
উনিশ শতকের জনপরিসরের অন্যতম মাধ্যম ছিল ছাদ। পড়াশোনা থেকে প্রেম, খাওয়া-দাওয়া থেকে আড্ডা-মজলিশ ক্রমেই ছাদকে কেন্দ্র করে হতে থাকে। গোটাটাই নিয়ন্ত্রণ করত বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি। মধ্যবিত্ত শ্রেণি ব্যতীত কারও ছাদ ব্যবহারের নজির দেখা যায়নি। ব্রিটিশদের অনুকরণেই বাঙালি শিক্ষিত সমাজ সামাজিক মেলামেশার এক মাধ্যম রূপে ব্যবহার করতে লাগল ছাদকে।
 
আমার পেটে খাবার
আমার মাথায় ছাদ
এই পুরনো প্রবাদটি মানুষের বেঁচে থাকার অপরিহার্য উপাদানগুলির একটিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। মানুষের বাসস্থানের মূলই হল তার ছাদ। শুরু করি ছাদনির্মাণের ইতিহাস দিয়েই। প্রতিটি জীবেরই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে প্রয়োজন আশ্রয়ের। যদি আমরা একটু পিছনে ফিরে তাকাই, বিভিন্ন সভ্যতায় এমন কোনও সময় ছিল না, যেখানে বসতির উপরিভাগগুলি (ছাদ) ক্রমাগত উন্নত হচ্ছিল না।

সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রাকৃতিক কিংবা বহিরাগত শক্তি থেকে রক্ষা পেতে মানুষ তৈরি করেছিল ছাদ। প্রাচীনকালের মানুষরা কাদার সঙ্গে গাছপালার নিচের মাটির সাহায্যে ছাদ তৈরি করত। প্রাচীন মিশরীয়রা মাটির টাইলস দিয়ে এবং গ্রিকরা মার্বেল টাইলসের মতো অত্যাধুনিক উপকরণ ব্যবহার করত। মধ্যযুগের ইউরোপে খড় ও নলখাগড়া ব্যবহার করে নির্মাণ করেছিল ছাদ। সমসাময়িককালে আদিবাসী আমেরিকানরাও ছাদ তৈরির জন্য ঘাস ও গাছের পাতা সংগ্রহ করা শুরু করে।
ধীরে ধীরে আধুনিকীকরণ ও শিল্পায়নের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বিকাশ ঘটেছিল ছাদেরও। কারণ বহু নতুন আধুনিক উপকরণ তৈরি হয়েছিল (স্লেট, অ্যাসফাল্ট)। এই উপকরণগুলি আরও মজবুত ও টেকসই। বিশেষত আমেরিকা ও ইউরোপের বিস্তীর্ণ অংশে উনিশ শতকে শিল্পবিপ্লবের প্রাথমিক পর্যায়ে, ছাদ নির্মাণের এক চমকপ্রদ পর্যায় লক্ষ করা যায়। যথা– ধাতব ছাদ ও অ্যাসফল্ট শিংলসের আবিষ্কার। ধাতব ছাদ স্থায়িত্ব ও অগ্নিরোধের জন্য মূল্যবান ছিল। অন্যদিকে অ্যাসফল্ট শিংলস ছিল মাটির টাইলস ও স্লেটের একটি সস্তা ও হালকা বিকল্প।
১৮৬৫ সালের দিকে ভারতে ছাদ নির্মাণের জন্য মাটির টাইলস একটি প্রধান উপকরণ হয়ে ওঠে। ইতিহাস বলছে, জার্মানির খ্রিস্টান মিশনারিরা ম্যাঙ্গালোরে সর্বপ্রথম মাটির ছাদের টাইলস উৎপাদন শুরু করে। এই টাইলস দীর্ঘদিন ম্যাঙ্গালোর প্যাটার্ন টাইলস হিসাবেও খ্যাত ছিল। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারও এর ভূয়সী প্রশংসা করেছিল। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পোড়া ইট এবং চুন মর্টার করে ছাদ নির্মাণ করা হত।
ছাদ নির্মাণ পদ্ধতির মোটামুটি একটা ধারণা হল এই। এবার আসা যাক, এর সামাজিক ভূমিকায়। এক্ষেত্রে আমরা ভারত তথা বাংলার গণ্ডির মধ্যেই আলোচনাটি সীমাবদ্ধ রাখছি। দীর্ঘ সময় বাদে কাঁচা ছাদের পরবর্তীতে ইট, বালি, সিমেন্টে গড়া পাকা ছাদ আবিষ্কার হল। তখন মানুষেরা ছাদেও দিনের একটি অবসর সময় সেখানে কাটাতে আরম্ভ করল। উনিশ শতকে কলকাতায় জনপরিসরের একটি ধারণা গড়ে ওঠে ব্রিটিশদের প্রবর্তিত ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে। তৈরি হয় মধ্যবিত্ত শ্রেণি। গঠিত হয় নানা সমিতি, ক্লাব। ফরাসি দার্শনিক ও সমাজবিদ হেনরি লেফ্রে তাঁর ‘দ্য প্রোডাকশন অফ স্পেস’ গ্রন্থে লিখছেন, বেশ কয়েক বছর আগেও ‘পরিসর’ ধারণাটি জ্যামিতিক অর্থ বহন করত। তবে, বর্তমানে এটি একটি সামাজিক জনগোষ্ঠীর কোনও নির্দিষ্ট ক্রিয়াকলাপকেও বোঝায়।

উনিশ শতকের জনপরিসরের অন্যতম মাধ্যম ছিল ছাদ। পড়াশোনা থেকে প্রেম, খাওয়া-দাওয়া থেকে আড্ডা-মজলিশ ক্রমেই ছাদকে কেন্দ্র করে হতে থাকে। গোটাটাই নিয়ন্ত্রণ করত বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি। মধ্যবিত্ত শ্রেণি ব্যতীত কারও ছাদ ব্যবহারের নজির দেখা যায়নি। ব্রিটিশদের অনুকরণেই বাঙালি শিক্ষিত সমাজ সামাজিক মেলামেশার এক মাধ্যম রূপে ব্যবহার করতে লাগল ছাদকে। যদিও, বেশ কয়েকজন পণ্ডিত উনিশ শতকের বাঙালিদের পুঁজিবাদ সম্পর্কিত ধারণা ও আদর্শ বুর্জোয়া জনসমাজের হ্যাবারমাসিয়ান ধারণার মধ্যে পার্থক্যের জন্য একটি ছেদবিন্দু টানেন। ইতিহাসবিদ পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও দীপেশ চক্রবর্তীর মতে, বাঙালিদের মধ্যে জনপরিসরের ধারণা বুর্জোয়া স্বত্বের ধারণার ওপর ভিত্তি করে ছিল না। বরং, অপরিহার্যভাবে বাঙালি বর্ধিত পরিবার ও বৃহত্তর সম্প্রদায়ের কাঠামোকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। যা জাতিগত আবির্ভাবের স্থান হিসাবে কাজ করেছিল। অর্থাৎ, সার্বিকভাবে দেখলে শুধুমাত্র নিজেকে শিক্ষিত কিংবা জৌলুস প্রদর্শনের জন্যেই ছাদের ব্যবহার নাও হয়ে থাকতে পারে।
আমি রাজমিস্ত্রি করি,
একখান ঘর তৈয়ারি।
টাকা নিব, ঘর করিব
আমরা করিব না জুয়াচুরি।
ছাদের সঙ্গে সংগীতেরও যোগ রয়েছে। কিছু সময় আগেও গ্রামবাংলায় ছাদ পেটানো গানের প্রচলন ছিল। আসলে, ছাদ তৈরির একঘেয়ে কাজ থেকে মুক্তির জন্য শ্রমিকরা গান করত। এটি ছিল এক ধরনের সারি গান। সুরে-ছন্দ মিলিয়ে তারা গান গেয়ে ছাদ তৈরি করত। গানের ছন্দে কাঠের দণ্ড ওঠে আর নামে।

টাকা-পয়সা মারিয়ে দিয়ে
মালিক গেল পালিয়ে,
এখন আমরা পড়িলাম ফ্যারে
কী করি উপায়।
বাংলার মানভূমে নারীশ্রমিকেরা এক ধরনের ঝুমুর গাইত। মুর্শিদাবাদের ডোমকলে ছাদ পেটানো গানের মধ্যে আলকাপের প্রভাব দেখা যেত। কখনও কখনও গানগুলিতে তাদের নিজস্ব আত্মকথন ও মালিক শ্রেণির প্রতি মজুরদের বিক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশিত হয়েছে।
এছাড়াও, সিনেমার ক্ষেত্রেও নানাভাবে ছাদের সামাজিক দিকটি ফুটে উঠতে দেখা যায়। পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের একাধিক বিখ্যাত সিনেমায় ছাদের ভূমিকা অনন্য। ‘মহানগর’ সিনেমায় শহুরে গৃহবন্দিত্বের মাঝে ছাদ হয়ে ওঠে স্বাধীনতার জায়গা। আবার ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ সিনেমায় সেই ছাদই হয়ে ওঠে অস্থির যুবসমাজের চিন্তার মঞ্চ। বর্তমান সময়ের নানা সিনেমার মধ্যেও ছাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি (বিবাহ,উপনয়ন) থেকে শুরু করে ধর্মীয় পার্বণ (বিশ্বকর্মা পুজোয় ঘুড়ি ওড়ানো, দোল)– সবেতেই ছাদ একটি সামাজিক মিলনক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে। ছাদ দুঃখে-সুখে, হাজারো নীরবতার ভিড়ে এক জ্বলন্ত দীপ হিসাবে জ্বলে থাকে মানুষের অন্তরে।
…………………
রোববার.ইন-এ পড়ুন অভিজিৎ চক্রবর্তী-র অন্যান্য লেখা
…………………
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved
