Robbar

বইয়ের ভাস্কর্য: আরেকরকম পাঠ

Published by: Robbar Digital
  • Posted:October 17, 2025 8:47 pm
  • Updated:October 17, 2025 8:47 pm  

ক্যানভাস, তেল রং, তুলি আর পেনসিলেই, দীর্ঘ সময় অভ্যস্ত ছিলেন সাবা হোসেন। যেহেতু একজন শিল্পী, বোধহয় তাই ক্রমাগত আঁচড় কেটে চলেছেন মন। মস্তিষ্ক। প্রথাগত ধারণা। বলছেন, আমি যদি পাতার ছবি আঁকতে চাই, তবে ক্যানভাসে শুকনো পাতাই ব্যবহার কেন করব না? মালার্মের কবিতার মতো, এক মাধ্যমের সঙ্গে আরেক মাধ্যম মিশে যাচ্ছে। কী অনায়াসে। সাবা বলছেন, ঘাস, সুতো, ছোট ছোট পাথর, কফি, গাছের ছাল, কখনও শিকড়, ফেব্রিক, পোড়া বইয়ের ছাই– সকলে মিলে নির্মাণ করেছে অনন্য একেকটি অক্ষর। স্বাধীন সেইসব অক্ষর, ফের একবার উড়ে যাচ্ছে, জুড়ে বসছে, ধারণ করছে বই।

রোদ্দুর মিত্র

একটি বই। মুছে দেয় সময়। ছাই।

কবিতা লিখছেন স্তেফান মালার্মে। কখনও শব্দের সঙ্গে জুড়ছেন সংখ্যা। যোগ। বিয়োগ। গুণ। ভাগ। বলছেন, পাণ্ডুলিপি একা গতিময়। তাকে গুণ করতে হবে ৩ দিয়ে। কী আশ্চর্য গাণিতিক প্রয়োগ ঘটিয়ে লিখলেন, ২,৪০,০০০ গুণ ৩। ফলাফল, ৭,২০,০০০। যেন দৃশ্যকাব্য! এক মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে অনায়াস ঝাঁপ। যেভাবে অসংখ্য দীর্ণ ও জীর্ণ বই, হয়ে উঠেছে স্বতন্ত্র এক শিল্প। বইয়ের ভাস্কর্য। শিল্পী সাবা হাসানের চিন্তা ও বোধে। তিনি ফিরে গিয়েছেন সেই মালার্মের কবিতায়। মালার্মে লিখছেন, একটি বইয়ের শুরুয়াত নেই। ইন্তেকাল নেই। খুব বেশি হলে, আছে ভণিতা। সাবা হাসান বইয়ের সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছেন ক্লে। চিনার গাছের পাতা। বিয়াস নদীর নুড়িপাথর। এলাচ। দারচিনি। ঝিনুক। আস্ত একটা সমুদ্র। প্রদর্শনীর নাম রাখছেন, ‘জো গায়েব হ্যায় অর হাজির ভি’। মনে পড়ছে, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ। ‘হাম দেখেঙ্গে’। যে কবিতা অনন্তে লীন! সে কবিতার শরীর থেকে তুলে আনা একটি অমোঘ পংক্তি যেন! দীর্ঘ কোনও কল্পনার ধারাবিবরণীর মতো হয়ে আছে কিরণ নাদার মিউজিয়াম অফ আর্ট। দিল্লির আলোবাতাসে মিশে যাচ্ছে একঘর রেজিস্ট্যান্স। অগোচরে।

যা-কিছু কল্পনাপ্রবণ, ছক ভাঙা ও অনুসন্ধিৎসু! জন্ম দেয় অভিনব একটি দর্শনের। আপনার মনে হতে পারে তা অপরিণত ও ল্যাগব্যাগে। তবু, বই এবং কবিতা– দুইয়ের প্রতি দীর্ঘকালীন প্রেম থেকে সাবা হাসান নানাবিধ প্রশ্নের সম্মুখীন। একটি বইয়ের ওপর কোন ভাষার আধিপত্য? নিশ্চয়ই লেখ্য ভাষা! অথবা মুদ্রণের ভাষা। কিংবা যে ভাষা পাঠযোগ্য, উচ্চারণক্ষম। কিন্তু সেইসব ভাষা ছাড়া কি একটি বইয়ের ভাষা নেই আর? সেই ভাষা যখন শরীর পায়, আমরা দেখি, একটি বই আধখোলা। তবু উল্টে রাখা। বইটির আশরীর অগুনতি পেরেক। সমকালীন ভারতে দাঁড়িয়ে, এ ভাষা খুঁচিয়ে দেয় আমাদের সম্মিলিত স্মৃতি।

দেখি, চারটি পোড়া বই। সম্মুখে। লাল। নীল। সাদা। ঘন কালো। রং পেয়েছে। যে আইডিয়া পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিল রাষ্ট্র, জোরপূর্বক, আঙ্গিক বদলে এখনও দৃঢ়। অর্থ হয়, শিল্পের যে অন্তর্নিহিত সত্য, আদতে ক্ষয়হীন। সাবা হাসান এহেন পোড়া বই থেকে তৈরি করেছেন, ‘বার্নট্ বুকস্ সিরিজ’। বেশিরভাগ সময় নিজেই পুড়িয়েছেন বই। বলছেন, চৌকো কাঠের বাক্সের ভেতরে একবার বই পুড়িয়েছেন। প্রায় ভেঙে দিয়েছেন কাচের ঢাকনা। কয়েকটি কাচের টুকরো যেন ধ্বংসাবশেষ। সে ভাস্কর্যে পরিণত হয়েছে যখন, নাম হয়েছে: ‘বুক ইন আ স্ম্যাশড বক্স’। জানতে পারি, যে বইটি পোড়ানো হয়েছিল, তার লেখক ইসমাত চুঘতাই। বিখ্যাত উপন্যাস, ‘জিদ্দি’। দেখুন, কোনও এক সত্যের খোঁজে শিল্পের যে নিরন্তর যাতায়াত, উপন্যাসে হোক অথবা ভাস্কর্যেই– সেই পথে কোনও দেওয়াল ওঠেনি। অনুবাদের ভাষা কিংবা ফর্ম অদলবদল করেছে। বরং পথ আরও প্রসারিত। অদম্য। সুন্দর। বই পোড়ানো সম্পর্কে সাবা বলছেন, বই সম্পর্কে সামাজিক ধারণা কেমন? জ্ঞানের আধার। দৈবশক্তিপ্রাপ্ত। সমূলে পাল্টে দিতে পারে আমাদের চিন্তাধারা। অথচ, জ্ঞানের এহেন গভীরতা অথবা বইকেন্দ্রিক আমাদের রোম্যান্টিসিজম ও সুপ্ত প্রিভিলেজ– জাস্ট এক ফুলকিতে পুড়িয়ে দেওয়া যায়। ঘৃণা ছাড়া অর্থহীন বলে মনে হয় এ-জগতের যাবতীয় সত্য।

ক্যানভাস, তেল রং, তুলি আর পেনসিলেই, দীর্ঘ সময় অভ্যস্ত ছিলেন সাবা হোসেন। যেহেতু একজন শিল্পী, বোধহয় তাই ক্রমাগত আঁচড় কেটে চলেছেন মন। মস্তিষ্ক। প্রথাগত ধারণা। বলছেন, আমি যদি পাতার ছবি আঁকতে চাই, তবে ক্যানভাসে শুকনো পাতাই ব্যবহার কেন করব না? মালার্মের কবিতার মতো, এক মাধ্যমের সঙ্গে আরেক মাধ্যম মিশে যাচ্ছে। কী অনায়াসে। সাবা বলছেন, ঘাস, সুতো, ছোট ছোট পাথর, কফি, গাছের ছাল, কখনও শিকড়, ফেব্রিক, পোড়া বইয়ের ছাই– সকলে মিলে নির্মাণ করেছে অনন্য একেকটি অক্ষর। স্বাধীন সেইসব অক্ষর, ফের একবার উড়ে যাচ্ছে, জুড়ে বসছে, ধারণ করছে বই। সার্কেল অফ লাইফ ব্রাদার! আমরা যখন পড়ছি, মনে হচ্ছে বই তো আসলে জাফরি কাটা খিড়কি। অথবা ছিল দরজা। আলতো ঠেলা দিলেই চৌকাঠ। পেরিয়ে পৌঁছে যেতাম উঠোনে। তারপর সিঁড়ি। বেয়ে বেয়ে মনের চিলছাদ। ‘বুকস অফ ডোরস’ কিংবা ‘বুকস অফ থ্রেশহোল্ড’ সিরিজের স্কাল্পচারগুলো আসলে সেই কল্পনা। বহুমাত্রিক ছিল এতদিন। এখন আমাদের চাক্ষুষ।

অর্থাৎ, প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ ঘটছে সরাসরি। যেন প্রাকৃতিক উপাদানসমূহের পুনর্নির্মাণেই মুক্ত হয়েছে আশ্চর্য কোনও পথ। সেই পথ ধরে সাবা হাসান পাড়ি দিয়েছেন যেন মিশরীয় সভ্যতায়। যেভাবে মৃতদেহ সংরক্ষণ করা হয়েছিল–সোডিয়াম কার্বনেট ও সোডিয়াম বাইকার্বনেট, তৈলপদার্থ, সাদা ব্যান্ডেজ… আসলে স্পষ্ট হয়, ক্ষয়হীনতা। এই একুশ শতকে আমরা দেখছি, একটি বই সাদা ব্যান্ডেজে মুড়ে রেখেছেন শিল্পী। বইয়ের গায়ে রকমারি মশলা। বুনোফুল। আবার কাশ্মীরের লিডার নদীর পাথর। যেন একটি বই সশরীর আছে, অথচ নেই। যেন ভান করছে। যেন একটি বইকে নিঃস্ব করে দিয়ে, লেখা হচ্ছে আরবার। ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ লিখছেন, উঠেগা আনাল-হাক কা নারা… আ চাইল্ড ভয়েস বলে যে ভাস্কর্য, সেখানে একটি বইয়ের ওপর পাঁচটি আঙুল। পোড়া। ধোঁয়া বেরচ্ছে।

শুরুয়াতে যে সত্যের কথা বলেছিলাম। সে-ই আনাল-হাক। যার আশপাশে পৌঁছনোর চেষ্টা করছে প্রতিটি বই-ভাস্কর্য। যে বইটি অবিন্যস্ত, হাত-পা ছুড়ছে, কাটা ছেঁড়া ও জোড়া– ক্লে, সুতো আর কাগজের কেরামতি– সেই ভাস্কর্য সিরিজের নাম রাখা হয়েছে, দ্য বুক অফ ডিসকোয়ায়েট। ফার্নান্দো পেসোয়ার বিখ্যাত উপন্যাস। বইয়ের ভেতরে জন্ম নিয়ে আস্ত একটা কবরখানা। বইয়ের পাতা মিহি করে কেটে, বইয়ের ভেতরেই সেগুলো জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আপনি যদি রসিক মানুষ হয়ে থাকেন, কচিঘাসের গন্ধ পাবেন নির্ঘাত। শুনতে পাবেন, আনাল-হাক। উপন্যাস, কবিতা ও ভাস্কর্য সংমিশ্রণে। কখনও প্রকৃতি সত্য। কখনও প্রতিরোধ। কখনও স্মৃতি। দেখুন সত্য, সংরক্ষণ আর ভালোবাসার পরিসর তো কমে গেল আমার দেশে। তবু ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ বলেন, সেই আনাল-হাক, সেই পরম ঈশ্বর যেন তুমি। যেন আমি। যেন আমরা প্রত্যেকে। তাই সে অবিনশ্বর। আইডিয়া মৃত্যুহীন। সাবা হাসান তৈরি করেন ‘বুক ফসিল’ সিরিজ। শব্দ না থাকলেও, বইটির একক অস্তিত্বের ভাষা কী ভীষণরকম আছে। স্বাধীন সেই সমস্ত অক্ষর। ওটুকুই রেজিস্ট্যান্স।

এতদূর পড়লেন যারা, লক্ষ করুন, সর্বত্রই অথরিটিকে প্রশ্ন করেছেন শিল্পী। অস্ফুটে বলেছেন, হাম দেখেঙ্গে। অস্ত্র বলতে, বই। মালার্মে কবিতা লিখছেন। গ্যালারির দেওয়াল বলছে, রিড। অল ইজ দেয়ার। যে মনগুলো এতকাল নিবিড় পাঠে মগ্ন, বিশৃঙ্খল করছেন। গভীর কোনও দর্শনে।

……………………………………………………

লেখার সঙ্গে ব্যবহৃত প্রতিটি ছবিই লেখক সূত্রে প্রাপ্ত