টনী ফিরিঙ্গী | চিত্র বিবরণ | বেঙ্গল ফিল্ম আর্কাইভ<

পরিস্থিতি হঠাৎ জটিল। সুর আর কথা তখন দু’দিকে মুখ করে রয়েছে। সময় কেমন থমকে গিয়েছে। ঠিক তখনই এলেন প্রণব রায়। এই সিনেমায় (এন্টনী ফিরিঙ্গী) তিনিও গান লিখেছেন। গৌরীপ্রসন্ন তাঁর ছোট ভাইয়ের মতো। ভালোই বুঝলেন গৌরীপ্রসন্নের মানসিক অবস্থা। তিনিই কলমকে দিলেন সুরের কিনারা। খানিক অনায়াসেই বললেন, ‘‘আচ্ছা, ‘আমি’ যদি সোমে না পড়ে? তার বদলে ‘যামিনী’তে সোম রাখলে কেমন হয়?”

হঠাৎ কালো ‘যামিনী’তে যেন উজ্জ্বল হল ‘শশী’। অনিল বাগচীর চোখে ঝলমল করে উঠল জ্যোৎস্না। তিনি টেবিলে চাপড়ে বললেন, ‘এই তো! একই কথা, কিন্তু অন্য প্রাণ।’

আবার যেন জেগে উঠল সংসার। অলকনাথ নতুন করে স্বরলিপি লিখতে শুরু করলেন। মিউজিশিয়ানরা যন্ত্র হাতে নিলেন। গৌরীদা চোখ বন্ধ করে যেন মিশিয়ে নিচ্ছিলেন শব্দ আর সুর।

প্রণব রায়

মান্না দে গাইলেন আবার। একেবারে অন্য রূপে। এবার কণ্ঠ আর কলম মিলেমিশে একাকার। চোখে-মুখে পরিতৃপ্তি। হেসে তিনি বললেন, ‘দেখলি তো, খুঁতখুঁতই জন্ম দেয় নতুন সৌন্দর্য।’ তিনি কি গৌরীর উদ্দেশেই বললেন– ‘আমি যামিনী, তুমি শশী হে…!’

কথা, সুর, কণ্ঠ– গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, অনিল বাগচী এবং মান্না দে– তিনজনেই এখন তিনজনের প্রতি মুগ্ধ। ত্রিবেণী সঙ্গম কৃতজ্ঞ হয়ে চেয়ে রয়েছে প্রণব রায়ের কাছে। সৃষ্টির সুখে সবাই তখন সুখী। হঠাৎ যেন গঙ্গাজলে এক ফোঁটা চোনা ঢেলে দিলেন পরিচালক সুনীল ব্যানার্জির এক সহকারী।

তিনি বললেন, ‘সুরটা তো খুব সুন্দর। কথাগুলোও ভালো। কিন্তু বড় সেকেলে। আজকাল কি আর এমন ভাষায় কেউ কথা বলে!’ ‘যামিনী’, ‘শশী’, ‘বিম্বিত’– এইসব শব্দপ্রয়োগ নিয়ে সহকারী মশাই ভীষণ চিন্তিত।

এক মুহূর্ত সবাই চুপ। একমুখ মেঘ করে বসে আছেন গৌরীপ্রসন্ন। হইহই করে উঠলেন প্রণব রায়। তিনি বললেন, ‘আরে গৌরী তো এণ্টনী সাহেব হয়ে বেঁচেছেন। তবে বেরিয়েছে এই গান, যা সেই সময়কে ধরেছে। ইতিহাসকে ধরে ইতিহাস সৃষ্টি করবে এই গান।’

আশার আলো ফুটল বটে, তবে কিন্তু কিন্তু ভাবটা থেকেই গেল পরিবেশে।

সব কথার শেষ কথা– উত্তম কথা

বিকেল ঘনিয়ে এল। লাঞ্চ শেষে দরজা খুলে ঢুকলেন এন্টনী ফিরিঙ্গী– উত্তম কুমার। সাদা শার্টে তাঁর উপস্থিতি রাজকীয়; অথচ আচরণে বিনয়। তিনি চারদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘গানটা শুনি। মেজাজে ঢুকতে হবে।’

স্টুডিওতে আবার শুরু হল সুর, কথা আর কণ্ঠের খেলা। মান্না দে নতুনভাবে গাইলেন। অনিলের সুর, প্রণবের প্রস্তাব, গৌরীর কবিতা– সব মিলিয়ে বিছিয়ে রইল বিস্ময়।

‘এন্টনী ফিরিঙ্গী’ সিনেমায় ‘আমি যামিনী, তুমি শশী হে’ গানের দৃশ্য

গান শেষে উত্তমকুমার হাত মুঠো করে বললেন, ‘এ গানটা যদি ছবির সঙ্গে মিশে যায়, তবে অভিনয়ের আলাদা কিছু করার দরকার নেই। সুরই চরিত্র হয়ে যাবে। কী কথা লিখেছ গৌরীদা!’

সেদিন শুধু একটি গানে রেকর্ডিং ছিল না। সেটা হয়ে উঠেছিল সময়ের ভেতর দিয়ে জন্ম নেওয়া এক অমর সুর। সেদিন আসলে রেকর্ড হয়েছিল ইতিহাস।

রাসবিহারীর সেই ঘরে বলা গল্প, স্টুডিওর দুপুরের আলো, সেই নিখুঁত খুঁতখুঁতে মন, বিতর্ক, আর সাহসী প্রস্তাব– সব মিলিয়ে সেই সুর আজও ভেসে আসে করিডরে, আজও শোনা যায় মনের ভেতর–

‘আমি যামিনী… তুমি শশী হে…’ আজও মুগ্ধ হই বারবার।