Robbar

ঈশ্বরের কোনও মিডলম্যানের প্রয়োজন নেই, নখ কাটলেও নেই না কাটলেও নেই

Published by: Robbar Digital
  • Posted:October 11, 2025 6:00 pm
  • Updated:October 11, 2025 6:01 pm  

প্রাচীন সভ্যতার সময় থেকেই মানুষ নখ আর চুলকে শরীরের একধরনের আত্মিক অঙ্গ বলে মনে করত। কারণ মৃত‍্যুর পরও এর বিনাশ হয় না চট করে। আধুনিক বিজ্ঞান তো প্রমাণও করেছে প্রাণপাখি উড়ে গেলেও এর বৃদ্ধি জারি থাকে। মিশর, ব্যাবিলন ও মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন সমাজে নখ কাটার পর কীভাবে ফেলা হবে তা নিয়েও ছিল সতর্কতা। মানুষ তখন বিশ্বাস করত, শরীর থেকে যে কোনও অংশ আলাদা হয়ে গেলে সেটা কালা জাদুর একটা জম্পেশ অর্ঘ‍্য হতে পারে।

সৌকর্য ঘোষাল

২৩.

ভাবলে অবাক লাগে নখ কাটার মতো একটা সাধারণ, স্বাস্থ্যকর অভ্যাসও ভয়ের ছায়া থেকে বেরতে পারেনি। আর সে ছায়া যতই ছোট হোক না কেন, এদিক-ওদিক করে কুসংস্কার ঠিক এঁটেও গিয়েছে তাতে। ফলে অবধারিতভাবে এসেছে সাবধানবাণী যার ফিরিস্তির শেষ নেই! কেউ বলবে রাতে নখ কাটলে বিপদ; কারও আইডিয়া-মাফিক শনিবারে নখ কাটা মানেই দুর্ভোগের শুরু; কেউ কেউ তো আবার এমন দাবি করতেও ছাড়েনি যে, নখ কাটার সময় যদি উনিশ-বিশও ভুল হয়ে যায়, তাহলে পরিবারে অসুখ বা মৃত্যুর আনাগোনা বাড়ে চড়চড়িয়ে। এসব বিশ্বাসের গোড়ার দিকটা উল্টেপাল্টে দেখলেই বোঝা যায়, কেবল ধর্মীয় বা লোকাচার নয়, অনেক ক্ষেত্রে এসব উঠে এসেছে বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং মানুষের অজানাকে বাড়িয়ে-চাড়িয়ে ব্যাখ্যা করার প্রবণতা থেকে।

প্রাচীন সভ্যতার সময় থেকেই মানুষ নখ আর চুলকে শরীরের একধরনের আত্মিক অঙ্গ বলে মনে করত। কারণ, মৃত‍্যুর পরও এর বিনাশ হয় না চট করে। আধুনিক বিজ্ঞান তো প্রমাণও করেছে প্রাণপাখি উড়ে গেলেও এর বৃদ্ধি জারি থাকে। মিশর, ব্যাবিলন ও মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন সমাজে নখ কাটার পর কীভাবে তা ফেলা হবে, তা নিয়েও ছিল সতর্কতা। মানুষ তখন বিশ্বাস করত, শরীর থেকে যে কোনও অংশ আলাদা হয়ে গেলে সেটা কালাজাদুর একটা জম্পেশ অর্ঘ‍্য হতে পারে। নখের টুকরো বাগিয়ে নিয়ে যাতে শত্রুরা তুকতাক করতে না পারে তাই অনেক সময়েই নখ কেটে পুঁতে রাখা বা পুড়িয়ে ফেলা ছিল দস্তুর। পূর্ণিমা বা অমাবস্যার দিন নখ কাটা ছিল নৈব নৈব চ। কারণ চন্দ্র, গ্রহ আর তারাদের গতির সঙ্গে মানুষের ভাগ‍্যের যে মহাজাগতিক সম্পর্ক, তা গুবলেট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও বেশি। গ্রিস ও রোমের প্রাচীন সমাজে নখ কাটার জন্য নির্দিষ্ট কয়েকটা দিনকে যেমন শুভ বলে মানা হত তেমন ধারণার চল ছিল আরও অনেক সভ‍্যতায়। যে দিনগুলো ধরা হত দেবতাদের পুজোর জন্য পবিত্র, সে দিনগুলোয় নখ কাটা বা চুল কাটা মানে ইষ্টকে অসম্মান করা। মাসের কিছু দিন ছিল বিশেষভাবে অশুভ, যে সময় নখ কাটলে দেবতাদের ক্রোধ ঠেকাতে পারবে না কেউ।

ভারতবর্ষে নখ কাটার সঙ্গে অমঙ্গলের সম্পর্ক অবশ‍্য অনেক পুরনো। সপ্তাহের প্রত‍্যেকটা দিনই এখানে কোনও না কোনও দেবতার প্রতি উ‍ৎসর্গ তাই এই দিনগুলোর সঙ্গে নখ বা চুল কাটার সম্পর্ক যাচাই করে দেখা হত চুলচেরা বিশ্লেষণে। যেমন বুধবার নখ কাটা অশুভ কারণ এতে পারিবারিক বিবাদ বাড়ে বা আর্থিক ক্ষতি হয়। বৃহস্পতিবার যেহেতু ‘গুরুবার’ তাই নখ কাটলে গুরু বা শিক্ষকের প্রতি দেখানো হয় অসম্মান। আর শনিবার নখ কাটলে তো রক্ষে নেই। একে তো শনিদেবকে পুরোহিতরা এমন ভিলেন বানিয়েছে যে শনির নাম শুনেই পাবলিকের আত্মারাম খাঁচা-ছাড়া, চোখে চোখ রাখারও ক্ষমতা নেই এরপর সে যদি রেগে যায় তো বাবার নাম খগেন হয়ে যাবে অনায়াসে। এমনকী ইংরেজদের গোলামি করে কষ্টেসৃষ্টে পাওয়া একটাই ছুটির দিন, রবিবার সেদিনও নাকি নখ কাটলে চোখ খারাপ হতে পারে। মানে ইয়ার্কির একটা লিমিট আছে!

রাতের বেলা নখ কাটা সারা দেশেই দীর্ঘদিন ধরে একধরনের নিষিদ্ধ কাজ। আগে অবশ‍্য ব‍্যাপারটার মধ‍্যে একটা যুক্তি ছিল। তখন তেলের প্রদীপ বা মোমবাতির আলোয় নখ কাটলে নখের টুকরো হারিয়ে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা ছিল, যা বিপজ্জনক ও অস্বাস্থ্যকর। কিন্তু ধীরে ধীরে এই বাস্তব সমস‍্যা রূপ নিল কুসংস্কারে, এবং বলা শুরু হল যে, রাতে নখ কাটলে ভূত-প্রেতের প্রকোপ বাড়ে। কিন্তু টেসলা-এডিসানোত্তোর যুগের ঝলমলে আলোয় রাত্তিরের কাটা নখ হারিয়ে যাওয়া স্রেফ ক‍্যালাসনেস ছাড়া কিছু না। তাই ভূতের ভয়টা না থাকলে আজকের যুগে রাতে নখ না কাটার কোনও কারণ নেই, যেখানে সন্ধ‍্যা বাজারে আস্ত মুরগি কেটে ফেলছে লোকে ডিনার পার্টির আয়োজনে।

শিল্পী: সৌকর্য ঘোষাল

ইসলামিক সংস্কৃতিতেও নখ কাটার নির্দিষ্ট সময় নিয়ে কিছু প্রথা আছে বইকি। শুক্রবারে জুমার নামাজের আগে নখ কাটা ও পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা একটি পবিত্র কাজ, ভালো কথা। কিন্তু বৃহস্পতিবারে নখ কাটাকে কেন যে আলাদা করে শুভ মনে করা হয় এর বিজ্ঞানটা স্বয়ং বৃহস্পতিও জানেন কি না বলা মুশকিল। তবে রাতে নখ না কাটার রীতি নিয়ে ভালো রকম কড়াকড়ি আজও আছে। যদিও এর মূল কারণ সেই আলোর অভাব থেকেই উদ্বুদ্ধ কিন্তু হ‍্যালোজেন আবিষ্কার হওয়ার পরও বিশ্বাসের তেমন যে কোনও আপগ্রেড হয়নি, এটা লজ্জাজনক। প্রাক্-ইসলামিক আরবে কিছু গোষ্ঠী আবার মঙ্গলবার বা শনিবারে নখ না কাটার নিয়ম কায়েম করেছে।

ইউরোপের মধ্যযুগে নখ কাটা নিয়ে ছিল অসংখ্য ছড়া ও লোকগাথা। ইংল্যান্ডের একটি ছড়ায় বলা হয়েছে, সোমবারে নখ কাটলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে, মঙ্গলবারে কাটলে ধন আসে, বুধবারে কাটলে খবর আসে, বৃহস্পতিবারে কাটলে নতুন জুতো পাওয়া যায়, শুক্রবার কাটলে দুঃখ আসে, শনিবারে কাটলে প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা হবে আর রবিবারে কাটলে পুরো সপ্তাহে দুর্ভাগ্য ঘনাবে। নখ হোক বা শালিক পাখি কুসংস্কারের ভয় ছড়িয়ে ছড়া কাটতে সাহেবদের জুরি মেলা ভার। তাই সাহেবদের মধ‍্যে এই ছড়াটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আওড়ানো ছিল চল। খ্রিস্টান ধর্মীয় প্রভাবের কারণে রবিবারকে ‘লর্ডস ডে’ হিসেবে ধরা হল, তাই এই দিন শরীরের কোনও অঙ্গ কাটার অর্থ হল লর্ডের প্রতি অসম্মান জ্ঞাপন করার বিজ্ঞাপন। এদিকে শুক্রবার যিশুখ্রিস্ট স্বয়ং ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন, তাই এই দিন হল শোকের দিন আর শোকের সঙ্গে কাটা নখ তো স্বাভাবিক ভাবেই বেমানান। ফিটফাট হয়ে আর যাই হোক বিষাদ পালন হয় না। এছাড়া ডাইনি বিদ্যার ভয়ে নখের টুকরো এখানে-সেখানে ফেলে রাখা মানে ছিল অশনি সংকেত, যে জাত ডাইনির ভয়ে রাতে ঝাঁট দেয় না, সে অমানিশিতে নখ কাটবে কোন মুখে?

চিন ও জাপানে নখ কাটার সময় নিয়ে, বিশেষ করে রাতের সময়টাকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল জোরদার মৃত‍্যুর কুসংস্কার। সম্ভবত রাতের অন্ধকারে ধারালো জিনিস দিয়ে নখ কাটলে দুর্ঘটনা ঘটত বলেই জন্ম নিয়েছিল এই বিশ্বাস। কিন্তু অন্ধকারে নখ কাটলে আয়ু কমে যায় বা আত্মা বিপদে পড়ে এমন বাড়াবাড়ি যে ধরনের অজ্ঞতা থেকে আসে, তা রাতের অন্ধকারের থেকেও ঘন। জাপানে আজও প্রচলিত একটা প্রবাদ আছে, রাতে নখ কাটলে বাবা-মায়ের মৃত্যুর সময় পাশে থাকতে পারবে না। মানে এর মধ্য দিয়ে মৃত্যুভয়কে পারিবারিক বিচ্ছিন্নতার সঙ্গে জুড়ে ব‍্যাপারটাকে আরও বড় হাহাকারে পরিণত করা হয়েছে। চিনের কিছু অঞ্চলে ভূত-প্রেতের উৎসব খুব বড় উৎসব, তাই সে সময় নখ না কাটার বিধান আছে কারণ এই সময়ে যেহেতু জাঁদরেল সব আত্মারা ঘুরে বেড়ায় তাই নিজের শরীর থেকে কিছু কেটে ফেলা মানে নিজের দুর্বল আত্মার একটা টোকেন বাঁজখাই বিদেহীদের হাতে তুলে দেওয়া। আফ্রিকার বিভিন্ন সমাজেও নখ কাটা নিয়ে বিশ্বাসের অন্ত নেই। অনেক গোষ্ঠীর মধ‍্যে রাতে নখ কাটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, কারণ মনে করা হয় এতে অশুভ আত্মা বা কালা জাদুর প্রভাব বাড়ে। অনেক জায়গায় নখের টুকরো যত্ন করে পুড়িয়ে বা পুঁতে ফেলা হয়, যাতে কেউ তা ব্যবহার করে অভিশাপ দিতে না পারে। কিছু আফ্রিকান সম্প্রদায়ে বিশেষ বিশেষ পবিত্র দিনে নখ না কাটার নিয়ম আছে, কারণ ওই দিনগুলোয় সামাজিক ঐক্য ও আধ্যাত্মিক ভারসাম্যের হিসেব করা হয় যা নখ কাটলে হেরফের হতে পারে। অর্থাৎ, কুসংস্কারের চোখে ঐক‍্য আর আধ্যাত্মিকতার ওজন যে নখের যোগ‍্য, এ কথা স্পষ্টই বোঝা যায়।

বিশ শতকে বিদ্যুৎ, আধুনিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও ইন্টারনেটের দুনিয়ায় এইসব কুসংস্কারগুলো আর তেমন প্রাসঙ্গিক নয় কিন্তু এখনও এই ধারণাগুলো গ্রামীণ সমাজে, পারিবারিক প্রথায় ও সাংস্কৃতিক স্মৃতিতে দিব‍্যি টিকে আছে রমরমিয়ে। অনেক পরিবারে আজও শিশুদের শেখানো হয় অমুক দিন বা রাতে নখ না কাটতে। যারা কুসংস্কারের তোয়াক্কা করে না তারা মানে না, যারা করে তারা সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে অনুসরণ করে চলে। নখ কাটার সময় ও দিন নিয়ে অমঙ্গলের ধারণা আসলে মানুষের প্রাচীন প্রবৃত্তির প্রকাশ যেখানে অজানা বা বিপজ্জনক কিছু বোঝানোর জন্য সবচেয়ে সহজ উপায় ছিল কিছু নিয়ম বানিয়ে ফেলা। আর তা লাগু করার জন‍্য সবসময় কাঁধে বন্দুক রাখা হত বেচারা পরমেশ্বরের। বলা বাহুল‍্য, এর প্রচার করার জন‍্য আগে থেকেই তৈরি ছিল স্বঘোষিত ঈশ্বরের দূত অর্থাৎ পুরোহিত, পাদ্রী আর মৌলবিরা। যুগ যুগ ধরে যাদের খদ্দের হল সাধারণ মানুষ। সেই সাধারণ মানুষ যারা নুন আর পান্তার হিসেব করতে এতই ব‍্যস্ত থাকত যে, তাদের মাথাতেই আসত না সহজতম একটা যুক্তি। পরমেশ্বর, যিনি সৃষ্টি করেছেন এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, যাঁর ঋতম্ভরা ছন্দ অনু-পরমাণু ও প্রত‍্যেক আত্মার প্রাণে স্পন্দিত, তাঁর কোনও মিডলম‍্যানের প্রয়োজন নেই। নখ কাটলেও নেই, না কাটলেও নেই।

……………..অপয়ার ছন্দ অন্যান্য পর্ব……………..

পর্ব ২২। দুধ পুড়ে যাওয়ার কুসংস্কারই পারে দুধের মতো অমূল্য শিশুখাদ‍্যের অপচয় থামাতে

পর্ব ২১। ভাঙা বিগ্রহ জানান দেয়, সৌন্দর্যের শত্রুরা আজও বর্তমান

পর্ব ২০। পেঁচা মনে করিয়ে দেয় প্রকৃতি আর অলৌকিকের মাঝের সীমানা খুব সূক্ষ্ম

পর্ব ১৯। রাতে, ঝাঁটা নিয়ো না হাতে

পর্ব ১৮। তিল থেকে তাল

পর্ব ১৭। অন্ধবিশ্বাস মাথাচাড়া দিলে ‘অপয়া’ হয় মাথায় হাত

পর্ব ১৬। চুল তার কবেকার অন্ধকার অপয়ার নিশান

পর্ব ১৫। যে আত্মীয়তার ডাককে অপয়া বলে বিকৃত করেছে মানুষ

পর্ব ১৪। অকারণে খোলা ছাতায় ভেঙে পড়েছে পাবলিক প্লেসে চুমু না-খাওয়ার অলিখিত আইন

পর্ব ১৩। দলবদলু নেতার মতো ধূমকেতু ছুটে চলে অনবরত

পর্ব ১২। কখনও ভয়ংকর, কখনও পবিত্র: দাঁড়কাক নিয়ে দোদুল্যমান চিন্তা!

পর্ব ১১। শুধু একটা হ‍্যাঁচ্চো– বলে দেবে কীভাবে বাঁচছ

পর্ব ১০। অপয়ার ছেলে কাঁচকলা পেলে

পর্ব ৯। চোখের নাচন– কখনও কমেডি, কখনও ট্র্যাজেডি!

পর্ব ৮। জুতো উল্টো অবস্থায় আবিষ্কার হলে অনেক বাড়িতেই রক্ষে নেই!

পর্ব ৭। জগৎ-সংসার অন্ধ করা ভালোবাসার ম্যাজিক অপয়া কেন হবে!

পর্ব ৬। প্রেম সেই ম্যাজিক, যেখানে পিছুডাক অপয়া নয়

 পর্ব ৫। ডানা ভাঙা একটি শালিখ হৃদয়ের দাবি রাখো

পর্ব ৪। জন্মগত দুর্দশা যাদের নিত্যসঙ্গী, ভাঙা আয়নায় ভাগ্যবদল তাদের কাছে বিলাসিতা

পর্ব ৩। পশ্চিম যা বলে বলুক, আমাদের দেশে ১৩ কিন্তু মৃত‍্যু নয়, বরং জীবনের কথা বলে

পর্ব ২। শনি ঠাকুর কি মেহনতি জনতার দেবতা?

পর্ব ১। পান্নার মতো চোখ, কান্নার মতো নরম, একা