এই পৃথিবীর বুকে প্রতিটা মানুষের ব্যক্তিগত হারানোর শোক আছে ও থাকে। জন্মের মতো মৃত্যু সত্য– এটুকু জেনেই আমাদের বড় ও বুড়ো হতে থাকা। কিন্তু সেই মৃত্যুর ওপর যখন পরাক্রমশালী রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ ও সম্পাদন করে। অপার ক্ষমতাশালী যুদ্ধবাজ রাষ্ট্র যখন জীবনের ওপর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করেও ক্ষান্ত হয় না, মৃত্যু-পরবর্তী শরীরের মর্যাদা হরণ করে। একটি গর্তে মৃত শরীরগুলো ছুড়ে পুঁতে দেয় তখন তৈরি হয় আরও কিছু প্রশ্ন।
ছোটবেলায় আলিয়া ফুবু আসত ভারতে চিকিৎসার জন্য। আমরা ছিলাম দূরসম্পর্কের আত্মীয় তার; রক্তশূন্য ফ্যাকাসে শরীর বছর চল্লিশের, তার চোখ দুটো ছিল ঘোলাটে। কিডনিতে পাথর হয়েছিল; তার অপারেশনের জন্য তিনি প্রথম আসেন ‘বর্ডার’ নামক একটা এই দুনিয়ার দোজখ পার করে। আর তিনি এসেছিলেন দু’-তিন মাসের জন্য, চিকিৎসা-অপারেশন করিয়ে ফিরে যান। আবার জটিল শারীরিক সমস্যায় পড়লে কাঁটাতার নামের দোজখ পেরতেন, বাঁচার ইচ্ছায়। যে-সময়টুকু তিনি এদেশে থাকতেন, আমাদের জড়িয়ে নিতেন আঁচলে। এ পাড়া সে পাড়া, এই বাড়ি আজ, কাল ওই বাড়ি, দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত তিনি হাদিসের গল্প বলতেন। সেই হাদিস কার লেখা, কত সত্য– পরোয়া না করলেও চলে কারণ প্রতিটা হাদিসের প্রথম পাতায় ‘সহি’ লেখা থাকত। সে যাই হোক, সেসব হাদিসের নানা গল্প, সেই গল্পগুলোর মধ্যে যখন ঢুকে পড়ত মৃত্যুর পর কবর আর দোজখের গল্পগুলো, তখন সাত-আট বছরের আমাদের শিশুমন বিচলিত হত। আমাদের কৌতূহল জাগত কবরের প্রতি, সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে জানহীন শরীরটার সঙ্গে কী কী হয়– সেসব কাহিনি শুনে ছোট জান কেঁপে উঠত। আলিয়া ফুবু বলতেন, আসমানের সাত মঞ্জিলের মতো; দোজখের সাত দরজা; সেখানে ৭০ হাজার লাগাম আর ৭০ হাজার ফেরিস্তা, তাঁরা নিয়ন্ত্রণ করবেন আল্লাহ পাকের আর্মি; উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যেমন ইজরায়েলের আইডিএফ বা একাত্তরের রাজাকার ও পাকবাহিনী।
শৈশবে আলিয়া ফুবুর হাদিসের দজখের গল্প শুনে কল্পনা করতাম রোজ কিয়ামতের দিন আর হাসরের ময়দানের পর দোজখের, আর জান্নাতের নানা খোয়াব কল্পনাবিশ্ব তৈরি হচ্ছিল। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিচয় হচ্ছিল আমাদের গণমানুষের ইতিহাস আর বর্তমানের সঙ্গে, তাদের গণকবর থেকে নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ আমাকে শেখাতে থাকে, দেখাতে থাকে এই দুনিয়ার দোজখ কেমন। ক্ষমতাশালী রাষ্ট্র কীভাবে হাসরের ময়দানের প্রস্তুত করে লাগাম আর ফেরেস্তা হিসেবে সশস্ত্র সৈন্যবাহিনী মোতায়েন করে। সদ্য ফিলিস্তিনের রাফা শহরকে রাতারাতি হাসরের ময়দানের রূপ কারা দেয় আজকের এই দুনিয়াতে? অবিরত যুদ্ধ বিমান থেকে আগুনের গোলা নিক্ষেপিত করে কারা এই দুনিয়াতে?
আলিয়া ফুবুর কাছেই প্রথম শুনেছিলাম রোজ কিয়ামতের দিনের কথা, যখন ইসরাফিলের শিঙ্গা বাজবে আর দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবে। আর আগত সেই হাসরের দিনে মানুষ দুনিয়া জুড়ে দৌড়ে বেড়াবে কিন্তু কেউ কাউকে চিনবে না; এমনকী, মা তার সন্তানকেও। চারিদিকে ইসরাফিলের শিঙ্গার বাজে যেন প্রলয় আর প্রলয় শুধু। আমাদের বর্তমান সময়ে গত দুই বছরে লাইভ স্ট্রিমে গাজায় ৬৮ হাজার মানুষ শিশু-সমেত যে হত্যাযোগ্য চালাল ইজরায়েল নামের না-রাষ্ট্র; ঘর-বাড়ি ধ্বংস করে যে দিগন্ত বিস্তৃত হাসরের ময়দান সংরচনা করল জায়নবাদী এই মতাদর্শ আর দুনিয়ার তাবড় তাবড় শক্তিশালী রাষ্ট্রের নীরব সমর্থন পেল। সেখানে দাঁড়িয়ে এই দুনিয়ার কাউকে আমি প্রশ্ন করতে চাই না আর। একমাত্র খুদা তালার ওপর প্রশ্ন ছাড়া। আমি জানি এখনও যুদ্ধে রক্তাক্ত ফিলিস্তিনের মা শিশু আল্লাহর নাম নেয়, আল্লাহর কাছে বিচার চায়। আর ইহজগতের সকল অন্যায় অবিচার সহন করে যায়, আলিয়া ফুবুর মতো বিশ্বাস নিয়ে; মৃত্যুর পর স্থায়ী জান্নাতের স্বপ্নে হয়তো।
আমি একজন চিত্রকর হিসাবে নিজের জায়গা নির্বাচন করে নিয়েছি নির্দ্বিধায়। কারণ ২৫৭৫ আব্দুল্লাহ ইবনে মুয়াবিয়া জুমাহি (রাহঃ)… আবু হুরায়রা (রাযি)-তে জাহান্নাম বা দোজখের যে বর্ণনা সেখানে আছে– ‘কিয়ামতের দিন জাহান্নাম থেকে একটি গর্দান বের হবে। এর দুটো চোখ থাকবে, যে দুটো দিয়ে সে দেখবে, দুটো কান থাকবে যা দিয়ে সে শুনবে এবং একটি জিহবা থাকবে যা দিয়ে সে কথা বলবে। সে বলবে তিন ব্যক্তির ওপর আমি নিযুক্ত হয়েছি, দুর্বিনীত অবাধ্যাচারী; যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে অন্যকে ইলাহ্ বলে ডাকে এবং ‘চিত্রকর’। আমি এই তিনের মধ্যেই পড়ি, তাই স্বেচ্ছায় নির্বাচন করা দোযখ নিয়ে আমার কোনও আক্ষেপ নেই। এই দুনিয়া হোক বা আখেরাতে যত শাস্তি আল্লাহতলা দেবেন সব– কবুল কবুল কবুল।
শুধু কিছু প্রশ্ন রেখে যাওয়া গত দুই বছরে যে অসংখ্য নিষ্পাপ শিশুহত্যা হল, তাদের কি আবার রোজ কিয়ামতের দিন পুনরুত্থান করা হবে কবর থেকে? আর সেই হাসরের ময়দান আবার তৈরি হবে, যেখানে হত্যা হওয়া শিশুরা তাদের মায়েদের চিনতে পারবে না, আর মায়েরা তাঁদের সোনা চাঁদ কলিজার টুকরাকে চিনতে পারবে না। এসবের প্রশ্ন করার মতো এই পৃথিবীতে আলিয়া ফুবু ছিল, যে মাঝে মাঝে এই দুনিয়ার সবচেয়ে বড় দোজখ সীমান্ত পারাপার করে চিকিৎসা করতে আসত, বাঁচার প্রবল আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। তিনি ফেলানি খাতুন বা স্বর্ণা দাস হননি এটা তাঁর নসিবের কথা; তবে রক্তশূন্য ফ্যাকাসে সাদা আলিয়া ফুবুর বেশিদিন বাঁচার নসিব ছিল না। হয়তো যদি কখনও হাসরের ময়দান হয়, আলিয়া ফুবুর সঙ্গে দেখা হলেও একে অপরকে আমরা চিনব না, আর এই প্রশ্ন হয়তো মনে থাকবে না।
উগ্র ধার্মিকরা সবসময় আমাকে মনে করিয়ে দেয় বা দেবে আমি মুনাফিক, আর চিত্রকর, আর মানুষের উপাসনা করতে চাই। হয়তো আমি তাঁদের চোখে কাফের; আমার এই প্রশ্নের জন্য যদি পাথর বর্ষিত হয়, হাসি মুখে মেনে নেব। তবু প্রশ্ন করব ফসল পেকে উঠেছে দু’দিন পর ঘরে উঠবে কৃষকের; আল্লাহতালা কেন এমন রেগে যান যে, এমন মুষলধারার বৃষ্টি নামিয়ে দেন, বা বানের জলে ভাসিয়ে দেন; কেন এমন খরা দেন যে কৃষকের যেটুকু সম্বল সব পুড়ে ছারখার হয়। কেন শ্রমিকের উৎপাদন শোষণ করে ফুলেফেঁপে ওঠা মালিকদের আল্লাহতালা দেখতে পান না। কবরের কথা হবে পরে, আগের দুনিয়ার কথা হোক। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি এই প্রশ্ন না করি নিজেকে মাফ করতে পারব না। সেসব প্রশ্নের মধ্যে আছে কাশ্মীরে হারিয়ে যাওয়া মানুষের গণকবরগুলোর অস্তিত্ব নিয়ে; তাঁদের গুনাহ কী আর বছরের পর বছর স্বশস্ত্র রাষ্ট্রীয় বাহিনী আল্লাহ্র চোখের সামনে কেমন করে এই নৃশংসতা চালাতে পারে; যখন একাত্তরের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ২০০টি বধভূমি ও ৩৫১টি গণকবর যখন শনাক্ত হল? বসনিয়া, ১৯৯৫ সালে ৮৩৭২ জন শিশু-কিশোর যুবক-পুরুষের হত্যা ও গণকবর যখন হচ্ছিল, তখন?
একথা জানি চিত্রকরের অহংকার থাকে আল্লাহ হয়ে ওঠে সে ক্ষুদ্র পরিসরে; নিজের বানানো চিত্রটি ছিঁড়ে পুড়িয়ে নষ্ট করে দিতে পারে মন চাইলে। কিন্তু কোন চিত্র নষ্ট হয় আর কোন চিত্র যত্নে থাকে– এই প্রশ্ন নিয়ে আজকের সময়ে আল্লাহ্র সম্মুখীন। আশা করি, আল্লাহতালাকে ভালোবাসলে প্রশ্ন করাও যায়। জবাবের প্রত্যাশা নেই, তবুও প্রশ্নগুলো জরুরি বলে মনে হয় আজকে।
এবারে আসি কবর আর গণকবরের প্রসঙ্গে; শৈশব থেকে কবরের প্রতি কৌতূহল তৈরি হয়; পরিজন বা প্রতিবেশীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। আমাদের বাড়ির সামনে সমবায় সমিতির ঠিক সামনে খোলা জায়গা যেখানে এক বুড়ো শিমূল গাছ ছিল; ঠিক সেখানে শিমূল গাছের নিচে মৃত মানুষটিকে রেখে পশ্চিম পানে; গ্রামের মানুষেরা জানাজার নমাজ পড়ত। সস্তা আতর আর গোলাপজল কেউরা জলের ঘ্রাণ কিছু সময় থেকে যেত মৃত মানুষটির জানাজা স্থল ও পথে। যেন বিদায়ের গন্ধ বিষাদের গন্ধ; হাওয়াকে ছুঁয়ে থাকা। এই পৃথিবীর বুকে প্রতিটা মানুষের ব্যক্তিগত হারানোর শোক আছে ও থাকে। জন্মের মতো মৃত্যু সত্য এটুকু জেনেই আমাদের বড় ও বুড়ো হতে থাকা। কিন্তু সেই মৃত্যুর ওপর যখন পরাক্রমশালী রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ ও সম্পাদন করে। অপার ক্ষমতাশালী যুদ্ধবাজ রাষ্ট্র যখন জীবনের ওপর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করেও ক্ষান্ত হয় না, মৃত্যু-পরবর্তী শরীরের মর্যাদা হরণ করে। একটি গর্তে মৃত শরীরগুলো ছুড়ে পুঁতে দেয় তখন তৈরি হয় আরও কিছু প্রশ্ন। করোনা অতিমারীর সময় জীবাণুর ভয় দেখিয়ে বহু রাষ্ট্র নতুন করে গণকবরের ক্ষেত্রটিকে জনমানসে বৈধ করে তুলতে সক্ষম হয়। তখন কবর আর গণকবরের ব্যবধান নিয়ে আলোচনা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে আরও।
এই লেখাটি কিছুটা উদ্ভ্রান্ত আমি জানি; কারণ নিজেকে কখনও আস্তিক বা নাস্তিকের মাপদণ্ডে মেপে দেখিনি; শুধু যে বিক্ষিপ্ত প্রশ্নগুলো সামনে আসে, তা করতে চাওয়া জরুরি বলে মনে করেছি। কিছু বছর আগে আমার এক সাংবাদিক বন্ধু অরিত্র-র কাছে কাশ্মীরের একটি কাহিনি শুনি; যা তাঁর আরেক স্থানীয় কাশ্মীরি সাংবাদিক বন্ধুর কাছে সে শুনেছিল। এক মা তাঁর তিন সন্তানকে আগেই হারিয়েছেন; শেষ সন্তান আট বছরের শিশু; স্কুল থেকে ফেরার সময় রাষ্ট্রীয় স্বশস্ত্র বাহিনীর গুলিতে সেও নিহত হয়। সেই নিহত সন্তানের মায়ের কাছে একটিমাত্র প্রশ্ন ছিল, তাঁর খুদে সন্তান অন্ধকারকে খুব ভয় পেত; কারেন্ট চলে গেলে মায়ের কোলে সেঁধিয়ে যেত এখন কবরের অন্ধকারে সে কত ভয় পাবে; সেই দুশ্চিন্তায় মায়ের ঘুম আসে না; রাতের পর রাত তাই ছোট ছেলের কবরের পাশে বসে থাকেন; কবরের অন্ধকার ভয় পেয়ে মরা সন্তান যদি মায়ের আশ্রয় চায়।
তবুও এই মা তাঁর সন্তানের নির্দিষ্ট কবর জানেন, এই হিংস্র পৃথিবীতে যাঁদের গণকবরের সংরচনা হয় তাঁদের কী হয়? সেইসব মা ও সন্তানের যদি রোজকিয়ামতের দিনে হাসরের ময়দানে আবার দেখা হয়ে যায় আর একে অপরকে চিনতে না পারে?
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved